Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
TMC

সম্পাদক সমীপেষু: গা-সওয়া দুর্নীতি

২০১৬ সালে রাজ্য বিধানসভা ভোটের মুখে তৃণমূল সরকার সম্পর্কে অনেককে বলতে শোনা গেছে, “খেয়েছে মানছি, কিন্তু কাজও করেছে।”

দুর্নীতি বিষয়ে তৃণমূলের পতন ঘটানো কঠিন।

দুর্নীতি বিষয়ে তৃণমূলের পতন ঘটানো কঠিন।

শেষ আপডেট: ২১ অগস্ট ২০২২ ০৪:৩৯
Share: Save:

ঈশানী দত্ত রায় (‘আমি তো এমনি এমনি খাই’, ৬-৮) ঠিকই লিখেছেন, “আসলে খেলে আপত্তি নেই, বেশি খেয়ে বদহজম হয়ে যাওয়ায় আমাদেরও হজম করা মুশকিল হয়ে পড়েছে।” দুর্নীতি নিয়ে আমরা মাথা বিশেষ ঘামাই না। কারণ, তা গা-সওয়া হয়ে গেছে। সরকার তো তাকেই বলে যার শাসনক্ষমতা আছে এবং একই সঙ্গে ক্ষমতা অপব্যবহারের ক্ষমতা আছে। সে কারণে নেতামন্ত্রীরা দুর্নীতি করেও পার পেয়ে যান, কারাবাসের পরেও ভোটে জিততে কোনও বেগ পেতে হয় না তাঁদের। ২০১৬ সালে রাজ্য বিধানসভা ভোটের মুখে তৃণমূল সরকার সম্পর্কে অনেককে বলতে শোনা গেছে, “খেয়েছে মানছি, কিন্তু কাজও করেছে।” বছরখানেক আগেও যে কথা শোনা গিয়েছে তা হল, “দিদি ভাল, দিদির চার পাশের বদলোকদের জন্যই সরকারটার বদনাম হচ্ছে।” যদিও পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি থেকে বিপুল টাকা উদ্ধারের পর লোকে অন্য রকম বলতে শুরু করেছে। মানুষের ক্ষোভ, ঘৃণা এত বেড়েছে, জনরোষের ভয়ে এলাকার ঘুষখোর তৃণমূল নেতাদের কেউ কেউ গা-ঢাকা দিচ্ছেন।

তবে এক-দু’জন নেতামন্ত্রী জেলে গেলেই তো মানুষ সরকার বদলানোর কথা ভাবে না। দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে ঝড় তুলতে পারলে অবশ্য সরকার বদলায়। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ভি পি সিংহ দুর্নীতির বিরুদ্ধে তুমুল লড়াই করেই রাজীব গান্ধী সরকারের পতন ঘটিয়েছিলেন। সমাজকর্মী অণ্ণা হজারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইকে তুঙ্গে পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন বলেই ইউপিএ-২ সরকারের পতন ঘটেছিল। এ রাজ্যে তেমন কোনও আন্দোলন গড়ে ওঠার সম্ভাবনা কোথায়? সারদা-রোজ়ভ্যালি কাণ্ডের পরেও তো তৃণমূল ভোটে জিতে সরকার গড়েছিল। আজ বিজেপি অন্তঃকলহে দীর্ণ একটি দল। সিপিআইএম দলে আজ আর কোনও ডাকাবুকো নেতা নেই। দুর্নীতি বিষয়ে তাই এই তৃণমূল সরকারের পতন ঘটানো কঠিন।

শিবাশিস দত্ত, কলকাতা-৮৪

আলকাতরার গুণ

ঈশানী দত্ত রায় তাঁর মনোজ্ঞ রচনায় জনসাধারণের মনের কথা ব্যক্ত করেছেন। তাঁর গায়ে বিরোধী দলের কালি ছিটোনোর অপচেষ্টার জবাবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আমার হাতেও আলকাতরা আছে’— এই উক্তিকে উদ্ধৃত করে লেখিকা আলকাতরার গুণাগুণের উল্লেখ করেছেন। প্রায় এক দশক ধরে স্কুলশিক্ষকদের মেধাতালিকায় দুর্নীতি নিয়ে ধর্না অবস্থান ও তার পর মামলা হয়েছে এবং নেতাদের টাকার বিনিময়ে চাকরি বাধাহীন ভাবে চলে এসেছে। যত ক্ষণ না কোর্টের হস্তক্ষেপে তথ্য সামনে এসেছে, শাসক দল ‘চক্রান্ত’ বলে ধামাচাপা দেওয়ার অপচেষ্টা করে গিয়েছে। অজস্র দুর্নীতি জড়িয়ে আছে রেশনের চাল, হাসপাতালের বেড পাওয়া, রাস্তাঘাট, সরকারি প্রকল্প, কলেজে ভর্তি, স্কুলের চাকরি বা বদলি নিয়ে। খুদে নেতারা কুঁড়েঘর থেকে অট্টালিকা বানিয়ে ফেলেছেন। মুখ্যমন্ত্রীর চোখে তা ধরা পড়েনি। বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন— “চক্ষের ন্যায় প্রবঞ্চক কেহ নহে। যে সূর্য্যের পরিমাণ লক্ষ লক্ষ যোজনে হয় না, তাহাকে একখানি স্বর্ণথালির মত দেখি।... যে চন্দ্রের দূরতা সূর্য্যের দূরতার চারি শত ভাগের এক ভাগও নহে তাহা সূর্য্যের সমদূরবর্ত্তী দেখায়।... এই অবিশ্বাস-যোগ্য চক্ষুকেই আমাদের বিশ্বাস।” এই চক্ষুই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদকে বিপথে চালিত করেছে।

জহর সাহা, কলকাতা-৫৫

যন্ত্রণার জলছবি

উপস্থাপনার গুণে ঈশানী দত্ত রায়ের প্রবন্ধ ‘আমি তো এমনি এমনি খাই’ নিঃসন্দেহে রসগ্রাহী হয়ে উঠেছে। ২০২২ সালের জুলাই মাসটা এ রাজ্যের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাসে এক কলঙ্কিত অধ্যায় হয়ে থাকবে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ এর আগেও, বিশেষত বাম-আমলে অনেক কেলেঙ্কারির সাক্ষী থেকেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক যে আর্থিক দুর্নীতির ছবি রাজ্যবাসী প্রত্যক্ষ করল, তা সব কিছুকে ছাপিয়ে গেছে। দুর্নীতির প্রশ্নে আমাদের হেভিওয়েট নেতা-মন্ত্রীরা অন্য রাজ্যের উদাহরণ দিতে অভ্যস্ত। মধ্যপ্রদেশের ব্যপম কেলেঙ্কারি এবং হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশের শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির প্রশ্নে এক সুরে প্রতিবাদ জানিয়েছেন ওঁরা। কিন্তু সাম্প্রতিক আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা সমগ্র রাজ্যবাসীর কাছে লজ্জা হয়ে রইল।

তৃণমূলের বড় পুঁজি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাবমূর্তি। কিন্তু তৃণমূল ক্ষমতায় আসা থেকে যখন একের পর এক বিদ্ধ হয়েছে মধ্যশিক্ষা পর্ষদ, স্কুল সার্ভিস কমিশন, প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ, তখন আগে থেকেই সতর্ক হননি মমতা। শিক্ষাক্ষেত্রে এক জন অযোগ্য প্রার্থী এক যোগ্য প্রার্থীকে বঞ্চিত করার অর্থ পরবর্তী দুই প্রজন্মের পড়ুয়াদের শিক্ষাগত দক্ষতার অবনমন ঘটে যাওয়া। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী সাহসের সঙ্গে লড়াই করে সিপিআই (এম) তথা বামফ্রন্ট সরকারকে ক্ষমতার চূড়া থেকে নামিয়ে এনেছিলেন। ‘বিজেপিকে একটি ভোটও নয়’ স্লোগান তুলে একক প্রচেষ্টায় লড়াই চালিয়ে ফ্যাসিস্ট দলটিকে কার্যত কোণঠাসা করতে পেরেছেন। অথচ, এই মুহূর্তে তিনিই যে মারাত্মক ভাবে ব্যাকফুটে, তা বোঝার জন্য বড় রাজনীতিবিদ হওয়ার প্রয়োজন নেই।

শক্তিশঙ্কর সামন্ত, ধাড়সা, হাওড়া

কিছুই দেখিনি

তপন সিংহের আতঙ্ক ছবির একটি দৃশ্যে বয়স্ক মাস্টারমশায় তাঁর এক ছাত্রকে অন্য এক ছাত্র খুন করল, এটা চোখের সামনে দেখে ফেলেন। খুনি ছাত্রটি এগিয়ে এসে ঠান্ডা চোখে হুমকি দেয়, “মাস্টারমশায় আপনি কিন্তু কিছুই দেখেননি।” এ অন্যায় মানতে না পেরে যত বার তিনি থানার পথে পা বাড়ান, ছাত্রটি সামনে এসে বলে, “আপনি কিন্তু কিছুই দেখেননি।” আমাদের রাজ্যবাসীর এখন অনেকটা সে রকমই অবস্থা। চাষি ফসলের দাম পাচ্ছেন না, কলকারখানার অস্তিত্ব লোপ পেতে বসেছে, চাকরি অযোগ্যদের কাছে বিক্রি হয়ে গেছে, ঘুষের টাকার পাহাড়ে নেতারা বসে রয়েছেন। মানুষ কি কিছুই দেখেনি? অবশ্যই দেখেছে, আমপান-ইয়াসের টাকা যাঁদের ঘর ভেঙেছে তাঁরা পাননি, নেতাদের দোতলার পরে তিনতলা উঠেছে। আবাস যোজনা, একশো দিনের কাজের টাকা চলে যাচ্ছে শাসক দলের নেতাদের অ্যাকাউন্টে। ঘর সংসার ফেলে পরিযায়ী শ্রমিকের স্রোত চলে যাচ্ছে অন্য রাজ্যে। দেশের বড় নেতা বলেছিলেন, খেতে দেব না, খাব না। অথচ, তাঁর বন্ধুরা খেয়েদেয়ে বিদেশে পগারপার, আর পেট্রল-ডিজ়েল-রান্নার গ্যাস, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়ে দেশবাসীর আর হাঁড়ি চড়ে না।

শিখা সেনগুপ্ত, বিরাটি, উত্তর ২৪ পরগনা

উন্মত্ত লালসা

একটি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠের হেফাজতে কাঁড়ি, কাঁড়ি টাকা, সোনা উদ্ধার হওয়া সত্ত্বেও সেই গণতন্ত্রের ধ্বজাধারীরা যদি কালিমামুক্ত হওয়ার অপরিসীম চেষ্টা চালিয়ে যায়, আলকাতরা লেপনের ভীতি প্রদর্শন করেন, তা হলে প্রবন্ধকার বর্ণিত আলকাতরার উপকারিতা উপলব্ধি করা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। এক কালে রাজনীতিতে শামিল হওয়া ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর তুল্য ছিল। এখন ক্ষমতার লালসায় উন্মত্ত হয়ে শুধুই নিজের সম্পদ বৃদ্ধির অপচেষ্টা! আর একটা বিষয়, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অংশীদার আরও অনেকেই থাকে, তারাও এই দুর্নীতির সঙ্গে ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায়, অবধারিত ভাবে সম্পৃক্ত হয়। একটি মহীরুহের গোড়ায় পচন ধরলে কি তার কান্ডগুলি সজীব থাকে? প্রবন্ধকার যথার্থই বলেছেন ক্ষমতার দম্ভ মানুষকে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য করে তার মধ্যে ফ্যাসিবাদী চিন্তার উদ্রেক করে। ‘আমিই শেষ কথা’ এই মনোভাব গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধাচরণ!

সুবীর ভদ্র, ডানকুনি, হুগলি

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

TMC Corruption
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE