Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Ashram

সম্পাদক সমীপেষু: আশ্রমের জমি

উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী ও তাঁর সহচরেরা কেন এ সব করছেন, তা বোঝা শক্ত নয়।

শেষ আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০২১ ০২:৩৭
Share: Save:

অমর্ত্য সেনের বাড়ির জমি ‘উদ্ধার’ নিয়ে উপাচার্য ও তাঁর সহচরেরা যে কাজে নেমেছেন, সেটা মূলত চরিত্রহননের কাজ। জমি উদ্ধারের কাজ হলে জমির রেকর্ড দেখিয়ে বিশ্বভারতী তাঁকে একটা উকিলের চিঠি পাঠাত, তার পর জেলা আদালতে মামলা করত। শান্তিদেব ঘোষের উত্তরাধিকারীদের কোনও চিঠি পাঠানো হয়নি। কিন্তু আশ্রমিকদের কাছে উপাচার্য দাবি করেছিলেন বাড়িটা বিশ্বভারতীকে দান করতে হবে। এ সব ওঁদের পরিচিত কায়দা। অবাক হব না যদি শুনি যে, কেউ বা কারা গিয়ে অমর্ত্য সেনের বাড়ির বেড়া ভেঙে দিয়েছে।

উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী ও তাঁর সহচরেরা কেন এ সব করছেন, তা বোঝা শক্ত নয়। তাঁদের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিপত্তি বিশ্বভারতী-শান্তিনিকেতনে বিস্তার করতে গেলে আশ্রমিকগণ, বৃহত্তর জনসমাজ, শান্তিনিকেতনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উত্তরসূরিরা, এবং সেই ঐতিহ্যের অত্যন্ত শক্তিশালী ও প্রভাবশালী প্রবক্তাগণ তাঁদের অন্তরায়। তবে প্রধান অন্তরায় শান্তিনিকেতন ও রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃতি। শুধু একটা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় যে জমিতে অবস্থিত, সেই এলাকা নয় বিশ্বভারতী-শান্তিনিকেতন। তার আসল জমি সেই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, যা দুই বাংলার কয়েক কোটি মানুষকে ১০০ বছর ধরে বহু ভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। উপাচার্য ও তাঁর সহচরেরা আসলে সেই জমিকে ধ্বংস করে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সেই সাংস্কৃতিক জমি থেকে বিচ্যুত করার কাজে নেমেছেন।

শান্তিনিকেতন বিশ্বভারতীতে রাজনীতি আগেও হয়েছে। দলীয় রাজনীতির প্রভাব থেকে বিশ্বভারতী কেন, বেশির ভাগ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ই মুক্ত থাকতে পারেনি। কিন্তু এখন যে রাজনীতি চলছে তার বৈশিষ্ট্য হল, তা নিযুক্তি, প্রোমোশন, বিশেষ পদ, বদলি, বা কিছু অনুদান পাইয়ে দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এটা একটা সাংস্কৃতিক রাজনীতি, এর উদ্দেশ্য অনেক গভীর এবং বিপজ্জনক। এর বিরুদ্ধে জনসমাজের প্রতিবাদ করার দরকার আছে।

অশোক সরকার, কলকাতা-৯৯

ইতিহাসের লিখন

অনির্বাণ সরকার তাঁর দীর্ঘ চিঠিতে (‘গাত্রগাহের কারণ’, ৩০-১২) শান্তিনিকেতন আশ্রমিক সংঘের সঙ্গে বিশ্বভারতীর মতবিরোধ তুলে ধরেছেন। জনসংযোগ আধিকারিক বিশ্বভারতী মুখপাত্র, তিনি কর্তৃপক্ষের বক্তব্য উপস্থাপিত করবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাঁর ভাষায় প্রথম থেকেই এমন একটি আক্রমণাত্মক ভঙ্গি ধরা পড়েছে (যথা, প্রাক্তনীরা বিশ্বভারতীকে ‘শোষণ’ করছেন, হবিষ্যান্ন খেতে তাঁদের ‘হ্যাংলাপনা’ দেখা যাচ্ছে প্রভৃতি), যা কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধির কাছে প্রত্যাশিত নয়। সর্বোপরি, তিনি সম্ভবত ঠিক সেইটুকুই সংবাদমাধ্যমে বলতে পারেন, যা এ বিষয়ে তাঁদের আলোচনাসভার বিবরণীতে (মিনিট্স-এ) লিপিবদ্ধ আছে। যে সব মন্তব্য তিনি করেছেন, তা তিনি ব্যক্তি হিসেবে লিখতে পারেন, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখপাত্র হিসেবে পারেন কি? তিনি তা করেছেন সম্ভবত এই বিশ্বাস থেকেই যে, তিনি জানেন তাঁর পিছনে কোনও বড় শক্তির বরাভয় আছে। এই শক্তি প্রদর্শন, ভিন্ন মতের মানুষদের প্রতি এই সুস্পষ্ট অবজ্ঞা কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পক্ষেই কাম্য নয়। বিশ্বভারতীর স্বকীয় চরিত্রের বিরোধী তো বটেই।

মন্তব্যগুলি পড়লে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, বিশ্বভারতীর বর্তমান পরিচালকেরা প্রাক্তনীদের এক দল দায়িত্বজ্ঞানবর্জিত মানুষ হিসেবেই দেখেন, যাঁরা ঐতিহ্য রক্ষার নামে বিশ্ববিদ্যালয়কে এত দিন ‘শোষণ’ করে এসেছেন। জানি না এঁরা ব্রহ্মচর্যাশ্রম স্থাপন থেকে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃত হওয়ার ইতিহাস জানেন কি না, না কি সেটা জেনেও সরকারি ক্ষমতা ব্যবহার করে প্রাক্তনীদের শায়েস্তা করার নেশায় মেতেছেন।

অনির্বাণবাবু যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফ থেকে লিখিত ভাবে কথাগুলি বলেছেন, তখন কিছু প্রশ্নের জবাব তাঁর দেওয়া উচিত। প্রথমত, প্রাক্তন উপাচার্যদের আমলে যে অনুষ্ঠানগুলি করা হয়েছে, অর্থাভাবে তা বন্ধ করতে হচ্ছে— আজ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এহেন আর্থিক দুরবস্থা কেন? দায় কার? যে কর্তৃপক্ষ আশ্রমিক সংঘকে তাদের কর্তব্য মনে করিয়ে দেওয়ায় তৎপর, তাঁরা কেন্দ্রীয় সরকারকে দায়িত্ব মনে করিয়ে দিতে ব্যর্থ কেন? অনির্বাণবাবু লিখেছেন, পৌষমেলার উদ্বৃত্ত অর্থেই এই সব অনুষ্ঠানের অর্থসংস্থান করা হয়ে থাকে। তা হলে গত বছরের উদ্বৃত্ত কোথায় গেল? প্রাক্তনীদের জানানো হচ্ছে যে, আশ্রম প্রাঙ্গণের কোথাও তাঁরা নিজেদের আয়োজনে অনুষ্ঠান করলেও টাকা দিতে হবে। তা হলে তাঁরা বিশ্বভারতীর মধ্যে অবস্থিত উপাসনাগৃহের সংস্কারে অর্থ দেবেন কেন? সেই আশ্রমে নিজের বাড়িটি থাকার জন্য তো অমর্ত্য সেনকেও দখলদারির অভিযোগ শুনতে হচ্ছে।

এই আশ্রমিকরা, তাঁদের পিতৃপুরুষরা প্রায় প্রত্যেকে এক মহৎ আদর্শের সঙ্গে যুক্ত থাকার আনন্দে অনেক লোভনীয় পেশা ছেড়ে এখানে অতি সামান্য পারিশ্রমিক নিয়ে শ্রমদান করেছেন। প্রমথনাথ বিশী থেকে শুরু করে অনেক আশ্রমিকের লেখায় তা অমর হয়ে আছে। সেই সম্মান তাঁরা অদ্যাবধি পেয়েও এসেছেন। আজ যদি সরকারি ক্ষমতার জোরে তাঁদের ‘স্বার্থান্ধ’ বলা হয়, নানা ভাবে বিতাড়িত করা চলতে থাকে, তা হলেও ইতিহাস বদলাবে না। বরং যাঁরা তা করবেন, তাঁরা সে ভাবেই ইতিহাসে অন্তর্ভুক্ত হবেন।

