জয়দীপ চক্রবর্তীর ‘সহনাতীত এই দ্বিচারিতা’ (২৭-৬) প্রবন্ধে প্রসঙ্গে কিছু কথা। মনে পড়ছে দু’দিন আগে প্রকাশিত সংবাদটি— অন্ধ্রপ্রদেশের জাহ্নবী ডাঙ্গেতি, বয়স ২৩, আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘টাইটান স্পেস ইন্ড্রাস্ট্রিজ়’-এর (টিএসআই) আগামী অভিযান ‘টাইটান স্পেস মিশন’-এর অন্যতম নভশ্চর হিসাবে মহাকাশে পাড়ি দেবেন। ২০২৯ সালে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, উদ্ভাবন, গবেষণা, জৈবপ্রযুক্তি, ক্রীড়া, প্রতিরক্ষা, মহাকাশ অনুসন্ধান— সর্বক্ষেত্রে আজ নারীরা জাতির ভবিষ্যৎ গঠন করছেন। আজ তাঁরা সীমানা ভেঙে রুখে দাঁড়ান, ঝড় উঠলে মাথা তুলে, শিকল খুলে আকাশ ছোঁন। নারী, আজ আর গৃহকোণে বন্দি নন, স্রোতের মতো বয়ে চলেন, নিজের সূর্য নিজেই জ্বালেন।
মোবাইল স্ক্রিনে যখন আসে কাকিমার পাঠানো ৭২ বছরে পদার্পণ করা আমাদের বসতবাড়ির কাঠামো পুজোর ছবি, গিন্নি যখন ব্যস্ত তার বান্ধবীদের সঙ্গে রথের রশিতে টান দিতে, টিভি অন করতেই কানে আসে দক্ষিণ কলকাতার সরকারি আইন কলেজে এক তরুণী ছাত্রীর গণধর্ষণের সংবাদ। মাত্র দু’দিন আগে চিরতরে হারিয়ে যাওয়া নয় বছরের শিশুর রক্তে ভেজা মাটি তখনও স্বাভাবিক হয়নি। নারীর অপমান, তাঁর সঙ্গে অপরাধ কোথায় হচ্ছে না! গৃহে, হোটেলে, রেলের কামরায়, বাসে, গাড়িতে, সড়কে, কলেজে, আর এখন নবতম সংযোজন আইন কলেজ। আইন কলেজে ধর্ষণের মধ্যে অভিনবত্ব আছে। হয়তো ধর্ষণ হলে আইনি লড়াই কী ভাবে লড়তে হবে, কী রকম তথ্য প্রমাণ রাখা যেতে পারে, এক জন, না কি অনেক জন— জানা থাকলে আদালতে হয়তো ধর্ষণ মামলায় জয় পাওয়া যাবে, দোষীকে শাস্তি দেওয়া যাবে। একটা যেন হাতে-নাতে পরীক্ষা। পুরুষসমাজ আজ জেনে গিয়েছে, ধর্ষণে শাস্তি হয় না; যদি কোনও রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়া মাথার উপরে থাকে। গণধর্ষণের ঘটনা সামনে আসতেই শুরু হয়ে গিয়েছে রাজনৈতিক দড়ি টানাটানি। বিরোধীরা যখন এই ঘটনার জন্য রাজ্যের শাসক দলকে কাঠগড়ায় তুলছেন, তখন শাসক দল টেনে আনতে শুরু করেছে বিভিন্ন বিজেপিশাসিত রাজ্যে ধর্ষণের ঘটনাগুলি। হ্যাঁ, তা-ও ঘটেছিল এবং নিন্দার ভাষা নেই। কিন্তু আমাদের রাজ্যে পার্ক স্ট্রিটের ঘটনার পর থেকে একে একে কামদুনি, কাকদ্বীপ, কাটোয়া, রানাঘাট, সিউড়ি, হাঁসখালি, আর জি কর— অসংখ্য নারী-নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা নথিবদ্ধ, কোথায় অভিযুক্তরা শাস্তি পেয়েছে? এর জন্য কি ‘অপরাজিতা বিল’-এর পাশ হওয়া খুবই জরুরি!
অবাক হওয়ার কিছু নেই, যদি দেখা যায় আইন কলেজের গণধর্ষণের ঘটনায় ধৃত অভিযুক্তরা কিছু দিন পর ছাড়া পেয়ে যায়। প্রায় আর জি করের সময়কালের মতোই, পুজো আসছে। আর মাতৃপূজার নামে উৎসবের যে ঘটা চলে এই রাজ্যে, তাতে মানুষ ভুলে যায় সব কিছুই, অতি সহজে। আমরা অর্থাৎ এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারী, মহিলা, তরুণী কিংবা মেয়ে বলে সম্বোধন বা সম্মান করতে শিখিনি ‘নারী’ নামক মহীয়সীকে। একটুও বিব্রত বোধ না করে উচ্চারণ করি নানা ইঙ্গিতময় সম্বোধন। তা হলে কি কালো রাতের গর্জন শুনে শুধু কাঁদবে, হার মানবেন তাঁরা? নাহ্। তাঁরা যে ঝরে যাওয়া শিউলি ফুল নন। তাই তাঁরা আজ চেনা গণ্ডির বাইরে। সব বাধা পেরিয়ে প্রমাণ করছেন, যেখানে সাহস, সেখানেই সাফল্য। তাঁরা অদ্বিতীয়া।
সুপ্রিয় দেবরায়, বরোদা, গুজরাত
মনের গরল
জয়দীপ চক্রবর্তীর ‘সহনাতীত এই দ্বিচারিতা’ প্রবন্ধ মূল্যবান বিষয়ে আলোকপাত করেছে। মাতৃরূপী দেবীর সামনে নতজানু হয়ে প্রার্থী হয় যে মানুষ, সেই আবার নারীকে অবদমিত করে, নারীকে শুধুমাত্র কামের বস্তু ভাবে, নারীসম্ভোগের ইঙ্গিতবাহী গালাগালি উচ্চারণ করে— অবশ্যই এটি দ্বিচারিতা। অফিসে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, সামাজিক আড্ডায় বহু তথাকথিত শিক্ষিত এবং নিজেকে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ভক্ত বলে প্রচার করা পুরুষকে আমরা চেনা পরিচিত মহিলাদের সম্পর্কে নারীসম্ভোগের ইঙ্গিতবাহী নিম্নরুচির চটুল রসিকতা করতে দেখি।
নারীর প্রতি অবমাননার ক্ষেত্রে, আস্তিক ও নাস্তিক উভয়েই এক হয়ে যান। কেন এমন হয়? কথায় বলে, দেখাশোনা। জন্মের পরে, একটি শিশু চোখ মেলে দেখে। সে জানতে চায়, চিনতে চায় তার চার পাশের জগৎ সম্পর্কে। কিন্তু সে কি নিজে নিজেই চিনে নেয়? না কি, পারিপার্শ্বিক জগৎ চিনতে তাকে শ্রবণেন্দ্রিয় জাগ্রত হওয়ার জন্যে অপেক্ষায় থাকতে হয়? সে দেখে চোখ দিয়ে, কিন্তু শোনে কান দিয়ে! কোন বস্তুর নাম কী, নারী আর পুরুষের মধ্যে প্রভেদ কী কী, কোন মানুষটার সঙ্গে তার কী সম্পর্ক, সব সে জানতে পারে অন্যের কথা শুনে।
দু’টি বিষয়ই মানুষের চেতনার সঙ্গে সম্পর্কিত। একটি বস্তু বা একটি ঘটনাকে দেখার কাজটি করতে পারে চোখ। কিন্তু দর্শনেন্দ্রিয় তার কাজটি করার পরে, যে দৃশ্য ধরল ক্যামেরার লেন্স, সেটি প্রক্রিয়াকরণ করতে লাগে ক্যামেরার সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিট (সিপিইউ)। মানুষের অভ্যন্তরে এই সিপিইউ-এর কাজটি সম্পন্ন হয় তার চেতনার মাধ্যমে। চেতনা, প্রক্রিয়াকরণের কাজটি না করতে পারলে, দৃশ্যটি আমার নিজের ভাষায় অনুবাদ হয় না। চেতনা কি জাগ্রত হয় স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে, না কি চেতনা জাগ্রত হয় অন্যের কথা শুনে? এমন কিছু কথাও সে শোনে, যে সব কথার মূলে থাকে কিছু পূর্বনির্ধারিত জ্ঞান। বক্তারও অগোচরে যে জ্ঞানের অভ্যন্তরে থেকে যায় লিঙ্গ-ধর্ম-জাতি-বর্ণ এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য থেকে উদ্ভূত বিশ্বাস। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে শিশুর মনে তার অজানতেই, ছাপ ফেলে যায়। তেমন বিশ্বাসের প্রভাবেই কি শৈশব থেকে পুরুষ-শিশুর মনে বাসা বাঁধে, নারীকে অবমাননা করা যায়?
লিঙ্গ-ধর্ম-জাতি-বর্ণ বৈষম্যের প্রচারকরা এই সত্যটা জানতেন এবং জানেন। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে অতি সূক্ষ্ম ভাবে বৈষম্যের ভাবনাগুলো মানুষের মনে প্রোথিত করে দেওয়া হয়েছে।
দেখা যাচ্ছে, আস্তিক পুরুষ মুখে নারীকে দেবী বলেন, কিন্তু মনে মনে তাঁকে ভোগ্যবস্তু মনে করেন। আর নাস্তিক পুরুষ মুখে নারী প্রগতির ধ্বজা ওড়ান, কিন্তু মনে মনে নারীসম্ভোগ-আস্তিক হয়ে থাকেন। দ্বিচারিতা উভয় ক্ষেত্রেই পুরোমাত্রায়।
এর থেকে মুক্তি পেতে রবীন্দ্রশরণ নিতে হবে— “আমার এ ঘর বহু যতন করে/ ধুতে হবে মুছতে হবে মোরে।”
অনিরুদ্ধ রাহা, কলকাতা-১০
প্রতিভা বিদায়
সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘টিফিন কৌটো করে খাবার, শৃঙ্খলার শেষ কথা ছিল দোশী’ (২৭-৬) শীর্ষক প্রতিবেদন প্রসঙ্গে এই চিঠি। লন্ডনে ৭৭ বছর বয়সে প্রয়াত হয়েছেন ভারতীয় ক্রিকেট দলের প্রাক্তন ক্রিকেটার দিলীপ দোশী।
অসম্ভব প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও ভারতীয় ক্রিকেটের টেস্ট দলে তিনি তরুণ বয়সে সুযোগ পাননি তাঁর সমকালে ভারতের আর এক নামী বাঁ-হাতি স্পিনার বিষাণ সিংহ বেদীর সাফল্যের জন্য। প্রায় ৩২ বছর বয়সে ভারতীয় ক্রিকেট দলে সুযোগ পান এবং মাত্র ৩৩টি টেস্ট খেলার সুযোগ পেয়ে ১১৪টি টেস্ট উইকেট পেয়েছেন। ক্রিকেটের পরিভাষায় যথেষ্ট ঈর্ষণীয় রেকর্ড।
সত্তর-আশির দশকে বাংলা থেকে অনেক ক্রিকেটারই অসাধারণ প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও ভারতীয় ক্রিকেট দলে তেমন সুযোগ পাননি। সুব্রত গুহ, অম্বর রায়, গোপাল বসু, সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বরুণ বর্মণ প্রমুখ ক্রিকেটার ভারতীয় দলে অনায়াসে নিয়মিত খেলতে পারতেন। সত্তর দশকে ভারতীয় দলে স্পিন বোলিং-এ একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল বিষাণ সিংহ বেদী, ভগবত চন্দ্রশেখর, এরাপল্লি প্রসন্ন এবং ভেঙ্কট রাঘবনের। আর কোনও স্পিন বোলারের কথা ভাবাই হত না।
বাংলার ক্রিকেটার বিশ্বমানের উইকেটকিপার এবং ব্যাটার ঋদ্ধিমান সাহাও ক্রিকেটীয় বঞ্চনার শিকার। বাংলার হয়ে ক্রিকেট খেলতেন বলেই কি অসাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন দিলীপ দোশীও এত অবহেলা আর বঞ্চনার শিকার হয়েছেন?
তুষার ভট্টাচাৰ্য, কাশিমবাজার, মুর্শিদাবাদ
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)