E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: ভালমন্দ মিশিয়ে

শেষ আপডেট: ০৩ মে ২০২৫ ০৭:২৩

কথাটা পড়েছিলাম বারোমাস পত্রিকার সম্পাদক প্রয়াত অশোক সেনের একটা লেখায়। তার আগে পর্যন্ত বেশির ভাগ নামী ইতিহাসবিদদের মন্তব্য ছিল কোনও বড় মানুষকে বর্তমান সময়ের নিরিখে দেখে যাচাই করতে হয়। অশোক সেন জানালেন, না। কোনও মানুষকে বিচার করতে হয় তাঁরই নিজস্ব সময়ের নিরিখে। তা না করাটা গোলমেলে। যেমন সম্রাট আকবরকে সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে ফেলে বিশ্লেষণ করাটা অসমীচীন। সম্রাট ঔরঙ্গজেবকে নিয়ে এ পর্যন্ত দেশ-বিদেশে কম আলোচনা হয়নি। এই সংবাদপত্রেই একাধিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতি ছাওয়া (ছবিতে একটি দৃশ্য) ছবিটিকে ঘিরে তৈরি হওয়া বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে কণাদ সিংহের ‘শুধুই খলনায়ক?’ (৩০-৩) প্রবন্ধে শিরোনামই আভাস দেয় ঔরঙ্গজেবের চরিত্রের নানা রঙের দিক। তিনি যে সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হয়ে দীর্ঘ সময় রাজত্ব চালিয়ে গেলেন, তা শাসকরূপে তাঁর চরিত্রের দৃঢ়তার পরিচয় বহন করে। তাঁর আকবরের মতো সম্রাটরূপে সর্বজনগ্রাহ্যতার কৌশলটি আয়ত্ত ছিল না। তদুপরি পিতার উপর অবিচার আর ভ্রাতার প্রতি নৃশংসতার বোঝা ছিল তাঁর উপর। ধর্মীয় স্থান ভাঙাটা যে কোনও শাসনের দস্তুর। যেমন অন্য ধর্মের মানুষের উপর অত্যাচার করাটাও। আকবরের সময়েও এ রকম ঘটনা ঘটলে তা বড় করে দেখানো হয়নি। পাশাপাশি প্রবন্ধকার জানিয়েছেন, ঔরঙ্গজেবের সমন্বয়ী চিন্তার কথাটাও। ৩০ শতাংশ হিন্দুকে নিয়ে চলার মনোভাবটাও কম নয়। তাঁর নিজের ধর্মের প্রতি নিষ্ঠার জন্য তিনি ফেজ টুপি তৈরি করতেন, ধর্মীয় পুঁথি নকল করতেন। তাঁর জীবনযাপন ছিল খুবই সহজ সরল। চরিত্রগত ভাবে ঔরঙ্গজেব নিষ্ঠুর ছিলেন, এ কথা কখনও বলা যাবে না। কখনও কখনও মন্দির নির্মাণকে তিনি সমর্থনও করেছেন। যেমন একাধিক হিন্দু ছিলেন তাঁর সময় বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত।

প্রকৃত অর্থে, সময়ের দাবি মেনে এক জন ক্ষমতাশীল ব্যক্তি হিসেবে কী ভাবে নিজের ক্ষমতা ধরে রেখে সাম্রাজ্য অটুট রাখা যায়, তার কূটনৈতিক কৌশলই অবলম্বন করেছিলেন ঔরঙ্গজেব। যে সময়ে একক ব্যক্তিই সর্বময় কর্তা, না ছিল গণতন্ত্র, না ছিল নির্বাচন, না ছিল সংবিধান বা ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি দায়বদ্ধতা, সেই সময়টাকে এখনকার সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে আতশকাচের নীচে ফেলে বিচার করাটা কতটা যুক্তিযুক্ত আর গ্রহণযোগ্য হবে?

তনুজ প্রামাণিক, হাওড়া

চাই নিরপেক্ষতা

কণাদ সিংহের ‘শুধুই খলনায়ক?’ পড়তে পড়তে মনে হল সম্রাট ঔরঙ্গজেব সাম্রাজ্যের লোভে বৃদ্ধ পিতাকে বন্দি করা এবং ভাইদের হত্যা করার মতো কিছু ক্ষেত্রে খলনায়কের ভূমিকা গ্রহণ করলেও সাম্রাজ্যের উন্নতি এবং মানবকল্যাণের উদ্দেশ্যে বেশ কিছু ক্ষেত্রে তিনি যুগোপযোগী সদর্থক ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। যার ফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। ছাওয়া সিনেমাতে ঔরঙ্গজেবের যে চরিত্র তুলে ধরা হয়েছে, তা নেতিমূলক, একপেশে এবং অনেকটাই বিভ্রান্তিকর, যার কারণে দেশের বেশ কিছু জায়গায় অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে, যা কখনও কাম্য নয়। মনে রাখতে হবে সিনেমা বিনোদনের জন্য। বক্স অফিসের প্রয়োজনে এবং মোটা টাকা মুনাফার জন্য পরিচালকেরা মাঝেমধ্যেই ইতিহাসকে দুমড়েমুচড়ে ভেঙে নিজের মতো করে ইতিহাস লেখেন এবং ঘটনাক্রম সাজান। সেখানে দেশের প্রকৃত ইতিহাস হারিয়ে যায়। কবি শঙ্খ ঘোষের ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতার ভাষা অনুসরণ করে বলা যায়— “আমাদের ইতিহাস নেই/ অথবা এমনই ইতিহাস।”

সত্যি বলতে কী, দেশের প্রকৃত ইতিহাসকে জানতে হলে নিরপেক্ষ দৃষ্টি নিয়ে একাধিক প্রামাণ্য ইতিহাসগ্রন্থ পড়তে হবে। তৎকালীন সমাজব্যবস্থা এবং রাজনীতি সম্বন্ধে চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে। তা হলে সহজেই বোঝা যাবে, সম্রাট ঔরঙ্গজেব রাজ্য পরিচালনার জন্য বহু ক্ষেত্রে পরধর্ম সহিষ্ণুতা দেখিয়েছিলেন। জানা যায়, উজ্জয়িনীর মহাকাল মন্দিরে প্রতি দিন যে ১০৮টি প্রদীপ জ্বালানো হত, তার জন্য প্রতি দিন দুই কিলো করে ঘি লাগত। এই ঘি ঔরঙ্গজেব তাঁর রাজকোষ থেকে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। আবার রাজনীতির প্রয়োজনে খাজনা না দেওয়া এক হিন্দু রাজা তানাশাহকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি তাঁর তৈরি মসজিদ ভাঙতেও দ্বিধা করেননি। শক্তি প্রয়োগ করে সেখান থেকে লুকিয়ে রাখা অর্থ (খাজনা) লুট করে নিয়ে এসে নিজের কোষাগার পূরণ করেছিলেন। কোথাও মাত্রাতিরিক্ত ধর্মপ্রীতি দেখাতে গিয়ে তিনি জিজিয়া করের পুনঃপ্রবর্তন করেন, হিন্দু সভাসদদের হিন্দু রীতিতে অভিবাদন করতে নিষেধ করেন, সমস্ত মুদ্রা থেকে মুসলিম বিশ্বাসের স্বীকারোক্তি মুছে ফেলার নির্দেশ দেন, যাতে অবিশ্বাসীদের দ্বারা অপবিত্র না হয়। সুতরাং, ধর্মের কারণে তিনি কখনও খলনায়ক হয়েছেন, আবার কখনও অপর ধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতা দেখিয়ে এবং রাজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে বেশ কিছু সদর্থক ভূমিকা গ্রহণ করে দূরদর্শিতার পরিচয় রেখেছেন।