শুভেন রায়, কলকাতা-৫০

কে ‘রাবীন্দ্রিক’

বিভিন্ন লেখাপত্রে যে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে, তাতে মনে হচ্ছে শুরুতে বিশ্বভারতী যা ছিল, আজও তেমনই থাকবে। অর্থাৎ, ইতিহাসের চাকাকে এখানে অচল করে দিতে হবে। এই ভাবনা যে অবান্তর, তা বোঝাতে গুরুদেব তাঁর বিশ্বভারতী পুস্তিকায় বলেছেন যে, “কালের নিয়মে সব পরিবর্তনশীল। আমার প্রেরিত আদর্শ নিয়ে সকলে মিলে একতারা যন্ত্রে গুঞ্জরিত করবেন এমন অতি সরল ব্যবস্থাকে আমি নিজেই শ্রদ্ধা করি নে।”

বহু মানুষের নিঃস্বার্থ প্রচেষ্টায় তৈরি হয়েছিল বিশ্বভারতী। কিন্তু আজকের বিশ্বভারতীর তথাকথিত রাবীন্দ্রিক বা আশ্রমিকরা দুঃখিত, কারণ তাঁদের ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি হচ্ছে না প্রশাসনিক তৎপরতার ফলে। অবশ্য বিশ্বভারতী যে স্বার্থসিদ্ধির সোপান, সেটা গুরুদেবও বুঝেছিলেন। তাই তিনি মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ পুস্তিকায় লিখলেন যে, “আশ্রমের এই সুদীর্ঘ ৫০ বছরের ইতিহাসে আমাকে শোক, ক্ষতি সহ্য করতে হয়েছে। দেশের লোকের ঔদাসীন্য ও কুৎসা থেকে আমি নিষ্কৃতি পাই নি। এই প্রতিষ্ঠান চালাতে গিয়ে আমাকে সব সহ্য করতে হয়েছে।” জীবনের প্রায় শেষপ্রান্তে গুরুদেব বলেছিলেন, “আমার দেহ আজ অপটু, কিন্তু ছুটে চলেছে সেই পুরাতন কল্যাণের আদর্শ ধরে। ইচ্ছে করছে, আবার সকলের সঙ্গে মিলে কাজে লেগে যাই।” এর থেকে স্পষ্ট হয়, ‘রাবীন্দ্রিক’ বলতে কী বোঝা উচিত? তিনি বিশ্বাসী ছিলেন কঠোর পরিশ্রম স্বীকারে, যাতে সমাজের এক জনকেও তার আবশ্যক অস্তিত্বরক্ষার সংগ্রামে পরাভব স্বীকার করে নিতে না হয়। যার থেকে এই কথাটা দাঁড়ায় যে, তাঁর ভাবনার কেন্দ্রে ছিল অন্যের জন্য বাঁচার আদর্শ। তিনি বল্লভপুরে দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করেন। সাঁওতাল মেয়েদের বয়নশিল্পের কাজে প্রশিক্ষিত করে তোলা হয়। লক্ষ্য ছিল আত্মনির্ভরশীলতার অভিমুখে সবাইকে শামিল করা। তিনি বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়ের মানুষকে এই ধারণার অন্তর্গত করতে বিশেষ সচেষ্ট হতেন। তাঁকে অনুসরণ করলে বুঝতে পারি, ‘রাবীন্দ্রিক’ বলতে যা বোঝায়, তার থেকে গোষ্ঠীস্বার্থবুদ্ধি আমাদের দিগ্ভ্রষ্ট করে। গুরুদেব এই মন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন, “আয় তবে সহচরী, হাতে হাতে ধরি ধরি/ নাচিবি ঘিরি ঘিরি, গাহিবি গান।” এই জন্যই আমি মনে করি রবীন্দ্রনাথ একটি ‘আদর্শ স্বর’-এর নাম, যিনি মানুষের কল্যাণের জন্য নিরন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও প্রচেষ্টা করে গিয়েছেন। যেন তেন প্রকারেণ স্বার্থসিদ্ধির জন্য গুরুদেবের নাম নেওয়া কাম্য নয়।

অনির্বাণ সরকার, জনসংযোগ আধিকারিক, বিশ্বভারতী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Ashram Land plot Letters to Editor
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE