‘তক্তপোশে স্কুলের পাঠ’ (৩১-৩) শীর্ষক স্বাতী ভট্টাচার্যের প্রবন্ধটি ঘুণ ধরা পরিমণ্ডলে এক আলোর দিশা। পিছিয়ে থাকা পুরুলিয়া জেলার পাঁচ-ছ’টি ব্লকে শিক্ষার হালহকিকত প্রবন্ধটিতে উঠে এসেছে। উঠে এসেছে এক দিকে সরকারি আর অন্য দিকে বেসরকারি আবাসিক স্কুলের পঠনপাঠনের পারস্পরিক সম্পর্কের রসায়ন। একটাই লম্বাটে ঘর, এ-মাথা থেকে সে-মাথা অবধি তক্তপোশ, পেরেক বিদ্ধ দেওয়ালে জামা থেকে মনীষীদের ছবি, তক্তপোশের কোণে বইখাতা ঠাসা, কালিওঠা ব্ল্যাকবোর্ডে কেমিস্ট্রির ফর্মুলা। এই সবই আমাদের ফেলে আসা শৈশব। উপরোক্ত বেসরকারি আবাসিক স্কুলটির পড়ুয়ার সংখ্যা ৪৭ জন। আনাজ বিক্রেতা সুচাঁদ মাহাতো হয়তো শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত, কিন্তু তিনি বুঝেছেন যাদের নিয়ে স্বপ্ন দেখা সেই সন্তানদের বেঁচে থাকার একমাত্র পথ শিক্ষা। তাই ছেলে ও মেয়েকে মাসে চার-পাঁচ হাজার টাকা খরচেও হস্টেলে রাখতে বাধ্য হচ্ছেন।
এর কারণ কী? সরকারি স্কুলের শিক্ষকমাত্রেই কি কর্মবিমুখ? আসলে সমগ্র শিক্ষককুলের অবমাননা করা হচ্ছে, অপাঙ্ক্তেয় করে তোলা হচ্ছে। কারণ— প্রথমত, সরকারি স্কুলে অপ্রতুল শিক্ষক-সংখ্যা। বিশেষ করে বিষয়-শিক্ষকের বড় অভাব। কিন্তু বেসরকারি স্কুলে এই সমস্যা অনেকটাই কম। দ্বিতীয়ত, সরকারি স্কুলে পড়ুয়াদের নিয়মিত স্কুলে উপস্থিত না হওয়া। বেসরকারি স্কুলে সেই প্রবণতা অনেক কম। তৃতীয়ত, সন্তান বাড়িতে থাকার জন্য দরিদ্র পরিবারে বাবা-মা নানান কাজে-কর্মে যুক্ত হতে বাধ্য করে— “পড়ে কী আর হবে”— এমন ধরনের ভাবনা! আর হস্টেলে থাকলে শুধু পড়াশোনা আর খেলার জগতে বড় হয়ে ওঠা। চতুর্থত, সরকারি স্কুলে লম্বা ছুটির বহর, কিন্তু বেসরকারি স্কুল ছুটি দিতে বাধ্য নয়। সরকারি নির্দেশও তারা সব সময় মান্যতা দেয় না।
আজ সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও কেন বিকল্প হয়ে উঠছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো, তা সরকারকেই ভাবতে হবে। তবে আশার আলো, আজও প্রতীচীর মতো নানান অসরকারি সংস্থা, কৌশিক বসু, অমর্ত্য সেনদের মতো শিক্ষক ও শিক্ষানুরাগীর সৌজন্যে লালিতপালিত হওয়ায় শিক্ষাব্যবস্থা একেবারে অন্ধকারে ডুবে যায়নি। আজও শিক্ষককুলের এক বড় অংশ অবসরের পর সারা জীবনের অর্জিত অর্থের একটা মোটা অঙ্ক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দান করেন বলেই টিমটিম করে হলেও তা বেঁচে আছে।
সূর্যকান্ত মণ্ডল, কলকাতা-৮৪
শিক্ষার দায়িত্ব
স্বাতী ভট্টাচার্য ‘তক্তপোশে স্কুলের পাঠ’ প্রবন্ধে পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার বাস্তব চিত্র এমন ভাবে তুলে ধরেছেন, যা যে কোনও সমাজ সচেতন মানুষের মনকে নাড়া দেবে। সব দেখেশুনে মনে হয়, এ রাজ্যে সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার পঞ্চত্বপ্রাপ্তি এখন যেন শুধুই সময়ের অপেক্ষা। তবে কি সুশিক্ষার অভাবে পঙ্গু হয়ে যাবে এ রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ? এই আশঙ্কার হাত থেকে নিজেদের বাঁচাতে সুচাঁদ মাহাতোর মতো আনাজ বিক্রেতারাও অত্যন্ত কষ্ট করে বহু অর্থ ব্যয় করে ছেলেমেয়েদের বেসরকারি আবাসিক স্কুলে পড়তে পাঠাচ্ছেন। ফলে কোথাও সরকারি স্কুলের শিক্ষক, কোথাও স্থানীয় শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিবর্গ, কোথাও শিক্ষিত বেকার যুবক-যুবতীদের উদ্যোগে বেসরকারি আবাসিক স্কুলের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে।
সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার পরিপূরক হিসেবে এই উদ্যোগ এক দিকে যেমন ছাত্র-ছাত্রীদের ভবিষ্যতে সফল হওয়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছে, অন্য দিকে তেমনই অভিভাবকদের মনেও জোগাচ্ছে ভরসা। ঠিক এই কারণেই ওই স্কুলগুলিতে বেড়ে চলেছে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা। যে সকল অভিভাবকের অভাব নিত্যসঙ্গী, তাঁরাও নিজের ছেলেমেয়েদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বার্থে ভাল স্কুলের খোঁজ করছেন। স্বাধীনতার আগে ও পরে এই রাজ্যের জেলায় জেলায় বহু প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল স্থানীয় মানুষের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছিল। জনশিক্ষার প্রসারের স্বার্থে এক সময় পশ্চিমবঙ্গের সরকারের শিক্ষা দফতর সেই স্কুলগুলিকেই অনুমোদন দিয়ে সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলে পরিণত করেছিল। দুর্ভাগ্যের বিষয়, সেই স্কুলগুলি সরকারের অবহেলায় ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কোথাও উপযুক্ত শিক্ষকের অভাব, কোথাও অভাব ছাত্রছাত্রীর। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের রায়ে দুর্নীতির অভিযোগে প্রায় ছাব্বিশ হাজার শিক্ষকের চাকরি বাতিল হয়ে যাওয়ার পর বহু স্কুল তো বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। স্থায়ী পদে শিক্ষক নিয়োগ না হলে, কত দিন আর প্যারা টিচারের ভরসায় স্কুল খোলা রাখা সম্ভব হবে? শিক্ষা দফতরের এ সব কাণ্ডকারখানা দেখে আরও বেশি অভিভাবক সরকারি স্কুলের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলছেন। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দলে দলে শিক্ষা-ব্যবসায়ী শহর, শহরতলি-সহ প্রত্যন্ত গ্রামীণ এলাকাতেও ঝাঁ-চকচকে স্কুলবাড়ি নির্মাণ করে শিক্ষা-ব্যবসায় নেমে পড়েছেন। ফলে পশ্চিমবঙ্গে এখন তিন ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত— ১) সরকার পরিচালিত অবৈতনিক শিক্ষাব্যবস্থা, ২) বেসরকারি উদ্যোগে পরিচালিত মুনাফাকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা, ৩) সেবার মানসিকতা নিয়ে সামাজিক উদ্যোগে পরিচালিত বেসরকারি আবাসিক শিক্ষাব্যবস্থা।
বেসরকারি স্কুলে ইংরেজি শিক্ষার মোহে প্রলুব্ধ হয়ে যে সমস্ত ছাত্রছাত্রী মাতৃভাষা প্রায় ভুলে যেতে বসেছে, ওরা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে পৌঁছবে, সে উত্তর জানা নেই। কিন্তু সমস্ত প্রতিকূলতা এড়িয়ে দরিদ্র পরিবারের ছেলে-মেয়েদের মেধার অপচয় রোধ করার দায়িত্ব আমরা অস্বীকার করতে পারি না। সরকার যখন নিজের দায়িত্ব থেকে হাত সরিয়ে নেয়, তখন তো সামাজিক উদ্যোগকেই দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে হয়।
রতন রায়চৌধুরী, পানিহাটি, উত্তর ২৪ পরগনা
ছন্নছাড়া
‘তক্তপোশে স্কুলের পাঠ’ প্রবন্ধে এ রাজ্যের, বিশেষ করে অনুন্নত পুরুলিয়া এবং বাঁকুড়ার শিক্ষাক্ষেত্রের দৈন্যদশাটি তুলে ধরা হয়েছে। এক দিকে সরকারি স্কুলগুলিতে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা অনুসারে পর্যাপ্ত শিক্ষক-শিক্ষিকার অভাব, এবং এক শ্রেণির শিক্ষকের পঠনপাঠনের ব্যাপারে উদাসীন মনোভাবের ফলে প্রত্যন্ত গ্রামের স্কুলগুলি আজ পড়াশোনার ক্ষেত্রে দুর্বল হয়ে পড়েছে। বরং শিক্ষার উন্নয়ন ও প্রসারের জন্য বহু শিক্ষা-অনুরাগী এগিয়ে এসে উদ্যোগ নিয়ে আবাসিক স্কুল তৈরি করেছেন। আবার বহু আবাসিক স্কুলের উদ্যোক্তারা তাঁদের ছাত্রছাত্রীদের সরকারি স্কুলে নাম নথিভুক্ত করে তাদের কাছ থেকে পড়াশোনা, থাকা-খাওয়ার খুব কম অনুদান নিয়ে দিনরাত তাদের পিছনে পরিশ্রম করে মানুষ গড়ার কারিগর হিসাবে নিজেদের সমর্পণ করেছেন। অনেক আবাসিক স্কুলের উদ্যোক্তারা দরিদ্র ও মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের ‘নবম-দশম’ পর্যন্ত পড়িয়ে পার্শ্ববর্তী মাধ্যমিক কিংবা উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলগুলি থেকে মাধ্যমিকে বসিয়ে ভাল ফলাফল পেয়েছেন। অথচ, সরকারি স্কুলের পরীক্ষার্থীরা একাধিক টিউশনি নিয়েও ফলাফলের আঙ্গিকে পিছিয়ে পড়েছে।
যেখানে রাজ্য সরকার ক্লাব, খেলা, মেলা, উৎসব থেকে শুরু করে বিভিন্ন অনুদান প্রকল্পে কোটি কোটি টাকা খরচ করছে, সেখানে সরকার এই আবাসিক শিক্ষাকেন্দ্রগুলির উন্নয়নের জন্য বাৎসরিক মোটা টাকা অনুদান দিলে হয়তো এ রাজ্যে এক সমান্তরাল শিক্ষার প্রসার ঘটত। বর্তমানে সরকারি স্কুলগুলিতে পর্যাপ্ত শিক্ষকের অভাব, ছুটির বহর, এবং স্কুলছুটের সংখ্যাবৃদ্ধির ফলে ছেলে-মেয়েদের শিক্ষাজীবন নিয়ে সকলে চিন্তিত। তাই তাঁরা বিকল্প হিসাবে আবাসিক স্কুলগুলিতে সাধ্যমতো খরচের মাধ্যমে ভিড় জমাচ্ছেন। রাজ্যের ছন্নছাড়া শিক্ষাব্যবস্থায় গ্রামীণ দরিদ্র ও মেধাবী ছেলে-মেয়েদের শিক্ষা দানের জন্য জেলার আবাসিক স্কুলগুলির উপর গুরুত্ব দেওয়া সরকারের আশু প্রয়োজন।
তপন কুমার বিদ, বেগুনকোদর, পুরুলিয়া
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)