বিশ্বরূপ দাস, ইছলাবাদ, পূর্ব বর্ধমান

যন্ত্র-মেধা

স্বাগতম দাসের ‘কী ভাবব, বলবে এআই’ (২৫-৩) প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। যা কিছু নতুন, তার মধ্যেই থাকে বৃহৎ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা। আর এই সম্ভাবনা নিয়েই যন্ত্রমেধার জগৎ হয়ে উঠেছে আমাদের এক কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নলোক। কিন্তু যদি গুগল, মেটা, বা ওপেনএআই-এর মতো স্বল্প কিছু বহুজাতিক সংস্থা সেই স্বপ্নলোকের নিয়ন্ত্রক হয়, তা হলে সেখানে বিপদের সম্ভাবনা বহুমাত্রিক। এই সংস্থাগুলির মালিকরা চাইলেই আমাদের ভাবনাচিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। তাদের হাতেই বন্দি থাকবে আমাদের ‘চিন্তা করার ক্ষমতা’। আমরা কতটুকু জানব, কী নিয়ে ভাবনাচিন্তা করব, আর কী বিশ্বাস করব— সব কিছু তারাই ঠিক করে দেবে। কারণ যে কোনও জটিল যন্ত্র-মেধা তন্ত্রের আউটপুট নির্ভর করে তাকে প্রশিক্ষিত করে তোলার নেপথ্যে কে বা কারা ছিলেন, তার উপরে। আর সেই নেপথ্যের কারিগররা হলেন প্রযুক্তি জগতের দানব-সদৃশ কোনও সংস্থা এবং সেই সংস্থার মালিকপক্ষ। সুতরাং, আমরা কী ভাবব, তার রিমোট কন্ট্রোল যদি এই সব সংস্থার কুক্ষিগত হয়, তা হলে এক দিন আমাদের অবস্থা হবে হীরক রাজার দেশে ছবির যন্তর মন্তর ঘর থেকে বেরোনো প্রজাদের মতো। ভয়টা সেখানেই। অন্য দিকে, কৃত্রিম মেধার সাহায্য পেলে স্বৈরাচারী শাসকদের দৌরাত্ম্য কলেবরে আরও বৃদ্ধি পাবে।

জার্মান বিজ্ঞানী অটো হান এবং ফ্রিটজ় স্ট্রাসম্যান পারমাণবিক বিভাজন আবিষ্কার করেছিলেন। আস্ত একখানা শহরকে কী ভাবে নিমেষে সমতল করে দেওয়া যায়, সেই স্বপ্ন দেখা শুরু হয়েছিল এই আবিষ্কারের হাত ধরেই। নাৎসি বাহিনী গোপনে পরমাণু অস্ত্র তৈরির কাজ চালিয়ে যাচ্ছে, এমন একটি আশঙ্কায় আমেরিকা তড়িঘড়ি ম্যানহাটন প্রোজেক্ট হাতে নিয়েছিল। কিন্তু কার্ল ফ্রিডরিখ ফন ওয়াইসেকার, কার্ল হাইজ়েনবার্গের মতো তাবড় বিজ্ঞানী থাকা সত্ত্বেও জার্মানি পরমাণু বোমা তৈরি করতে পারেনি, কারণ বিজ্ঞানীরা তা চাননি। শোনা যায়, তৎকালীন জার্মান বিজ্ঞানীরা নীতিগত ভাবে চাননি এই বোমা হিটলারের হাতে উঠে আসুক। তেমনই যে সমস্ত প্রযুক্তিবিদের হাত ধরে যন্ত্র-মেধার অবিশ্বাস্য উন্নতি হয়ে চলেছে, তাঁদের শুভবুদ্ধির উপর ভরসা রাখা ছাড়া উপায় নেই।

মানব ক্লোনিং-এর বিপজ্জনক দিক অনুভব করে যেমন মানব ক্লোনিং গবেষণায় রাশ টানা হয়েছিল, তেমনই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো সর্বাধুনিক প্রযুক্তিকে আধিপত্যবাদের হাত থেকে বাঁচাতে বিকেন্দ্রীকরণ করার প্রয়োজন আছে। তাই পৃথিবীর সমস্ত গণতান্ত্রিক সরকার ও সাধারণ মানুষের উচিত এই বিষয়ে সতর্ক থাকা। না হলে আমাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়বে।

অজয় ভট্টাচার্য, বনগাঁ, উত্তর ২৪ পরগনা

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy