Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
Bengali Language

সম্পাদক সমীপেষু: কেন এই আত্মকরুণা

বর্তমানে বিশ্বায়ন, তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লবের প্রবল প্রতাপে জীবন জীবিকার অছিলায় বাংলাকে ব্রাত্য করে ‘ঔপনিবেশিক সমীহ’-র ধারা বহন করতে বাঙালি আত্মশ্লাঘা বোধ করে।

—প্রতীকী চিত্র।

শেষ আপডেট: ১২ মার্চ ২০২৪ ০৬:২২
Share: Save:

অমিতাভ গুপ্তের ‘বাঁচান বাঁচি, মারেন মরি’ (২৫-২) প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু বক্তব্য। বাঙালির আত্মপরিচয়ের অনেকটাই দাঁড়িয়ে আছে তার মাতৃভাষা বাংলার উপর। বাংলা ভাষার বৈচিত্রকে সামাজিক জীবনে বরণ করে নিলে বাঙালির ভাষাগর্ব সার্থক হত। এ-পার বাংলার বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার সঙ্গে ও-পার বাংলার ঢাকা চট্টগ্রামের বাংলাকে সমান উৎসাহে স্বীকার করে নিলে বাঙালি বুক চিতিয়ে বলতে পারত, দেখ আমাদের ভাষার শক্তি। দুর্ভাগ্যবশত, বৈচিত্রময় বাংলা ভাষাকে অনাদরে ঠেলতে ঠেলতে আমরা তাকে ক্রমশ কোণঠাসা করে দিলাম। অথচ, বাংলা ভাষার প্রতি গভীর মমত্ববোধের কারণে ১৯৩৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথা বহির্ভূত ভাবে ইংরেজির পরিবর্তে বাংলায় ভাষণ দিয়েছিলেন। দাঙ্গাকবলিত নোয়াখালিতে মানুষের কাছে পৌঁছনোর জন্য বাংলা শেখার চেষ্টা করেছিলেন গান্ধীজি।

বর্তমানে বিশ্বায়ন, তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লবের প্রবল প্রতাপে জীবন জীবিকার অছিলায় বাংলাকে ব্রাত্য করে ‘ঔপনিবেশিক সমীহ’-র ধারা বহন করতে বাঙালি আত্মশ্লাঘা বোধ করে। ইংরেজিতে লেখা আবেদনপত্রের কদর বাংলা আবেদনপত্রের তুলনায় অনেক বেশি। এটিএম বা অন্য কোনও যান্ত্রিক ব্যবস্থায় ইংরেজিতে লেখা নির্দেশাবলি এটাই প্রমাণ করে, বাংলা ভাষাকে নিত্যদিনের কাজে ব্যবহারের জন্য আমরা মোটেই আগ্রহী নই। তাই বসন্তোৎসব, দীপাবলি আজ পরিণত হয়েছে ‘হ্যাপি হোলি’, ‘হ্যাপি দিওয়ালি’তে। ‘কেন কী’, ‘বাট’ প্রভৃতির যথেচ্ছ ব্যবহার, দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গীতের দল ‘বিটিএস’-এর প্রতি তুমুল অনুরাগ, বাংলা গানের প্রতি বিপুল বীতরাগ প্রভৃতি প্রমাণ করে, বাংলা ভাষার জন্য আবেগ আজ অস্তমিত প্রায়। বঙ্গ নরনারীর ২১ ফেব্রুয়ারির আবেগ একেবারেই সাময়িক, ১৯ মে তো বিস্মৃত অতীত। বাঙালির আত্মকরুণার বয়ানটিও সদাপ্রস্তুত। ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের ‘আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না’ সে কারণেই ভাইরাল হয়। এর পরিণতি ভেবে দেখা প্রয়োজন।

স্বাতী চট্টোপাধ্যায়, বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ

ভাষার বাজার

‘বাঁচান বাঁচি, মারেন মরি’ প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। কবি শঙ্খ ঘোষ সেই কবেই তাঁর কবিতায় লিখেছেন, “মুখের কথা একলা হয়ে/ রইল পড়ে গলির কোণে/ ক্লান্ত আমার মুখোশ শুধু/ ঝুলতে থাকে বিজ্ঞাপনে।” অর্থাৎ কবি বুঝতে পেরেছিলেন, ভবিষ্যতে তাঁর প্রিয় বাংলা ভাষাটিও ‘মার্কেটিং’-এর অভাবজনিত কারণে রক্তাল্পতায় ভুগবে। নিত্যনৈমিত্তিক ব্যবহার্য পণ্যের সঙ্গেই ভাষা, সাহিত্য, আচার অনুষ্ঠান, মনন, চিন্তন, চিত্র চলচ্চিত্র— সব বিকোবে। এ যেন এক গভীর অনিশ্চয়তায় নিমজ্জিত হওয়ার প্রাক্-মুহূর্তে উপস্থিত আমরা!

অথচ, এমনটা হওয়ার কথা ছিল কি? প্রবন্ধকার লিখেছেন, হিন্দির বিস্তার এবং আগ্রাসনকে ঠেকানোর জন্য দরকার পুঁজির জোর। কিন্তু কী আশ্চর্য! প্রায় বিনা পুঁজিতে কেমন করে হিন্দি আগ্রাসনের কবলে আমরা সবাই জড়িয়ে পড়েছি, সেই বিষয়ে একটুও আলোকপাত করেননি। আমরা যে ইচ্ছে করেই হিন্দি-নির্ভর হতে চেয়েছি, সে কথা ভুললে চলবে না। কলকাতা-সহ পশ্চিমবঙ্গের বড় শহরগুলোর বেশির ভাগই হিন্দি ভাষাভাষীদের দখলে। শিলিগুড়ি থেকে দুর্গাপুর, কল্যাণী থেকে কোচবিহার— চিত্রটা খুব একটা আলাদা নয়। এর দায় কার? শুধুই বাংলা ভাষার বাজার নেই বলে? যে উচ্চবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত বাঙালি হিন্দি এবং ইংরেজি ভাষাকে উত্তরণের পথ বলে মনে করে বলে প্রবন্ধকার লিখেছেন, সেই বিত্তশালী ও উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণি যুগে যুগে বিরাজমান। কালীপ্রসন্ন সিংহ, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সেই সব তথাকথিত ‘বাবু’ শ্রেণির কথা বলেছেন। তাঁরা আপন ভাষা গোল্লায় গেলে সেই যুগেও যেমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়েছে বলে বিশ্বাস করতেন না, এই যুগেও তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আশা করা বাতুলতা মাত্র। তা ছাড়া এই শ্রেণিতে বসবাসরত মানুষের সংখ্যা বাংলা ভাষায় কথা বলা সর্বমোট পশ্চিমবঙ্গবাসীর কাছে নিতান্তই নগণ্য। তবুও বাংলা ভাষা বিপন্ন, বাংলা মাধ্যম স্কুলে সন্তানদের পাঠাতে অভিভাবকদের অনীহা।

প্রয়োজন বিশ্বাস ফিরিয়ে আনার, প্রয়োজন উত্তরণের পথ খুঁজে বার করার। মাতৃভাষায় বিজ্ঞান চর্চায় সাফল্য অর্জন সম্ভব নয়, এই বিশ্বাস বাঙালির মধ্যে জাগ্রত করতে পেরেছিল ঔপনিবেশিক শাসন। তবুও জগদীশচন্দ্র বসু, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের মতো বিজ্ঞানী সে যুগেও লড়ে গিয়েছিলেন এই বিশ্বাস ভুল প্রমাণ করতে। আজ স্বাধীন ভারত তথা স্বাধীন রাজ্যটিতে সেই উদ্যোগ কোথায়? গ্রামবাংলার পরিধি কিন্তু শহরগুলোর চেয়ে অনেক বেশি। কাজের তাগিদে আমাদের রাজ্যেও ভিন রাজ্য থেকে আসা মানুষের সংখ্যা কম নয়। কিন্তু তাঁরা কেন বাংলা শিখবেন না, এই প্রশ্ন করার বলটুকুও আমরা সবাই হারিয়ে ফেলেছি কেন?

ভাষা পণ্য নয় যে, তাকে বাজার ধরতে হবে বা বাজারজাত করতে হবে। ভাষা একটি জাতির ধারক এবং বাহক। ভাষাকে আশ্রয় করেই চিন্তাচেতনা মননের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। আমবাঙালির চাওয়া পাওয়ার মাপকাঠিতে বিচার না করেই একটা ভাষাকে এ ভাবে ক্ষয়িষ্ণু আখ্যা দেওয়া যায় না। যদি তা-ই যেত, তা হলে আধুনিক বাংলা উপন্যাস কিংবা কবিতা কোনও কবি সাহিত্যিক লিখতেন না। উপন্যাস, প্রবন্ধের বই শুধু শহুরে এলিট শ্রেণির বাঙালির জন্য লেখা হয় না, গ্রামবাংলার পাঠক-পাঠিকার সংখ্যা বিচারেই লেখার কপির সংখ্যা বেড়ে যায়। তাই বিপন্ন বলে দাগিয়ে দিলে হিন্দি আগ্রাসনের পথটাও প্রশস্ত ও উন্মুক্ত হয়ে পড়ে।

শুধু শহর নিয়ে যেমন গোটা রাজ্য নয়, তেমন ভাবেই শহুরে এলিট শ্রেণির চাওয়া না-চাওয়ার উপরেও বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ নির্ভর করে নেই। অঞ্চল ভেদে বাংলা ভাষা তার নিজের মতো করেই বেঁচে থাকার রসদ জোগাড় করে নেবে। তার জন্য বাজার যাচাই করতে হবে না। আসলে ফিরিয়ে আনতে হবে বিশ্বাস, কতিপয় মানুষের ইচ্ছার উপরে নিজের অধিকার ছেড়ে দিয়ে আত্মসমর্পণ করলে সংস্কৃতি ভাষা কিছুই বাঁচতে পারে না।

রাজা বাগচী, গুপ্তিপাড়া, হুগলি

চাই পাঠক

অমিতাভ গুপ্ত প্রশ্ন রেখেছেন— প্রাত্যহিক সংযোগের ভাষা, না কি উচ্চ সংস্কৃতির ভাষা, কোনটি বিপন্ন? তিনিই বলছেন, লোকসংস্কৃতির প্রধানতম উদ্দেশ্য মানুষের মনোরঞ্জন। এই জনগোষ্ঠী হিন্দিতে স্থিত হচ্ছে। অতএব বাজারকে অস্বীকার করা বন্ধ না করতে পারলে বাংলা ভাষার বিপন্নতা নিয়ে কেঁদে লাভ হবে না। তার মানে কি বিষয়টা নিয়ে উৎকণ্ঠা নিরর্থক? যা চলছে চলুক, আমাদের ‘আবেগ-টাবেগ’কে সরিয়ে রেখে আমরা নিশ্চিন্তে বসে থাকতে পারি এই ভেবে যে, উচ্চ সংস্কৃতির বাংলায় বাংলা বই ছাপা ও বিক্রিতে টান পড়েনি, বাংলা গান এবং সিনেমা কম তৈরি হচ্ছে না; সংশয়হীন উত্তর এটাই— মোট উৎপাদন আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। অতএব উচ্চ সংস্কৃতির বাংলা বিপন্ন নয়।

প্রশ্ন হল, বাংলা বই বিক্রি বেড়েছে, পাঠক বেড়েছে কি? উত্তরটা খুঁজতে হবে বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে। পাঠ্যপুস্তকের বাইরে এদের অন্যান্য বই পড়ায় আগ্রহ নেই। প্রশ্ন উঠতে পারে, এতে বাংলা ভাষার বিপন্নতা নিয়ে কিছু প্রমাণিত হয় কি? অবশ্যই হয়। প্রবন্ধকারের অজানা নয় যে, সমাজমাধ্যমে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা ও বানানের কী দুর্দশা! আর এই সবই শিখছে বর্তমান প্রজন্ম। শুধু তা-ই নয়, স্কুলে শুদ্ধ বাংলা বানান শেখানোর পাঠ কবেই উঠে গেছে। ভুলভাল বানানেও লেটার মার্কস। আর ঠিক শেখাবেন কে? অনেক শিক্ষকও তো ভুল বানান লিখতে অভ্যস্ত।

শক্তিশঙ্কর সামন্ত, ধাড়সা, হাওড়া

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE