৫ সেপ্টেম্বর সারা দেশে শিক্ষক দিবস পালিত হয়। ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের জন্মদিনে প্রতি বছর আমরা স্মরণ করি শিক্ষকতার গরিমা। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে ফুলের তোড়া, বক্তৃতা আর আনুষ্ঠানিক শ্রদ্ধা জানানোর আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষকদের দুর্দশা, অপমান ও আন্দোলন। এ রাজ্যে ২০১৬ সালের স্কুল সার্ভিস কমিশনের নিয়োগ প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে বিশাল কেলেঙ্কারি প্রকাশিত। শীর্ষ আদালত স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছে, এই নিয়োগ ‘টেন্টেড বিয়ন্ড রিডেম্পশন’, অর্থাৎ অনিয়ম এত গভীর যে শোধরানোর উপায় নেই। এর ফলে প্রায় ছাব্বিশ হাজার শিক্ষক-অশিক্ষক কর্মীর চাকরি বাতিল হয়।
চাকরি হারানো হাজার হাজার নিরপরাধ শিক্ষক দীর্ঘ দিন ধরে আন্দোলন চালিয়েছেন। কলকাতার এসএসসি অফিস ঘিরে ধর্না, অনশন, মিছিল করেছেন। অনেক ক্ষেত্রে পুলিশি লাঠিচার্জ, কোর্টকাছারিতে হাজিরা, গ্রেফতার, শারীরিক ও মানসিক আঘাত, অপমান সহ্য করতে হয়েছে তাঁদের। এমনকি ‘নবান্ন অভিযান’ও হয়েছিল, যাতে হাজার হাজার শিক্ষক নবান্ন অভিমুখে রওনা হলেও প্রশাসনিক বাধা পেরোতে পারেননি। এই দুর্নীতি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত। সম্প্রতি তাঁরা ফের স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় বসেছেন। বিরোধীরা দাবি করছেন, যোগ্য শিক্ষকদের চাকরি ফিরিয়ে দিতে হবে। অন্য দিকে, শাসক নানা আইনি পথ খুঁজছে দাগি প্রার্থীদের অন্য শূন্য পদে নিয়োগ করার। ইতিমধ্যেই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা নিয়োগ দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে শাসক দলের বিধায়ককে গ্রেফতার করেছে।
স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে, এই শিক্ষকরা, যাঁরা একটি গোটা প্রজন্মকে গড়ে তোলার দায়িত্ব নিয়েছিলেন, তাঁদেরই কি রাস্তায় বসে অনশন করতে হবে? যাঁরা শাসক-প্রশাসনের ব্যর্থতার শিকার, তাঁদেরই কি প্রশাসনের লাঠির মুখে পড়তে হবে? রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থার নিদারুণ দুরবস্থার কথা আজ কারও অজানা নয়। অনেক অভিভাবকই তাঁদের সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য অন্য রাজ্য এবং বিদেশমুখী হচ্ছেন। শিক্ষক দিবসে তাই প্রয়োজন কেবল আনুষ্ঠানিক ফুলের তোড়া আর বক্তৃতা নয়। দরকার কার্যকর সংস্কার, আর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। অবিলম্বে প্রয়োজন প্রতি বছর স্বচ্ছ শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত শিক্ষা প্রশাসন, শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং পার্শ্বশিক্ষকদেরও আর্থিক নিরাপত্তা।
যাঁরা আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ গড়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত, তাঁদের ভবিষ্যৎই যদি অনিশ্চিত থাকে, তবে আমরা কাদের উপর নির্ভর করব আর কী নিয়ে গর্ব করব?
কাজল মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-৮
সাক্ষরতা
গত ৮ সেপ্টেম্বর ছিল আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস। নিরক্ষরতা একটা অভিশাপ। নিরক্ষর হওয়া যেমন নিজের জন্য বিপদ, তেমনই বিপদ দেশ ও দশের জন্য। সাক্ষরতার আলোয় মানুষ যত দিন না উদ্ভাসিত হয়েছে, জীবনের গুরুত্ব কি সে অনুভব করতে পেরেছে? দেশ ও সমাজকে উন্নত করতে হলে সবচেয়ে বেশি দরকার শিক্ষার বা সাক্ষরতার। এই কারণে ১৯৬৬ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সম্মেলনে ৮ সেপ্টেম্বরকে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৯৬৭ সাল থেকে প্রতি বছর এই দিনটি আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। শান্তিপূর্ণ, ন্যায়সঙ্গত, বৈষম্যহীন একটি উন্নত সমাজ গড়তে হলে সাক্ষরতার খুবই দরকার। ন্যায়, সাম্য, মূল্যবোধ, সততা, শান্তি ও অহিংসার জন্যও সাক্ষরতার দরকার। সাক্ষরতা এক জন মানুষকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করে। মানুষকে সমস্ত অন্যায়-অবিচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়তে শেখায়। আজ বিশ্বের ছয় থেকে আঠারো বছর বয়সি কয়েক কোটি শিশু স্কুলের চৌহদ্দির বাইরে রয়েছে। বহু শিশু প্রাথমিক শিক্ষা থেকে আজও বঞ্চিত। উন্নত পৃথিবীর স্বপ্ন তখনই সফল হবে যখন সব শিশুকে শিক্ষার আঙিনায় নিয়ে আসতে পারা যাবে। তাই সাক্ষরতার প্রসার প্রয়োজন। এ ছাড়া মানুষ কোনও কিছু পড়তে বা জানতে পারবে না। সচেতনও হতে পারবে না। ফলে উন্নত সমাজ গড়ার যে স্বপ্ন আমাদের পূর্বজরা দেখেছিলেন তা ব্যর্থ হয়ে যাবে।
অভিজিৎ দত্ত, জিয়াগঞ্জ, মুর্শিদাবাদ
শোচনীয়
পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষা ও শিক্ষকদের আজকের এই শোচনীয় অবস্থা হত না যদি দৃঢ় শাসনব্যবস্থার পাশাপাশি দুর্নীতি-বিরোধী অদম্য মানসিকতার প্রভাব থাকত। পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতির জঞ্জাল এক দিনে তৈরি হয়নি। বছরের পর বছর প্রশ্রয়, দায়িত্বহীনতা এবং শিক্ষা ও শিক্ষকের প্রতি অশ্রদ্ধাই আজকের লজ্জাজনক পরিস্থিতি তৈরি করেছে। রাশি রাশি টাকার বিনিময়ে চাকরি পাইয়ে দেওয়া বন্ধ করা কঠিন ছিল না— যদি প্রশাসনের সেই সদিচ্ছা থাকত। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, ঘনিষ্ঠজন ও বেশি ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধির আবদারকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে প্রশাসনিক দায়িত্বের উপরে।
যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার যথার্থ মূল্যায়ন ছাড়া শিক্ষাব্যবস্থার এই অধোগতি অনিবার্য ছিল। আরও দুর্ভাগ্যের বিষয়, আমরা অতীত ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে পারিনি কিংবা নিতে চাইনি। শিক্ষাব্যবস্থার অধিকর্তাদের দায়িত্বও সমান, কারণ আজ যোগ্য শিক্ষকদের আবার প্রমাণ করতে হচ্ছে তাঁরা যোগ্য, না কি অযোগ্য। বিলম্বিত ফল প্রকাশের ফলে মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা অন্য রাজ্যে চলে যাচ্ছে, আর আমরা হাত গুটিয়ে বসে আছি। তিন দশকেরও বেশি সময় যাঁরা আমাদের সর্বনাশের পথে নামিয়ে এনেছিলেন, তাঁদের বিদায় দিয়ে আমরা পরিবর্তনের আশায় ভোট দিয়েছিলাম। কিন্তু খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, শিল্প— সব ক্ষেত্রেই আজ নিরাশা ও অনিশ্চয়তা ভয়ঙ্কর ভাবে বিরাজ করছে। দক্ষিণের রাজ্যগুলি বিনিয়োগ ও উন্নয়নের দিক দিয়ে এগিয়ে চলেছে, আর আমরা কেবল টিভির বিতর্কে শুনে যাচ্ছি— “এই অব্যবস্থা আগের সরকারেও ছিল”— এ যেন দায়সারা মনোভাবের অজুহাত। অথচ, এই দায়িত্বপ্রাপ্তদের নির্বাচিত করা হয়েছিল পরিবর্তনের প্রত্যাশায়, উন্নয়নের প্রতিশ্রুতিতে।
অলোক কুমার মুখোপাধ্যায়, সোদপুর, উত্তর চব্বিশ পরগনা
কাশবন
সুদীপ ঘোষের ‘কাশফুলের বনে মুগ্ধ কিশোরী’ (৩-৯) চিত্রটি দেখে মুহূর্তে মন ছুটে গেল পল্লি-প্রকৃতির মেঠো আঙিনায়। বিমুগ্ধ আমরাও, যারা গ্রাম-বাংলায় বন্ধনহীন শৈশব-কৈশোর কাটিয়ে এসেছি। কাশফুল খুবই নরম, সাদা এবং তুলোর মতোই তুলতুলে। মাথা তোলে নদীতট কিংবা পরিত্যক্ত জমিতে। কাশফুল শরতের প্রতীক। বর্ষা শেষে কাশের হাত ধরেই এক রকম চুপিচুপি এসে পড়ে শরৎকাল। আর এই শরতের শ্বেতশুভ্র কাশফুলই জানান দেয়, দেবী দুর্গার বোধনের সময় আসন্ন... বঙ্গবাসীর মনোবীণায় বেজে ওঠে আগমনী সুর।
অযত্ন আর অনাদরে গজিয়ে ওঠা কাশফুল কাব্য-সাহিত্য-চলচ্চিত্রকেও করেছে সমৃদ্ধ। ‘আমাদের ছোট নদী’-তে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন— “চিক্ চিক্ করে বালি, কোথা নাই কাদা,/ একধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা।” আবার বিশ্ববন্দিত চলচ্চিত্র-পরিচালক সত্যজিৎ রায় কথা-সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত পথের পাঁচালী চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য গ্রহণে দলবল নিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন শহর থেকে দূরে, বিস্তীর্ণ এক মনোরম কাশবনে। যে কাশবনের বুক চিরে ছুটে চলেছিল সেই সময়ের রেলগাড়ি। কাশবনে ঘুরে বেড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে পথের পাঁচালী-র দুই কেন্দ্রীয় চরিত্র অপু-দুর্গা অপার বিস্ময়ে ডাগর নবীন চোখে প্রত্যক্ষ করেছিল রেলগাড়ির চলা!
কাশ বড় ক্ষণস্থায়ী। ঢাকে বিসর্জনের কাঠি পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে শরৎও বিদায় নেয় চুপিসারে। আর শিশির-ভেজা হেমন্তের হিমেল হাওয়ায় ঝরে যায় রাশি রাশি কাশফুল।
ভানুপ্রসাদ ভৌমিক, ডানকুনি, হুগলি
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)