পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ‘ট্রাম্প ও ফ্যাসিবাদের ছায়া’ (১৯-৪) প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকেই ইউরোপ জুড়ে ফ্যাসিবাদের সলতে পাকানো শুরু হয়। ১৯২২ সালে ঘুরপথে মুসোলিনি ইটালির প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই ফ্যাসিবাদের যাত্রা শুরু। পরবর্তী কালে নাৎসি জার্মানির হিটলার, জাপানের তোজো প্রমুখ ফ্যাসিস্ট নেতারা বিশ্ব জয়ের উদ্দেশে অশ্বমেধের ঘোড়া ছোটান। দীর্ঘ ২৩ বছর গোটা পৃথিবী, বিশেষ করে ইউরোপের জনগণ ফ্যাসিবাদের ভয়ঙ্কর রূপ প্রত্যক্ষ করেছিলেন। মানব সভ্যতার ইতিহাসে সর্ববৃহৎ যুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিস্ট নেতাদের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ১৯৪৫ সালে ফ্যাসিবাদের মৃত্যু হয়। বিশ্বশান্তির উদ্দেশ্যে গঠিত হয় রাষ্ট্রপুঞ্জ। কিন্তু নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েট ইউনিয়নের পতনের পর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নতুন করে শক্তি বৃদ্ধি করে ফ্যাসিস্ট বা সেমি-ফ্যাসিস্ট শক্তিগুলি। এই শক্তিগুলিকে সমাজ থেকে নির্মূল করার প্রশ্নে বাম, মধ্য বাম, প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল বা সরকারের ব্যর্থতার কারণে পৃথিবীর বেশ কয়েকটি দেশে বকলমে এরাই আজ সরকার চালাচ্ছে।
ইটালির বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি পৃথিবীর অতি দক্ষিণপন্থী রাষ্ট্রপ্রধানদের (ডোনাল্ড ট্রাম্প ও নরেন্দ্র মোদী-সহ) নিয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জের মতো একটি আন্তর্জাতিক মঞ্চ তৈরি করতে চাইছেন। অপর দিকে, উগ্র জাতীয়তাবাদের (মেক আমেরিকা গ্রেট এগেন) উপর ভর করে ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় আসার পর তাঁর একটার পর একটা সিদ্ধান্তে প্রমাণ করে দিচ্ছেন পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী দেশেও এখন ফ্যাসিবাদের ছায়া। শুল্কযুদ্ধের ফলে বদলে যাচ্ছে আমেরিকার সঙ্গে বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক। বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে গত প্রায় ষাট বছর ধরে চলে আসা বিভিন্ন দরিদ্র দেশ, বিশেষত আফ্রিকার দেশগুলির স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে আমেরিকার সাহায্য ‘ইউএসএড’। প্রবন্ধে সঠিক ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে ফ্যাসিবাদীরা এক বার ক্ষমতায় এলে সাংবিধানিক পদ্ধতিতে তাঁদের ক্ষমতাচ্যুত করা যায় না। এখন দেখার বিষয়, আসন্ন ফ্যাসিবাদের রূপ কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে এবং এর থেকে মুক্তি পেতে মানব সভ্যতাকে কতটা মূল্য দিতে হয়।
শেষাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়, ভদ্রেশ্বর, হুগলি
বিপদের আভাস
পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের প্রবন্ধটি নিঃসন্দেহে ভয়ঙ্কর এক ভবিষ্যতের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে আমাদের। লেখক যথেষ্ট মুনশিয়ানার সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পূর্ব ইটালি ও জার্মানির রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মুসোলিনি ও হিটলারের অভ্যুত্থানের বিষয়টি তুলে ধরেছেন। নিজ দেশের জনগণের কাছে ত্রাতার ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে পেরেছিলেন এঁরা। উপরন্তু স্বদেশবাসীকে বিশ্বাস করাতে পেরেছিলেন যে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তাঁদের হারানো মর্যাদা অবশ্যই পুনরুদ্ধার করতে পারবেন। এর সঙ্গে অত্যন্ত সূক্ষ্ম ভাবে মেলানো হয়েছিল উগ্র জাতীয়তাবাদী ভাবনাকে। বিজ্ঞানসম্মত বিচারবোধের স্থান দখল করেছিল অন্ধত্ব। এমনতর পরিস্থিতিতে কমিউনিস্ট দল যথার্থ ভূমিকা পালন করতে পারেনি।
একটি প্রশ্ন স্বাভাবিক ভাবেই মনে জাগে— কোনও দেশে এক বিশেষ নেতার নির্দেশক্রমে সে দেশে কি ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা কায়েম হতে পারে? লেখকের প্রবন্ধ পড়ে এমনটা মনে হয়েছে যে, কট্টর ট্রাম্পের হাত ধরে ওই দেশে ফ্যাসিবাদের জমি মজবুত হচ্ছে এবং তাঁর পতনে বুঝি এর থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে। তা কি ঠিক? তা হলে আজ থেকে কত বছর আগে আমেরিকার তৎকালীন সেক্রেটারি অব স্টেট হেনরি কিসিঞ্জারকে বলতে শোনা গিয়েছিল, ভিয়েতনামে শান্তি মানে আমেরিকার পক্ষে মৃত্যু। বাস্তবে তা-ই। যুদ্ধ বাধানো এবং যুদ্ধাতঙ্ক সৃষ্টির আবহে যুদ্ধাস্ত্র বিক্রি করা— এটাই তো আমেরিকার বেঁচে থাকার, টিকে থাকার একমাত্র রসদ। এই সত্য কে অস্বীকার করবেন? ফলে গণতন্ত্র তার কাছে এখন ভেকমাত্র।
যে গণতন্ত্রের জন্য আমাদের আকুতি, তা কোনও দিন আর ফিরে পাওয়া যাবে না। এক সময় অমানবিক সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা চূর্ণ করতে পুঁজিবাদ এসেছিল প্রগতির জামা গায়ে। সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করেছিল জনগণকে। চালু হল অবাধ বাণিজ্য ব্যবস্থা। যে যে-দিকে পারো যাও, ভোগদখল কায়েম করো। এই পুঁজিবাদের চূড়ান্ত পরিণতি তার সাম্রাজ্যবাদী স্তরে রূপান্তরিত হওয়ার অনিবার্য প্রকাশ, যার পরিণতিতে দু’টি বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকা বিশ্ববাসীকে ভয়ঙ্কর ভাবে আঘাত করেছে। পূর্বের মতো দেশ দখল করা আজ আর নেই, অনুপস্থিত উপনিবেশ গড়ার তীব্র বাসনা। অথচ পুঁজি মুষ্টিমেয় ব্যক্তির কুক্ষিগত, সমগ্র রাষ্ট্রব্যবস্থা তার অধীন। এমতাবস্থায় পূর্বের মতো সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শোষণ অব্যাহত রাখার জন্য নাগরিক মন-জগতে আনা হয়েছে যুক্তিহীনতা আর উগ্র জাতীয়তাবাদী ভাবধারার সঙ্গে ধর্মান্ধতার সূক্ষ্ম মিশেল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে এই জাতীয় বৈশিষ্ট্যসমূহ সারা বিশ্বে ফ্যাসিবাদের ভিত্তি স্থাপন করেছে। এ ফ্যাসিবাদ হিটলার-মুসোলিনির অনুকরণে নয়, সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নতুন ধরনের আগ্রাসন।
আমেরিকায় যে ভূমিকায় ট্রাম্পকে দেখা যাচ্ছে, সে ভূমিকা কি আমাদের দেশের নেতা-নেত্রীদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না? এ দেশে প্রযুক্তির কদর আছে, নেই বৈজ্ঞানিক মনের অনুশীলন। অন্য দিকে, দিনে-দিনে বাড়ছে জনজীবনের হাজার সমস্যা। সে সব থেকে মুক্তির উপায় সম্পর্কে নেতারা সম্পূর্ণ উদাসীন। তাঁরা শুধু ব্যস্ত মানুষে-মানুষে কত ধরনের বিভাজন সৃষ্টি করা যায়, সেই কাজে। প্রবন্ধকার সমস্যার কথা বলেছেন, আশু বিপদের আভাস দিয়েছেন। কিন্তু এই পচাগলা আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার অনিবার্য পতন কী ভাবে সূচিত হতে পারে, সে সম্পর্কে দিশা দেখালে উপকৃত হতাম।
তপন কুমার সামন্ত, কলকাতা-১২
ফলভোগ
নিজেদের পায়ে নিজেরাই কুড়ুল মেরেছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদের নির্বাচকরা। পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের প্রবন্ধটি পড়তে গিয়ে সেই কথাটাই মনে এল। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদের দ্বিতীয় পর্বে ডোনাল্ড ট্রাম্পের উদ্দেশ্যমূলক অস্থির চিত্ততার প্রকাশে ফ্যাসিবাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রবন্ধকারের জিজ্ঞাসার উত্তরে বলতেই হয়, বর্তমানে ওই ভূখণ্ড নিশ্চিত ভাবে ফ্যাসিবাদের কবলে পড়েছে। কিন্তু তা বলবে কে? যাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন, তাঁদের সরিয়ে ট্রাম্প ‘হ্যাঁ-মানুষ’দের দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছেন তাঁর মন্ত্রিসভা। দেশের নাকি এখন জরুরি অবস্থা। কাজকর্মে প্রবল গতি। নিয়ম-রীতি-পদ্ধতি নিয়ে কোনও প্রশ্ন তোলা চলবে না।
২০২৪ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে ‘আমেরিকা প্রথম’-এর যে স্বপ্ন সাধারণ নাগরিককে দেখিয়েছিলেন ট্রাম্প, তাতেই বেশ কিছু দিন সে দেশের মানুষ বুঁদ হয়ে গিয়েছিলেন। এই সুযোগে সরকারি ক্ষেত্রে ব্যাপক কর্মী ছাঁটাই, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির অর্থবরাদ্দ হ্রাস-সহ বিবিধ ক্ষেত্রে সরকারের রক্তচক্ষু ক্রমশ ঘোর কাটিয়েছে তাঁদের। দিকে দিকে শুরু হয়েছে মিটিং-মিছিল। এ দিকে, বিদেশি পণ্যের উপর মোটা হারে শুল্ক বসানোয় সে দেশের নাগরিকরা পড়ছেন মূল্যবৃদ্ধির কবলে। পরিণতিতে আমেরিকান ডলারের উপর আস্থা কমতির দিকে। তা ছাড়া, এশিয়ার দক্ষ ও উন্নত মস্তিষ্কগুলিকে তাড়িয়ে দিলে সে দেশের অগ্রগতি অক্ষুণ্ণ থাকবে তো?
তবে একটি বিষয়ে কৌতূহল হয়। দ্বিতীয় বারের মতো ট্রাম্পকে ক্ষমতায় যাঁরা আনলেন, তাঁরা প্রথম পর্ব এবং তার আগে-পরে খামখেয়ালি এই ফ্যাসিস্ট চরিত্রের কোনও আঁচই কি পাননি? এখন যখন তাঁকে শীর্ষ আসনে বসানো হয়েছে, তখন ফ্যাসিবাদের ফল ভুগতেই হবে আমেরিকানদের। সঙ্গে বাকি বিশ্বকেও।
বিশ্বনাথ পাকড়াশি, শ্রীরামপুর, হুগলি
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)