Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

সম্পাদক সমীপেষু: সেই কান্না আবার

আমাদের দু’জনের সামনে ভেসে উঠল ২০১৭ সালের ৩১ জুলাই। আমাদের একমাত্র সন্তানকে কৃত্তিকার মতো একই ভাবে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল।

প্রতীকী চিত্র।

প্রতীকী চিত্র।

শেষ আপডেট: ০৪ জুলাই ২০১৯ ০০:০৮
Share: Save:

আমি এক জন গৃহবধূ, আমার স্বামী উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী। আমরা দু’জনে অনেক কষ্ট করে বেঁচে থাকার, ভাল থাকার এবং ভুলে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু ২২ জুনের আনন্দবাজার পত্রিকা আমাদের আবার দাঁড় করিয়ে দিল বারাসত হাসপাতালের মর্গের সামনে, যেখানে একরাশ এলোচুলে শোয়ানো ছিল আমার তিন্নির নিথর দেহ, মনে করিয়ে দিল ৩১ জুলাই ২০১৭-র ঘটনাকে। ২২ জুনের আনন্দবাজারের প্রথম পাতা দেখে আমার সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল আর চোখ আটকে গেল একটা নির্দিষ্ট জায়গায়, যেখানে লেখা: ‘‘মুখে প্লাস্টিক, স্কুল ছাত্রীর মৃত্যুতে রহস্য’’, অনেক বার চশমার কাচ মুছে লেখাটা পড়ে শেষ করলাম। আমার মনে হল, একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি! আমার স্বামীকে লেখাটা দেখালাম। সে দিন আমরা দু’জনে শত চেষ্টা করেও নিজেদের চোখের জলকে আটকে রাখতে পারলাম না।

আমাদের দু’জনের সামনে ভেসে উঠল ২০১৭ সালের ৩১ জুলাই। আমাদের একমাত্র সন্তানকে কৃত্তিকার মতো একই ভাবে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল। আমার মেয়ের মৃত্যুর ঘটনা ওই বছর ২ অগস্ট আনন্দবাজারে প্রকাশিত হয়েছিল। আমার মেয়ের নাম ছিল কৌশিকী দে, ও বারাসতে একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী ছিল। পড়াশোনা ছাড়াও আমার মেয়ের আঁকা, নাচ, আবৃত্তি, এ সব বিষয়ে খুব উৎসাহ ছিল। কবিতা ও গল্প লিখতে খুব ভালবাসত। কাকতালীয় ভাবে কৃত্তিকার মতো আমার মেয়ের বাড়ির নাম ছিল তিন্নি, ওর বয়সও ছিল চোদ্দো বছর।

আমার স্বামীর অসুস্থতার কারণে দীর্ঘ দিন আমাদের ভেলোরে থাকতে হয়। ডাক্তারেরা বলেছিলেন, আমার স্বামীর লিভার প্রতিস্থাপন করতে হবে। আমার মেয়ের যাতে পড়াশোনার ক্ষতি না হয়, তাই ওকে আমরা আমাদের বারাসতের ফ্ল্যাটে, ওর ঠাম্মি, মানে আমার শাশুড়িমা’র কাছে রেখে গিয়েছিলাম। আমার মা মাঝেমধ্যে আমার মেয়ের কাছে এসে থাকতেন। আমরা মাঝেমধ্যে ডাক্তারের অনুমতি নিয়ে আমাদের মেয়ের কাছে চলে আসতাম।

এ ভাবে একটা বছর যাওয়ার পর, আমি জানতে পারলাম, আমার মেয়ের মধ্যে কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। এক দিন আমার শাশুড়িমা’র কাছে শুনলাম, ও নাকি নতুন একটা খেলা শিখেছে। সেটা হল— মুখে প্লাস্টিক দিয়ে গলায় ওড়না জড়িয়ে দেখতে হবে, কত ক্ষণ অক্সিজেনকে আটকে রাখা যায়। এই খেলাটা আমার মেয়ে আমার শাশুড়িমা’র সঙ্গে খেলেছে। ঠাম্মি অসুস্থ বোধ করায়, প্লাস্টিক তাড়াতাড়ি খুলে দিয়েছে। এই ঘটনা শাশুড়িমা আমাকে ফোনে জানানোর পর, আমি ফোনে আমার মেয়ের সঙ্গে কথা বলে ওকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, এই খেলা কতখানি মারাত্মক হতে পারে। এই ধরনের খেলা কোথা থেকে শিখেছে, তাও জিজ্ঞাসা করেছিলাম। কিন্তু ও আমার প্রশ্নের ঠিকমতো উত্তর দেয়নি। আমাদের অনুমান, বন্ধুদের কাছ থেকেই শিখেছিল। কারণ, ওর কাছে কোনও স্মার্টফোন ছিল না। এর পর আমি আমার বাপের বাড়িতে ফোন করে সব জানাই। কিছু অস্বাভাবিক আচরণের জন্য ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। ডাক্তারবাবু বলেন, শরীরে কোনও সমস্যা নেই। উনি আমার মেয়েকে এই ধরনের খেলা খেলতে বারণ করেন। ওর এই খেলার কথা আমরা জানতে পারি ওর মৃত্যুর ঠিক আগের দিন। অর্থাৎ ৩০ জুলাই। ৩১ জুলাই দুপুরবেলা, যখন আমার মা ও শাশুড়িমা ঘুমিয়ে পড়েছেন, ঠিক তখনই সকলের বারণ সত্ত্বেও আবার সেই একই খেলা খেলতে গেল, মুখে প্লাস্টিক দিয়ে গলায় ওড়না জড়িয়ে আমার ঠাকুরের সিংহাসনের নীচে আমার মেয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। চিরদিনের মতো আমাদের ছেড়ে চলে গেল। সে দিন আমার দেওয়া দিব্যিও ওকে এই নেশার খেলা থেকে বিরত রাখতে পারল না। তাই কৃত্তিকার মৃত্যুর খবর পড়ে আমার মনে হল, আমার তিন্নিরই আবার মৃত্যু হল। কিন্তু কেন প্রতি বছর তিন্নিদের পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে?

কৃত্তিকার মৃত্যু আদৌ কি আত্মহত্যা, না নেটের একটা মারণখেলা? কেন কৃত্তিকা তিন মাস ঘুমোতে পারেনি? কেনই বা ওকে আতঙ্কে থাকতে হয়েছে? আমার মেয়ের মৃত্যু কিন্তু আত্মহত্যা ছিল না। মৃত্যুর ঠিক আগের দিন ওর সঙ্গে কথা বলে আমরা সেটা বুঝেছিলাম। ছেলেমানুষি ও অপরিণত বুদ্ধি ওকে এই খেলায় মাতিয়েছিল। এটা ছিল নেটের একটা মারণখেলা। ২০১৭ সালে আমার মেয়ের মৃত্যুর কিছু দিন পরেই প্রচারমাধ্যমের দৌলতে ‘ব্লু হোয়েল’ নিয়ে হইচই শুনতে পেলাম। শুনলাম চারিদিকে প্রচুর ছেলেমেয়ে মারা যাচ্ছে। আমার মেয়ের মতো একই ভাবে মেদিনীপুরের একটি ছেলে বাথরুমের মধ্যে মারা গিয়েছে। সেই খবরও টিভিতে শুনলাম। এর পর নেট ঘেঁটে আমরা জানতে পারলাম, আমার মেয়ে যে খেলাটা খেলেছে তার নাম ‘চোকিং গেম’। কৃত্তিকার মতো আমার মেয়ে কোনও সুইসাইড নোট লিখে রেখে যায়নি। ময়না তদন্তের রিপোর্টেও আমরা খারাপ কিছু পাইনি, ওর শরীরে কোনও ক্ষত ছিল না, শ্বাসরোধ হয়ে ওর মৃত্যু হয়েছে। ভগবান আমাদের ওকে রক্ষা করার কোনও সুযোগ দিলেন না। আমরা সব জেনেও কিছু করতে পারলাম না।

আমি জানি না কারা এই ধরনের মারাত্মক খেলা শেখাচ্ছে। তারা আসলে কী চায়? বাবা, মায়ের কাছ থেকে সন্তানকে কেড়ে নিয়ে তাদের কী লাভ? আমার অনুরোধ, স্কুল কর্তৃপক্ষ, অভিভাবকদের এবং সমাজের সকলের মিলিত চেষ্টায় এই ধরনের মারণখেলা বন্ধ করা হোক। আগামী প্রজন্ম বাঁচতে চায়। ওদের চোখে অনেক স্বপ্ন। কিন্তু অপরিণত বুদ্ধি ওদের ভুল রাস্তায় যেতে বাধ্য করে। সকলের মিলিত চেষ্টায় ছেলেমেয়েরা যেন ঠিক পথের সন্ধান পায়। তারা যেন সুস্থ এবং সুন্দর দীর্ঘ জীবন লাভ করে।

কাকলী দে

কলকাতা-১২৬

টিবি-মুক্ত দেশ

২০২৫ সালের মধ্যেই টিবি রোগ মুক্তির লক্ষ্যমাত্রা রেখেছে ভারত। ইতিমধ্যেই রোগটিকে নোটিফিকেশনের আওতায় আনা হয়েছে। দেশের প্রত্যেকটি টিবি রোগীর রোগ, রোগনির্ণয় পদ্ধতি এবং চিকিৎসা বিষয়ক যাবতীয় তথ্য যাতে সরকারের কাছে থাকে— এটাই এই প্রচেষ্টার প্রাথমিক উদ্দেশ্য।

টিবি রোগের ভয়াবহতা এবং জটিলতার জন্য পরোক্ষ ভাবে আমরাই দায়ী। নির্দিষ্ট নির্দেশিকা মেনে চিকিৎসা না করা, পুরো কোর্সের ওষুধ না খেয়ে মাঝপথেই চিকিৎসা বন্ধ করে দেওয়া, রোগীর আশেপাশে যারা আছে তাদের মধ্যে— বিশেষত বাচ্চাদের মধ্যে রোগটি ছড়িয়েছে কি না সে দিকে খেয়াল না রাখা, এই সব কারণে আজকের ভয়াবহ পরিস্থিতি।

সরকারি ব্যবস্থায় কিছু নজরদারি এবং নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা থাকলেও, বেসরকারি ক্ষেত্রে গোটা বিষয়টিই ছিল লাগামছাড়া। নিয়ন্ত্রণ এবং সমন্বয় সাধনের কথা মাথায় রেখে, সরকারি এবং বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রেই টিবি নোটিফিকেশন বাধ্যতামূলক করা হয় ২০১২ সালে।

কিন্তু তা সত্ত্বেও বেসরকারি স্তরের বিপুল সংখ্যক রোগীর নাম সরকারি ভাবে নথিভুক্ত না হওয়ায়, কেন্দ্রীয় সরকার ২০১৫ সালে একটি গেজ়েট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে সরকারি আদেশনামা খেলাপকারী চিকিৎসক, ওষুধ ব্যবসায়ী, স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা করার বিধান আনে। যাতে ৬ মাস থেকে ২ বছর পর্যন্ত কারাবাস বা জরিমানা বা দুই-ই হতে পারে।

যাঁদের টিবির চিকিৎসা শুরু করা হয়, তাঁদের মধ্যে বেশ কিছু রোগী মাঝপথে চিকিৎসা ছেড়ে দেন, কিছুতেই এঁদের চিকিৎসায় ফিরিয়ে আনা যায় না। এঁরা সমাজের পক্ষে ভীষণ ক্ষতিকারক। এঁরা নিজেরা তো সুস্থ হনই না, উপরন্তু রোগটিকে আশেপাশে ছড়াতে থাকেন। এখান থেকেই তৈরি হয় মাল্টি ড্রাগ রেজ়িস্ট্যান্ট (বহু ওষুধ প্রতিরোধী) টিবি রোগ, যা এক বড় স্বাস্থ্য সমস্যা।

প্রশ্ন উঠতেই পারে, সংক্রামক রোগ হয়েছে জানা সত্ত্বেও ঠিক চিকিৎসা না করালে (যেখানে সরকারি ভাবে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার ব্যবস্থা সহজলভ্য), তাঁদের চিকিৎসা নিতে বাধ্য করানোর জন্য কোনও আইন করা যায় কি না। টিবি-মুক্ত ভারত গড়তে হলে ভাবনাটা কিন্তু জরুরি।

দেবব্রত রায়

রায়গঞ্জ, উত্তর দিনাজপুর

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE