সম্পাদকীয় ‘পড়াবেন কে’ (১৮-৮) বর্তমান সময়ে বিদ্যালয়-শিক্ষায় বেহাল দশার এক খণ্ডচিত্র। এ দেশে নির্বাচন মানেই উৎসব। আর পশ্চিমবঙ্গে তো তা মহোৎসবে পরিণত হয়েছে। দুর্গাপুজোর অনেক আগে থেকেই যেমন উন্মাদনার প্রহর গোনা শুরু হয়ে যায়, তেমনই সমাজমাধ্যম বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার দৌলতে প্রতিটি নির্বাচনের অনেক আগে থেকেই ‘সাজো সাজো’ রব পড়ে যায়। সামনের বছর পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন। ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশন থেকে ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ শুরু হয়েছে। এর জন্য বুথ লেভেল অফিসার (বিএলও) নিয়োগ ও প্রশিক্ষণের পর্ব চলছে। এঁরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে একেবারে তৃণমূল স্তর থেকে কাজটি করবেন। বিএলও-র কাজে এ বার মূলত প্রাথমিক শিক্ষক ও কিছু ক্ষেত্রে উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নেওয়া হয়েছে। এর ফলে বিদ্যালয়গুলোতে সমস্যা আরও প্রকট হবে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এখন পাঁচটি শ্রেণি। অথচ, সব বিদ্যালয়ে শ্রেণিভিত্তিক শিক্ষক নেই। প্রতি বিদ্যালয়ে গড়ে তিন থেকে চার জন শিক্ষক। অনেক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক-সহ একাধিক শিক্ষককে যেমন এই কাজ দেওয়া হয়েছে, তেমনই বিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষককে এই কাজে যুক্ত করার নজিরও রয়েছে। এ সব কাজ মানেই ঘন ঘন ব্লক অফিসে যাওয়া। বুথ এলাকায় তথ্য সংগ্রহে সময় দেওয়া। সাধারণ নাগরিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় নথি জোগাড়-সহ আরও অনেক কাজ। তা হলে পঠন-পাঠনের কী হবে? এমনিতেই ছাত্রের অভাবে অনেক সরকারি বিদ্যালয় ধুঁকছে। শিক্ষকদের প্রতি পূর্ণ আস্থা থাকলেও শিক্ষা বহির্ভূত নানা কাজ চাপিয়ে দেওয়ার ফলে হয়তো পঠন-পাঠনে ঘাটতি থাকছে এই ধারণা থেকে অভিভাবকগণ বেসরকারি বিদ্যালয়ের দিকে ঝুঁকছেন।
এ বার বিএলও-দের ভাতা বেড়েছে দ্বিগুণ। সম্মানজনক অর্থ বরাদ্দ হয়েছে। কত বেকার যুবক-যুবতী কর্মহীন হয়ে বসে রয়েছে। এই অর্থ তাদের দিয়ে কাজটা অনায়াসে তোলা যেত। আশির দশকে দেশ থেকে নিরক্ষরতা দূরীকরণের লক্ষ্যে ‘সাক্ষরতা অভিযান’ শুরু হয়েছিল দেশ জুড়ে। সে সময় স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করে খুব সামান্য সাম্মানিক দেওয়া হয়েছিল। ন্যূনতম পাঁচ জনকে সাক্ষর করার দৃষ্টান্ত-সহ ভাল কাজের নিরিখে জেলাস্তর থেকে ওই স্বেচ্ছাসেবকদের একটা শংসাপত্র দেওয়া হয়। যে শংসাপত্র পরবর্তী সময়ে যে কোনও সরকারি চাকরির পরীক্ষায় ‘একস্ট্রা কারিকুলার’-এ গ্রাহ্য হত। তার জন্য অতিরিক্ত নম্বরও পাওয়া যেত। যে-হেতু এ কাজ প্রায় প্রতি বছর হয়, তাই পরবর্তী কালে এ রকম কোনও উৎসাহব্যঞ্জক পন্থা নিয়ে শিক্ষিত বেকার যুবক-যুবতীদের দিয়ে বিএলও-র কাজ করানো যায় কি না, নির্বাচন কমিশনকে ভেবে দেখার অনুরোধ করছি।
কার্তিক সাহু, দেড়িয়াচক, পূর্ব মেদিনীপুর
পেশাদার হোক
রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের ডেপুটি গভর্নর স্বামীনাথন জে-র অভিযোগ ‘সহানুভূতিশীল নন ব্যাঙ্ক কর্মীরা: আরবিআই কর্তা’ (২৩-৭) এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে সম্পাদকীয় ‘অসংবেদনশীল’ (২৮-৭) দু’টিই সময়োপযোগী এবং প্রাসঙ্গিক। এই প্রসঙ্গে আমার অভিজ্ঞতা থেকে দু’চার কথা বলতে চাই। আমি এক জন প্রবীণ নাগরিক। তিনটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক এবং একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কে আমার অ্যাকাউন্ট রয়েছে। তবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির সঙ্গেই লেনদেনটা বেশি। অন্য দিকে, বেসরকারি ব্যাঙ্কটির সঙ্গে সম্পর্ক খুব বেশি দিনেরও নয়। তবে এই ব্যাঙ্কটির পরিষেবার মান বেশি সন্তোষজনক। নতুন সেভিংস অ্যাকাউন্ট খোলা বা ফিক্সড ডিপোজ়িটে (এফডি) বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আধিকারিকরা অনেক সময় নিজেরাই গ্রাহকের বাড়ি এসে কাজটা সম্পন্ন করেন এবং পাসবই বা ফিক্সড ডিপোজ়িটের সার্টিফিকেট লোক মারফত গ্রাহকের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া গ্রাহককে শাখায় যেতে হয় না। আর গেলেও বসার জন্য একটা চেয়ার অন্তত পাওয়া যায়। মেলে ভাল ব্যবহারও।
অন্য দিকে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিতে দীর্ঘ ক্ষণ কাউন্টারের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে কাজ সারতে হয়। যদিও রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের তরফে প্রবীণ নাগরিকদের জন্য পৃথক কাউন্টার খোলার নির্দেশ রয়েছে। এমনকি বেসরকারি ব্যাঙ্কের মতো বাড়ি গিয়ে পরিষেবা দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। সেভিংস বা ফিক্সড ডিপোজ়িট অ্যাকাউন্ট খুললে পাসবই বা এফডি সার্টিফিকেট দিনের দিন পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। আধিকারিকের টেবিলের কাছে গিয়ে কথা বলতে গেলে সামনের চেয়ারে বসতে বলার সৌজন্যটুকুও দেখানো হয় না। অবশ্য কয়েক জন সহানুভূতিশীল কর্মীও রয়েছেন।
তা ছাড়া, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি যেখানে পুরনো নিয়ম-কানুনই আঁকড়ে ধরে রেখেছে সেখানে বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলি অনেকটাই উদার। বেসরকারি ব্যাঙ্কের ইস্যু করা একটি এফডি সার্টিফিকেট খুঁজে না পাওয়ায় এক দিন শাখায় যেতে হল। তাঁরা কেবল এফডি-র নম্বরটা জানতে চাইলেন। আর সেটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই কম্পিউটার থেকে ডিপোজ়িট সার্টিফিকেটের একটি প্রিন্ট বার করে আমার হাতে দিলেন। এর জন্য কোনও ইনডেমনিটি বন্ড বা জামিনদারের প্রয়োজন হল না যেগুলি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে হয়ে থাকে। এ ছাড়াও আরও অনেক উদাহরণ রয়েছে, যেখানে বেসরকারি ব্যাঙ্কে কাজগুলি সহজেই হয়ে যায়।
কিন্তু বেশির ভাগ মানুষ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কেই ভিড় করেন। কারণ, এখানে অ্যাকাউন্ট খুলতে প্রাথমিক জমার পরিমাণ কম। তা ছাড়া সরকারের নানা প্রকল্পের টাকা এই ব্যাঙ্কগুলিতেই সুবিধাভোগীদের অ্যাকাউন্টে জমা হয়। তবে বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই এখন বেসরকারি ব্যাঙ্ককে বেছে নিচ্ছেন এবং সেই সঙ্গে মিউচুয়াল ফান্ড ও শেয়ারে বিনিয়োগ করছেন। ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির আমানত বৃদ্ধির পরিমাণ কমছে, তাদের ব্যবসাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
সুতরাং, নিজেদের স্বার্থেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিকে পরিষেবার মানোন্নয়ন ঘটাতে হবে। অন্যথায়, ব্যাঙ্কগুলি বেসরকারি মালিকানায় চলে যেতে পারে যা সাধারণ মানুষের কাছে কাঙ্ক্ষিত নয়।
তপন কুমার ভট্টাচার্য, ওলাইচণ্ডীতলা, হুগলি
হাতিয়ার
কৌশিক সেনের ‘কোনটা মনে রাখব’ (১২-৮) শীর্ষক প্রবন্ধটির পরিপ্রেক্ষিতে এই চিঠি। বিখ্যাত চেক-ফরাসি ঔপন্যাসিক মিলন কুন্দেরা তার উপন্যাস দ্য বুক অব লাফটার অ্যান্ড ফরগেটিং-এ লিখেছিলেন “ক্ষমতার বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রাম হল আদতে বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির লড়াই।” ক্ষমতা তার কায়েমি স্বার্থে চিরকালই ইতিহাসের এমন এক আখ্যান তৈরি করতে চাইবে, যা সহজ-সরল ও একপেশে। এই নির্মিত ইতিহাসে এমন কিছু থাকবে না যা শাসকের সেই সহজ আখ্যানের নৈতিক ভিত্তির বৈধতাকেই প্রশ্ন করতে পারে।
আর এই একমুখী ইতিহাস তৈরিতে শাসকের বিশেষ হাতিয়ার যে হতে পারে শিল্পমাধ্যম, তার বহু নজির আমরা ইতিপূর্বে দেখেছি। ধরা যাক, সাম্প্রতিক কালে দেশব্যাপী মুক্তি পাওয়া ছবি ছাওয়া। মরাঠা বনাম মোগল— এই দুই সম্রাজ্যের রাজনৈতিক যুদ্ধকে কী সুচারু ভাবে সেখানে হিন্দু-মুসলিম দুই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের যুদ্ধের মোড়কে পরিবেশন করা হয়েছে। এই ইতিহাস কোনও দিন বলবে না যে মরাঠা নৌবাহিনীর সেনাপ্রধান ছিলেন এক জন মুসলমান। শুধু নৌবাহিনী নয়, প্রশাসনের আরও বিভিন্ন পদে আসীন ছিলেন অসংখ্য অহিন্দু মানুষ। ভুলিয়ে দেওয়া হবে, কারণ বহুত্ববাদের সমস্ত নজির মুছে ফেললে তবেই হিন্দুরাষ্ট্রের দিকে যাওয়ার পথ আরও প্রশস্ত হবে।
ডক্টর ফস্টাসের কথা আমরা জানি। কিছু তাৎক্ষণিক সুখের বিনিময়ে তিনি মেফিস্টোফেলিসের কাছে নিজের আত্মা বিক্রি করেন। ইতিহাসের প্রতি সত্যনিষ্ঠ থাকা এক জন শিল্পীর দায়। না হলে নিজের অজানতেই তিনি ফাউস্টাসের মতো ক্ষমতার হাতে আত্মা বিক্রি করা পরজীবীতে পরিণত হবেন।
সৌরনীল ঘোষ, কলকাতা-১৪১
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)