সম্পাদকীয় প্রবন্ধ ‘কে কত নিরাপদ’ (১৮-১০) অত্যন্ত সময়োপযোগী। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো বা এনসিআরবি-র প্রতিবেদন (২০২৩) দেখাচ্ছে, কলকাতা সবচেয়ে নিরাপদ শহর। বিশেষত মেয়েদের উপর অপরাধের হারের নিরিখে কলকাতার অবস্থান যথেষ্ট ভাল। তা হলে বছরভর রাজ্যে নারীহিংসার যে ঘটনাগুলো ঘটছে তাকে আমরা কী ভাবে দেখব? কী ভাবে এনসিআরবি-র রিপোর্টে কলকাতা ‘ফার্স্ট বয়’ হয়ে গেল, তা প্রহেলিকা। এনসিআরবি কেন্দ্রীয় সংস্থা হলেও তাকে তথ্য জোগায় রাজ্য। তাই তথ্য সরবরাহে গলদ থাকলে পরিষ্কার চিত্র পাওয়া কঠিন।
মনে রাখতে হবে, তথ্য কেবল গবেষকদের গবেষণার কাজে লাগে, তা নয়। তথ্য সাধারণ মানুষের সম্পদ। গণতন্ত্রের ভিত্তি। তথ্যের প্রাচুর্য ঘটনার প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে। আবার তথ্যের অপ্রতুলতা বা বিকৃতি ঘটনার গুরুত্বকে লঘু করে দেয় বা ভুল পথে চালিত করে। বরং এনসিআরবি-র রিপোর্টের ভিত্তিতে পরোক্ষে প্রমাণিত হচ্ছে, অভিযোগ দায়ের করার জন্য মেয়েদের যে সামাজিক সক্ষমতা প্রয়োজন হয়, তাতে এখনও এ-রাজ্যের মেয়েরা অনেক পিছিয়ে। তা ছাড়া আক্রান্ত মেয়েদের এফআইআর দায়ের করা থেকে নিরস্ত করা, গুরুতর অপরাধে লঘু ধারা আরোপ করার মতো ঘটনাগুলো ঘটলে সত্যের একটা আবছা প্রতিকৃতিই উঠে আসে সমীক্ষায়। তাই পরোক্ষে অন্যান্য দুর্বলতা প্রকট হয়ে পড়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। মনে রাখা ভাল যে, মনগড়া সাফল্য সামনে রেখে নারীহিংসার মতো গুরুতর সমস্যা এড়িয়ে গেলে তাতে আখেরে রাজ্যের ক্ষতি। রাজ্যে নারীহিংসার বৃহৎ চিত্রটির ডালপালা যে অনেক দূর বিস্তৃত, তা প্রমাণিত হয় এই ঘটনাগুলি থেকে। মনে পড়ে যায়, দার্শনিক জন লক বলেছিলেন, যেখানে আইন নেই, সেখানে স্বাধীনতাও নেই।
অজয় ভট্টাচার্য, বনগাঁ, উত্তর ২৪ পরগনা
প্রশ্রয়ের ফল
দুর্গাপুরে ডাক্তারি পড়ুয়াকে ধর্ষণের পর উলুবেড়িয়ায় মহিলা চিকিৎসককে হুমকি। তার পরে বীরভূমের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মদ্যপ অবস্থায় এক নার্সের শ্লীলতাহানির চেষ্টা। সব শেষে এসএসকেএম-এর ট্রমা কেয়ার সেন্টারের শৌচালয়ে এক নাবালিকাকে নির্যাতনের ঘটনা। রয়েছে সংবাদমাধ্যমে না উঠে আসা অজস্র ঘটনাও।
আর জি কর হাসপাতালের ঘটনার প্রতিবাদে এত বড় আন্দোলনের পরও একের পর এক সরকারি হাসপাতালে এমন করে শ্লীলতাহানি, ধর্ষণের ঘটনা ঘটতে পারছে কী করে? এমন ঘটনা আটকাতে রাজ্য সরকার কী ব্যবস্থা করেছে? আর জি করের চিকিৎসক-ছাত্ররা যে দাবিগুলি তুলেছিলেন, আন্দোলনের ময়দানে জনতার পক্ষ থেকে নারীর নিরাপত্তার যে দাবিগুলি উঠেছিল, সেগুলি সরকার পূরণ করেছে কি? কলেজগুলিতে শাসক দলের হুমকি-বাহিনী যে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করেছিল সেগুলি বন্ধে প্রশাসন কোনও ব্যবস্থা করেছে? রাজনীতির রং বিচার না করে দোষীদের চিহ্নিত করে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করেছে কি? বাস্তবে তো কিছু ক্যামেরা লাগানো ছাড়া প্রশাসন নাকি আর কিছুই করেনি। মানুষ ভুলে যায়নি যে, আর জি কর কাণ্ডে কী ভাবে দোষীদের আড়াল করতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং প্রশাসন কার্যত ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। অতি দ্রুত এক সিভিক ভলান্টিয়ারকে গ্রেফতার করে তাকেই একমাত্র দোষী হিসাবে সাজা দিতেই যেন তৎপর হয়ে উঠেছিল গোটা প্রশাসন। আর জি কর ঘটনায় আরও যে অজস্র প্রশ্ন, সন্দেহ আন্দোলনকারী চিকিৎসক সংগঠনের পক্ষ থেকে, আন্দোলনে যুক্ত সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে তোলা হয়েছিল, তদন্ত করে সত্য সামনে আনার পরিবর্তে সেগুলি ধামাচাপা দিতেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল প্রশাসন। উল্টে আন্দোলনরত চিকিৎসকদেরই নানা হুমকি, শাস্তির মুখে ফেলেছিল। স্বাভাবিক ভাবেই এই আচরণে এই ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার পরিবর্তে তাদের প্রতি প্রশ্রয়ই প্রকাশ পেয়েছে। অপরাধী যদি ক্ষমতার ঘনিষ্ঠ হয়, রাঘববোয়ালদের চক্রের অংশীদার হয় তবে তার শাস্তি দূরের কথা, রক্ষার চেষ্টাই কর্তাব্যক্তিরা করবেন, এই আচরণে সেটাই স্পষ্ট হয়েছে।
আর জি করের ঘটনায় যখন রাজ্য তথা দেশের মানুষ চরম ক্ষুব্ধ, তখন অনেকের ধারণা হয়েছিল, কেন্দ্রের সরকার যে হেতু রাজ্যের বিরোধী, তারাই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করবে। কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালিত সিবিআই দোষীদের চিহ্নিত করবে। কিন্তু মানুষ লক্ষ করল, সিবিআই শুরুতে বহু নতুন সূত্রের কথা বললেও শেষ পর্যন্ত রাজ্যের নিয়ন্ত্রণাধীন পুলিশের তদন্ত রির্পোটেই ছাপ্পা দিল। যেন উভয় পক্ষেরই লক্ষ্য, লড়াইয়ে জনগণকে কোনও মতেই জয়ী হতে না দেওয়া। ফলে দুষ্কৃতীরাই উৎসাহিত হয়েছে। তাই রাজ্য জুড়ে নারী নির্যাতনের ছবিটি পাল্টায়নি।
সোমা নন্দী, কলকাতা-৯
নটসূর্যের কথা
শম্পা ভট্টাচার্যের লেখা ‘অর্জুনের ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য শিখেছিলেন তির-ধনুক চালনা’ (রবিবাসরীয়, ১২-১০) প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে এই চিঠি। নটসূর্য অহীন্দ্রভূষণ চৌধুরীর পেশাদার মনোভাব অসাধারণ ছিল। সে কালের মঞ্চের দশার সঙ্গে সম্পৃক্ত একটি রস-আখ্যানে তার ঝলক মেলে। এক দিন এক নবীন অভিনেতাকে বলেছিলেন, যদি তুমি হঠাৎ চোখের সামনে দেখো থিয়েটারে আগুন লেগে গিয়েছে, তখন বাড়ি ফিরে যাবে না। থিয়েটারের ফায়ার ইনশিয়োরেন্স থাকতে পারে। এ অগ্নিকাণ্ড স্বেচ্ছাকৃত নয়, তাই বা তুমি কী করে জানলে? তুমি থিয়েটারের মালিকের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করবে, বাড়ি ফেরার কথা। না বলে গেলে মালিক বলতে পারে, থিয়েটার আমার জ্বলুক আর পুড়ুক, আমি অভিনয় বন্ধ করতাম না। না জানিয়ে তুমি চলে গিয়ে অভিনয় বন্ধ করিয়েছ, তোমায় ড্যামেজ দিতে হবে। তাই মালিকের কাছে অনুমতি নিয়ে তবে বাড়ি যাবে।
তা ছাড়া রিহার্সালের সঙ্গে দৃশ্যপট, আলোকসম্পাতের রদবদল ঘটিয়ে চলতেন অহীনবাবু। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিটা ছিল বৈজ্ঞানিকের। দিন না রাতের দৃশ্য— সেটা মাথায় রেখেই সেটের রংটাও নিজে নির্বাচন করে দিতেন। শিল্পীরা মুভমেন্টে এতটুকু হেরফের ঘটালে খড়ি দিয়ে মার্কিং করে দিতেন এবং বাচিক অভিনয়ে বিশেষ নজর দিতেন।
প্রদীপ কুমার সেনগুপ্ত, ব্যান্ডেল, হুগলি
দায়ী রাষ্ট্রও
‘অন্ধ্রপ্রদেশের মন্দিরে পদপিষ্ট হয়ে মৃত ১০’ (২-১১) প্রতিবেদনটি বেদনাদায়ক। অন্ধ্রপ্রদেশের মন্দিরে হাজার হাজার মানুষ একত্রিত হয়েছিলেন পূজার জন্য। পুণ্যলাভের আশায় মানুষ সেখানে গিয়েছিলেন, কিন্তু উপহার হিসাবে এল মৃত্যু।
ধর্ম আজ মানুষের মুক্তির পথ নয়, বরং তার দাসত্বের শৃঙ্খল। যুক্তিহীন বিশ্বাস ও অন্ধ ভক্তির এই প্রবাহ মানুষকে ক্রমশ ভাবনার অক্ষমতায় ঠেলে দিচ্ছে। এমন মৃত্যুকে আমরা দুর্ঘটনা বললেও, এর মূলে রয়েছে সমাজের দীর্ঘদিনের অজ্ঞতা ও রাষ্ট্রীয় ভণ্ডামি। মন্দির, মসজিদ, মেলা, পূজা সব জায়গায় এখন ভিড়ই ধর্মীয় সাফল্যের মাপকাঠি হয়ে উঠেছে। অথচ ভিড়ের নিরাপত্তা, পরিকল্পনা, নিয়ন্ত্রণ কিছুই থাকে না। এই অনিয়ম ও অব্যবস্থারই ফল হল এতগুলি মৃত্যু।
রাষ্ট্রও এখানে সমান দায়ী। ভারতের সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বললেও বাস্তবে সরকার নিজেই ধর্মীয় প্রকল্পের বিজ্ঞাপন দেয়, জনগণের করের টাকা ব্যয় করে মন্দির, তীর্থস্থান ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান ঘিরে বিশাল বাজেট ঘোষণা করে। রাষ্ট্র বোঝে, মানুষ যখন অন্ধ ভাবে প্রার্থনা করে, তখন সে প্রশ্ন করে না; যখন সে ঈশ্বরের ভয়ে থাকে, তখন সে শাসকের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলে না। এই কারণেই ধর্ম রাষ্ট্রের সবচেয়ে কার্যকর মাদক— যা জনগণকে চিন্তাশূন্য রাখে।
প্রতাপ চন্দ্র দাস, নবদ্বীপ, নদিয়া
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)