প্রাইড মাসের শুরুতেই, স্বপ্নময় চক্রবর্তীর ‘কে তুমি? মানুষ’ (রবিবাসরীয়, ১-৬) প্রবন্ধ পড়ে হোঁচট খেলাম। প্রবন্ধকার বলেছেন “আমি ব্যক্তিগত ভাবে এই ব্র্যাকেটকে সমর্থন করি না।” প্রথমত, ব্র্যাকেটের অর্থ বন্ধনী, যা আবদ্ধ পরিসরকে নির্দেশ করে। লিঙ্গপরিচয় ও যৌন পছন্দের উপর ভিত্তি করে এত সম্ভাবনা যে বন্ধনীতে তাকে আবদ্ধ না করাই ভাল। তাই ‘কুইয়ার’ শব্দটির নির্মাণ। প্রবন্ধকার বলেছেন, “...কুইয়ার বলতে ঠিক কী বোঝায় আমি বুঝতে পারিনি।” আমরা নারী-পুরুষের দ্বিত্ব ভাঙছি যখন, তখন অসংখ্য যে সম্ভাবনার বর্ণালি বা স্পেকট্রাম তৈরি হচ্ছে— তাদের এক ছাতায় আনার পরিভাষা হল ‘কুইয়ার’, যার আক্ষরিক অর্থ ‘অদ্ভুত’। এ সব জানা-বোঝার জন্য কুইয়ার মানুষদের সঙ্গে বার্তালাপ হতে পারত, যেমন ভাবে হলদে গোলাপ-এর জন্য লেখক ট্রান্স মানুষদের সান্নিধ্যে এসেছিলেন। লেখক ট্রান্স মানুষদের প্রতি যে ‘সংলগ্নতা’ দাবি করেছেন, তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েই, এর পর সবচেয়ে আপত্তিকর অংশটি নিয়ে দু’চার কথা না বললে নয়। তিনি বলেছেন, “বাইসেক্সুয়াল বা উভকামীদের এর মধ্যে রাখতে চাই না।” সবিনয়ে জানাই, কাকে রাখা হবে আর কাকে হবে না, এ ঠিক সিস-হেটেরো পুরুষ সমাজের ইচ্ছাধীন বা এক্তিয়ারভুক্ত বিষয় নয়। বাইসেক্সুয়াল মানে তিনি করেছেন এ ভাবে: যাঁরা মাঝে মাঝে ‘মনে মনে নারী এমন বহু পুরুষের’ সঙ্গে শুয়ে থাকেন, আবার জৈবিক নারীর সঙ্গেও শুয়ে থাকেন। পরিশেষে তিনি উপসংহার টেনেছেন যে, এঁরা ‘রূপান্তরকামী পুরুষ’-দের দুর্দশার জন্য দায়ী। (এইখানে ধরে নিচ্ছি, তিনি ‘রূপান্তরকামী নারী’ বলতে চেয়েছেন। যে ব্যক্তি যে অবতারে রূপান্তর চাইছেন, সেই লিঙ্গেই ডাকা হয় তাঁকে।) সোজা কথায়, কিছু মানুষ রূপান্তরিত/ রূপান্তরকামী নারীর সঙ্গেও সহবাস করছেন আবার জৈবিক নারীর সঙ্গেও, এতে রূপান্তরকামী নারী অবিচারের শিকার হচ্ছেন— এ রকম কিছু তিনি বলেছেন।
এখানে ভুল বহুস্তরী। ১) আগেই বলা হয়েছে, যিনি নারী হতে চান, তাঁকে নারী বলেই ডাকাটা সৌজন্য। ২) উভকামী মানে, যিনি নারী ও পুরুষ উভয়ের প্রতি যৌন আকর্ষণ বোধ করেন। তিনি ট্রান্স মানুষের প্রতি আকর্ষণ বোধ না করতে পারেন। ৩) নারী, পুরুষ ও ট্রান্স মানুষ সকলের প্রতি যৌন আকর্ষণ বোধ করেন যিনি, তাঁদের অধুনা প্যানসেক্সুয়াল বলা হয়। ৪) এক সঙ্গে একাধিক যৌন সঙ্গী থাকলে, তিনি বহুগামী, পলিগ্যামাস বা পলিঅ্যামোরাস। সেটার ভাল-মন্দ নিয়ে ভিন্ন আলোচনা হতে পারে। একগামী মানুষের পক্ষে বহুগামী সঙ্গী পীড়াদায়ক। ৫) ৪-এর সঙ্গে উভগামিতার সম্পর্কই নেই। বহুগামী সিস-হেটেরো পুরুষও সিস-হেটেরো একগামী নারীর জন্য পীড়াদায়ক এবং উল্টো দিকটাও ঠিক। ৬) উভগামী মানুষও একগামী হতে পারেন। ধরা যাক, জীবনের প্রথম পর্বে এক জন মেয়ে এক পুরুষকে ভালবাসলেন। বিচ্ছেদের পর তিনি এক মেয়েকে ভালবাসলেন। এটা হল একগামী উভকামিতার উদাহরণ। ঠিক যেমন এক জন সিস হেটেরো নারী যদি প্রথমে এক জন পুরুষকে, বিচ্ছেদের পর আর এক জন পুরুষকে, পুনরায় বিচ্ছেদের পর আরও এক পুরুষকে ভালবাসেন, তা হলে তিনি একগামীই থাকেন। ৭) শেষে তিনি উভগামিতাকে ভুল বুঝেই ক্ষান্ত হননি, তার সঙ্গে তুলনা টেনেছেন শিশুকামের। এইখানে অপরায়ণ-জনিত ঘৃণা সম্পূর্ণতা পেয়েছে। আঠারো-অনূর্ধ্ব ব্যক্তির সঙ্গে জোর করে বা ভুল বুঝিয়ে সঙ্গম, আর দু’জন পূর্ণবয়স্ক মানুষের সম্মতিক্রমে সঙ্গম যে এক নয়, তা ২০১৮ সালের সুপ্রিম কোর্টেররায়েই স্পষ্ট।
এত বার ‘কাম’-এর কথা বলে আমাদের ভয় হচ্ছে, এই সম্প্রদায়কে আবার কামসর্বস্ব না ভেবে বসেন কেউ। রাতদখল ঐক্যমঞ্চ এমন এক মঞ্চ, যেখানে সাধারণ নারীর সঙ্গে সাধারণ ট্রান্স ও কুইয়ার মানুষের আদানপ্রদান প্রতিনিয়ত। আসলে যৌন পছন্দও যাপনের এক অঙ্গ, যাতে মিশে আছে মানুষের সখ্য, স্নেহ, শ্রদ্ধা, সাহচর্য— সিস-ট্রান্স-হোমো-হেটেরো-কুইয়ার সকলেরই।
রাতদখল (নারী-ট্রান্স-কুইয়ার) ঐক্যমঞ্চের সদস্যরা, কলকাতা-৩২
শুধুই ‘মানুষ’?
রবীন্দ্রনাথ পড়ে আমরা জেনেছিলাম, “প্রথম দিনের সূর্য/ প্রশ্ন করেছিল/ সত্তার নূতন আবির্ভাবে, কে তুমি—/ মেলে নি উত্তর।” আবার ‘দিবসের শেষ সূর্য’ও একই প্রশ্ন করে ‘পেল না উত্তর’। আচ্ছা, রবীন্দ্রনাথ কি জানতেন না যে, উত্তর হতে পারে ‘মানুষ’? তা হলে কেন তিনি উত্তর মেলাতে পারলেন না?
পারলেন না, কারণ তিনি মানবসত্যের সন্ধান পেয়েছিলেন। বুঝেছিলেন, মানুষ থেকে মানুষে, সত্য বহুবর্ণ। এক কথায়, ‘মানুষ’ বললে একটি জীব-প্রজাতিকে বোঝানো যেতে পারে, কিন্তু এই সাধারণীকরণে ‘মানুষ’কে দেখা যায় না। জীববিজ্ঞানীরা বলছেন, জীবজগতের অন্যান্য প্রজাতির, যাদের মন আছে, সে ক্ষেত্রেওএকই প্রজাতির প্রতিটি প্রাণীএক নয়।
দর্শন বা বিজ্ঞান, মানুষে মানুষে সাধারণীকরণের কোনও হেতু খুঁজে পায়নি। প্রতিটি মানুষের একাধিক সত্তা, একাধিক পরিচয়। এক জন কৃষ্ণাঙ্গ হতে পারেন, এক জন সমকামী, এক জন গায়ক, এক জন শিক্ষক অথবা সৈনিক— প্রতিটি সত্তাতেই আছেন ভিন্ন ভিন্ন তিনি, আবার সবগুলো মিলে তিনি এক পূর্ণ মানুষ।
এই কাজটি না করে, ‘কে তুমি?’-র উত্তরে ‘মানুষ’ বলে দিলে, সেটা হয় ব্যক্তিমানুষের উপরে একটি একরৈখিক পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যবাদী ধারণা চাপিয়ে দেওয়া। বিদেশে, এ দেশে, এই কথাটা ইতিমধ্যে সমাজ-রাজনীতি চিন্তায় বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। তবুও ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ আজও সক্রিয়। ফলত, জন্ম নিয়েছে অপরত্বের অনুভব, ‘পলিটিক্স অব আদারনেস’ বা অপরত্বের রাজনীতি। এই রাজনীতি ভাবছে এক বিরাট রামধনু চালচিত্রের কথা, যেখানে প্রতিটি মানুষের নিজস্ব সত্তা স্বীকৃত ও সম্মানিত— ‘মানুষ’ বলে দিয়ে সাধারণীকরণ বা ‘শ্রেণি’ বলে দিয়ে গোষ্ঠীভুক্তকরণের শৃঙ্খল সেখানে অপাঙ্ক্তেয়।
এলজিবিটিকিউ(+) এই বহুশাখা সমৃদ্ধ অপরত্বের রাজনীতির একটি শাখামাত্র। স্বপ্নময় চক্রবর্তী তাঁর লেখায় এলজিবিটিকিউ-এর পরে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ‘প্লাস’ শব্দটি লেখেননি। তিনি জানেন না,(+) চিহ্নটি তাঁদের দ্যোতক, যাঁরা এই অ্যাক্রোনিম-এ নেই। অবশ্য তিনি স্বীকার করেন যে, “কুইয়ার বলতে ঠিক কী বোঝায় আমি বুঝতে পারিনি”। না বুঝেই অসমর্থন কি বৌদ্ধিক সমাজে কাম্য? এলজিবিটিকিউ(+) কোনও ‘ব্র্যাকেট’ নয়। বরং, এই ভাবনায় বিশ্বাসীদের লড়াইটা সমস্ত ব্র্যাকেট-এর বিরুদ্ধে। ব্র্যাকেট নির্ধারণবাদীদের শব্দ; ‘এলজিবিটিকিউ(+)’ সম্ভাব্যবাদে বিশ্বাস করে।
লিঙ্গ পরিচিতি নিয়ে একটা দীর্ঘ লেখায় এক বারের জন্যও পুরুষতান্ত্রিকতা শব্দটা উচ্চারিত না হওয়া পাঠককে বিস্মিত করে। কিন্তু যখন স্বপ্নময়বাবু বলেন “আমার এই দেহটা ভুল দেহ। এই দেহ আমি চাই না”— এই ভাবনা তাঁর ভাষায় একটা ‘নাছোড় বোধ’; তখন সন্দেহ থাকে না যে তিনি ‘জেন্ডার ডিস্ফোরিয়া’ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞাত নন। এ প্রত্যয় দৃঢ় হয় পরের লাইনে, স্বপ্নময়বাবু লেখেন, “আবার কিছু মানুষ আছেন, যাঁদের মধ্যে একটা প্রশ্ন কেবল মাছির ভনভনানির মতো ঘুরে বেড়ায়— আমি কি পুরুষ? না কি নারী?” আইডেন্টিটি ক্রাইসিস-এর মূল প্রশ্নটা ‘মাছির ভনভনানি’! এই মন্তব্য কি বহু মানুষের যাপন অভিজ্ঞতাকে চূড়ান্ত ব্যঙ্গ করে না? এ মন্তব্য কি একটি পুরুষতান্ত্রিক স্পর্ধা নয়? তাই কি এড়িয়ে যাওয়া ‘পুরুষতান্ত্রিক’ শব্দটাকে?
মানুষের ‘পরিচিতি’ আজ শুধু একটি সামাজিক বিষয় নয়। পরিচিতির সঙ্গে সহিংসতা, বিচ্ছিন্নতা, অপরত্ব ইত্যাদি মিলে বিষয়টা আজ রাজনৈতিক। এই প্রেক্ষিত মনে রাখলে, ‘কে তুমি?’— এর উত্তর আজ আর শুধুই ‘মানুষ’ হতে পারে কি?
অনিরুদ্ধ রাহা, কলকাতা-১০
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)