সদ্যপ্রয়াত সঙ্গীতশিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের অননুকরণীয় গায়ন বিষয়ে সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘তৃষ্ণার জল, তৃপ্ত শেষ চুমুক’ (১৬-২) প্রসঙ্গে কিছু কথা। প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গানের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় এক শীতের দুপুরে, বইমেলায়। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি। তখন ময়দান চত্বরে হত বইমেলা। কলেজের ক্লাস কেটে পড়িমরি করে হাজির হয়েছি বইমেলায়। হঠাৎ থমকে গেলাম মাঠের একটা খোলা জায়গার সামনে এসে। ছোট জটলার মাঝে ফতুয়া-পাজামা পরিহিত, কাঁধে ঝোলা ব্যাগ, এক মাথা ঝাঁকড়া সাদা চুলের শীর্ণকায় এক মানুষ গাইছেন, “আমি বাংলায় গান গাই, আমি বাংলার গান গাই,/ আমি আমার আমিকে চিরদিন এই বাংলায় খুঁজে পাই।” গানের তালে তালে বাজছে তাঁর দুই হাতের তালু ও তাঁকে ঘিরে থাকা কমবয়সি শ্রোতাদের তালি। তাঁর গোটা শরীরের ভাষাও যেন গানের সঙ্গে মিশে আছে।
তার পর থেকে তাঁর গানের ভক্ত হয়ে গেলাম। শোনার অভ্যাসে চলে এলেন তিনি। তখন পুরোদমে সুমন-অঞ্জন-নচিকেতার তথাকথিত জীবনমুখী গানের যুগ চলছে। তাঁদের মাঝে প্রতুলের গান স্বতন্ত্র হয়ে উঠল। গানের মাধ্যমে নিজের ভাষা-সংস্কৃতির প্রতি দরদের পাশাপাশি শাসকের অনাচারের প্রতিবাদও তাঁর গানের বিষয়। কখনও তাঁর গানের চরণ হয়েছে গণ-আন্দোলনের কাব্যময় স্লোগান। মনে পড়ছে তাঁর অবিস্মরণীয় গান “জন্মিলে মরিতে হবে রে জানে তো সবাই/ তবু মরণে মরণে অনেক ফারাক আছে ভাই রে,/ সব মরণ নয় সমান।” তিনি শঙ্খ ঘোষের ‘বাবরের প্রার্থনা’ কবিতায় অনবদ্য সুর দিয়েছেন। সুভাষ মুখোপাধ্যায়, অরুণ মিত্রের কবিতা নিজস্ব সুরে গেয়েছেন। ভোলার নয় তাঁর কণ্ঠে মণিভূষণ ভট্টাচার্যের ‘কর্ণফুলী নদীতীরে’ কবিতার গান। সামান্য হলেও চলচ্চিত্রেও ব্যবহৃত হয়েছে তাঁর সুরেলা কণ্ঠ। সেখানেও তৈরি হয়েছে ভিন্ন মাত্রা। সমসাময়িক নাগরিক কবিয়াল সুমনের তাঁকে নিয়ে গানের কথাগুলি ঠিক বলে মনে হয়, “লোকটা নিজেই একটা গান,/ আস্ত একটা গান।” কিন্তু কী আশ্চর্য সমাপতন! তাঁর ও আমাদের প্রত্যেকের মায়ের ভাষা দিবস ২১ ফেব্রুয়ারির মাত্র ক’দিন আগেই তিনি চলে গেলেন। বাংলা ভাষা যত দিন বেঁচে থাকবে তত দিন প্রতিটি ২১ ফেব্রুয়ারি প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গান বাঙালি শুনবে ও গাইবে। না শুনে, না গেয়ে যে উপায় নেই। সত্যিই ‘সব মরণ নয় সমান।’
কৌশিক চিনা, মুন্সিরহাট, হাওড়া
তন্ত্র প্রসঙ্গে
সুগত বসু ‘জাতীয় সংগ্রামের আদর্শ’ (২৬-১) প্রবন্ধে বলেছেন, ৭৫ বছর পর ‘সংবিধানের প্রস্তাবনা’ নিয়ে নতুন করে পর্যালোচনা করা হোক। এই প্রসঙ্গে প্রথমেই আসে প্রজাতন্ত্র, গণতন্ত্র, সাধারণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র শব্দের অবমূল্যায়নের বিষয়। বস্তুত দুই সম্পাদকীয় ‘ভূলুণ্ঠিত’ (২৫-১) ও ‘৭৫ বছর পরে’ (২৬-১) একই ভাবে প্রাসঙ্গিক। তার সঙ্গে যুক্ত গোষ্ঠীতন্ত্র, সামন্ততন্ত্র, রাজতন্ত্র। শব্দগুলি কী বোঝায়, কতটা প্রাসঙ্গিক, তাও বিবেচ্য। এত ‘তন্ত্র’ থেকে কী লাভ হচ্ছে? বিখ্যাত শ্যামাসঙ্গীতে শাক্ত ভাবধারায় সাধক গেয়েছেন, “আমি মন্ত্রতন্ত্র কিছুই জানিনে না মা,” দেশকে মায়ের মতো ভালবাসলে কেন ‘তন্ত্র’ ও তার রূপ জরুরি হয়ে পড়ল স্বাধীনতার পর প্রস্তাবিত সংবিধান রচনায়? বর্তমানে ‘শাসন’ নামক ‘তন্ত্র’ থাকলেও ‘শাসন’-এর নামে ভূতের নৃত্য চলছে। একটা কথা শোনা যায়, ‘বিফলে মূল্য ফেরত’। কিন্তু দেশচালনায় কে কবে বিফলে মূল্য ফেরত পেয়েছে তার নজির নেই। ভারতের সংবিধান মেনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা উচ্চ থেকে নিম্ন, নানা স্তরে এমন অস্পষ্ট ভাবে দায়বদ্ধ। সবই তাঁদের ইচ্ছে। নিরীহ অসহায় নাগরিক ভবিষ্যতে সাংবিধানিক অধিকার ফিরে পাবেন, সেই আশা করেন না।
সংবিধানের আরও সংশোধন দরকার— লেখককে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই এই দুর্দিনে এমন সাহসী পর্যালোচনার জন্য। তিনি উল্লেখ করেছেন স্বাধীনতা ও সংবিধানের প্রস্তাবনার সঙ্গে ‘স্বরাজ’ শব্দ গুরুত্ব পায়নি, যা সুভাষচন্দ্র বসু, চিত্তরঞ্জন দাশ প্রমুখ চেয়েছিলেন। বরং নাকের বদলে নরুন নামক প্রজাতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, সাধারণতন্ত্র সব এল ঔপনিবেশিক প্রভাবে। ‘তন্ত্র’-যোগে এত শব্দের বহুস্বরে আসল মানুষের শব্দ চাপা পড়ে গেল। ৭৫ বছর শেষে ক্রমশ “পষ্ট চোখে দেখনু বিনা চশমাতে, পান্তভূতের জ্যান্ত ছানা করছে খেলা জোছনাতে।” লেখক উল্লেখ করেছেন, সুভাষচন্দ্র স্বরাজের ভিত্তিতে সংবিধান রচনার কথা বলেছিলেন। চেয়েছিলেন পূর্ণ স্বরাজের আগে যেন আসে পূর্ণ সাম্যবাদ।
এ দিনেরই সম্পাদকীয়তে যথোচিত পরামর্শ রয়েছে, কেন গণতন্ত্রের নাম করে দীর্ঘদিন ধরে ‘সর্বদলীয় রোগ’ সারানোর দরকার, ‘যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতন্ত্র’কে রক্ষা করার জন্য ‘কঠিনতর’ পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। মন্ত্র-তন্ত্র কিছুই জানিনে মা, কেবল জানি যে দেশের মানুষের সুস্থ নিরাপদ জীবনের সুযোগসুবিধা দরকার, সেটা এই দেশ ও তার রাজনীতি দিতে ব্যর্থ।
শুভ্রাংশু কুমার রায়, চন্দননগর, হুগলি
দূষণবিষ
কৌশিক বসুর ‘যে বায়ুতে শ্বাস নিই’ (১৭-২) প্রবন্ধটি খুবই প্রাসঙ্গিক। দূষণ যেমন আমাদের শরীরের ক্ষতি করে, তেমন অর্থনীতিতেও এর যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। এ বিষয়ে এখনই সাবধান না হলে ভবিষ্যতে ভারতীয় অর্থব্যবস্থাকে তার ফল ভোগ করতে হবে। যেমন হয়েছিল সিন্ধু সভ্যতার ক্ষেত্রে। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ও সমৃদ্ধ সভ্যতা ছিল সিন্ধু সভ্যতা। সিন্ধু সভ্যতার পতনের জন্য যে কারণগুলো উঠে আসে তার অন্যতম কারণ হিসাবে পরিবেশ দূষণের কথা বলা হয়। সিন্ধু উপত্যকার মানুষেরা এমন ভাবে জল ব্যবহার করেছিলেন যে, ভূগর্ভস্থ জলস্তর নেমে গিয়েছিল অনেক নীচে। জমি হয়ে গিয়েছিল কৃষিকাজের অযোগ্য। সিন্ধু সভ্যতার শাসকরা পরিবেশের এই ক্ষতি সম্পর্কে কোনও ভাবে সচেতন ছিলেন না। তার ফল পেয়েছিলেন। আমাদের বর্তমান সরকার কি এ বিষয়ে সচেতন? চিন যা পেরেছে, ভারত তা পারে না কেন?
মনে রাখতে হবে বায়ুদূষণ এক সর্বজনীন সমস্যা। বায়ুদূষণ প্রতিরোধের জন্য অ্যাকশন প্ল্যান বানানো এবং সেই অনুযায়ী কাজ করা কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তব্য। ২০১৯ সালের এক গবেষণাপত্র থেকে জানা যায় ২০১৭ সালে ভারতে যত মৃত্যু হয়েছিল, তার ১২.৫% ঘটেছিল বায়ুদূষণ জনিত কারণে। এ বছর প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্র বলছে, চড়া দূষণের ফলে ডিমেনশিয়া, ডিপ্রেশন, ও অ্যাংজাইটি সাইকোসিস-এর ঝুঁকি বাড়ে। কাজেই বায়ুদূষণ যে কতটা মারাত্মক এবং তাকে আটকাতে না পারলে আমাদের কত ক্ষতি হবে সহজেই অনুমেয়। সরকার উদ্যোগী ও সচেতন হবে কি?
অভিজিৎ দত্ত, জিয়াগঞ্জ, মুর্শিদাবাদ
শ্রবণ দিবস
৩ মার্চ বিশ্ব শ্রবণ দিবস। বর্তমানে যে ভাবে শব্দদূষণ বাড়ছে, তাতে আমাদের শ্রবণ ক্ষমতা ভয়ঙ্কর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই শব্দদূষণে বিশেষত শিশুদের বধিরতা দেখা দিতে পারে। যাঁরা কানে শোনেন না বা কম শোনেন, তাঁদের পথ চলার সময় নানা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। রাস্তায় গাড়ির হর্ন শুনতে না পাওয়ায় অনেকে দুর্ঘটনায় পড়েন। তাই বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, উৎসব, যানবাহনের হর্ন, রাজনৈতিক প্রচারসভায় মাইক ব্যবহারে রাশ টানতে হবে। অনেকেই উচ্চৈঃস্বরে মাইক বাজানোর প্রতিবাদ করেন। কিন্তু তাঁরা নানা ভাবে হেনস্থার শিকার হন। তাই নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতে বাধ্য হন। কিন্তু শব্দদূষণের ক্ষতির কথা মাথায় রেখে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিক, সরকারি দফতরের এগিয়ে আসা উচিত। আগামী প্রজন্মকে সুস্থ রাখতে অঙ্গীকার হোক— ‘শব্দদূষণ আর নয়।’
আনন্দময় ঘোষ, সোনামুখী, বাঁকুড়া
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)