পুজো আসছে পুজো আসছে— ভাবটা চিরকালই বেশি ভাল লাগে। তাই দেবীপক্ষ যত কাছে আসে তত মনের মধ্যে ঢাকের শব্দ আর মুখখানি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এমনই এক সময়ে, মহালয়ার কিছু দিন আগে স্বাতী ভট্টাচার্যের কলমে পড়লাম ‘মায়ের গল্প, গল্পের মা’ (রবিবাসরীয়, ১৪-৯)। প্রবন্ধটি পুজোর আকর্ষণ আরও বাড়িয়ে দিল যেন।
লেখিকা শারদোৎসবের সে কাল, এ কাল, পৌরাণিক ইতিহাসে দুর্গোৎসবের স্থান নিয়ে বিশদে আলোচনা করেছেন। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের গরিবদের শারদোৎসবে শামিল হওয়ার অক্ষমতা সংক্রান্ত কিছু ঘটনার উল্লেখ করে পাঠককুলকে অশ্রুসজল করেছেন। মনে করিয়েছেন, ব্রিটিশ শাসনকালে জমিদার বাড়িতে কেবল দুর্গোৎসব হত না, সঙ্গে হত যাত্রা, নাচগান। তবে সাহেবদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা, ও খানাপিনার আয়োজনও থাকত। আবার বিশেষ মজলিসও বসত, নর্তকীরা আসতেন। উদ্দেশ্য ছিল, সাহেবদের খিদমতগিরি করে জমিদার বাবুদের খেতাব বাগানো।
এ বার শারদোৎসবের সঙ্গে জড়িত নানা কিংবদন্তি আলোচনা করা যাক। পৌরাণিক তথ্য অনুযায়ী রামচন্দ্র সর্বপ্রথম অকালবোধন করে দুর্গাপূজা করেছিলেন। শোনা যায়, পারিবারিক দুর্গাপুজোর সূচনা হয় সাবর্ণ রায়চৌধুরীর বাড়িতে, তার পর অন্য রাজবাড়ি, এবং অন্যান্য বিত্তশালী পরিবারের পারিবারিক পূজা হিসাবে প্রচলন বাড়ে! ধীরে ধীরে অবস্থার পতন হলে পরিবারগুলি এই পূজা বন্ধ করে দেয়। তার পর কালে কালে সর্বজনীন শারদোৎসবের সূচনা হয়।
লেখিকা যথার্থ বলেছেন, দুর্গোৎসব এখন মিলনমেলা এবং থিম-সর্বস্ব, অঢেল আনন্দ, খাওয়াদাওয়া প্রধান হয়েছে। শারদোৎসবের একটি অর্থনৈতিক দিক আছে। প্রচুর মানুষ শ্রমের বিনিময়ে ক’দিন বেশ লাভের মুখ দেখে। তবে, এর সঙ্গে বারোয়ারি পূজাগুলিতে অর্থের বিনিয়োগ আকাশছোঁয়া হয়েই চলেছে। সত্যি বলতে, তার উৎস খুব সুস্পষ্ট নয়। এর সঙ্গে শুধু শারদোৎসব কেন, আমরা এ কথা বলতে পারি, যে কোনও পূজা-পার্বণের পৌরাণিক ইতিহাস এখন মানুষ বিস্মৃত হয়েছে। কালজয়ী ছবিতে প্রতিমা নির্মাণের সময়, মা দুর্গার অসুর নিধন নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিল ছোট্ট ছেলেটি। তখন যিনি প্রতিমা গড়ছিলেন, তিনি বলেছিলেন, মুনি-ঋষিরা বলে গেছেন, মিথ্যা বলি কী করে! প্রবন্ধ লেখিকা এমন আরও অনেক ঘটনা উল্লেখ করেছেন, সে প্রসঙ্গে গেলাম না। বয়স্করা এখনও বলেন, উৎসবের পার্বণের সময় আনন্দের সঙ্গে পৌরাণিক ইতিহাসকেও মনে রাখা ভাল। তা আমাদের লোক-ঐতিহ্য।
সুবীর ভদ্র, কলকাতা-১৫১
স্বচ্ছতা জরুরি
সম্পাদকীয় প্রবন্ধ ‘জরুরি নির্দেশ’ (২০-৮) প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা এবং প্রশ্ন। কোনও রাখঢাক না করেই বলা যায় যে ভোটে জিততে রাজনৈতিক দলগুলি কিছু না কিছু জল মেশাবার উপায় খুঁজতে থাকে, বিরোধীদের হাজারো অভিযোগকে পাত্তা না দিয়ে দিনের শেষে সফল প্রয়োগে তারা গর্বিতও হয়। কোথাও ছাপ্পা, বুথ জ্যাম, নকল ভোট এই সব অভিযোগ বিরোধীরা করেই থাকেন। কিন্তু ভোটার তালিকা নিয়ে দেশের রাজনীতি কোনও দিন এত আলোড়িত হয়নি। এ বারে এত আলোড়নের কারণ, মনে করা হচ্ছে যে, সব বিরোধী ভোটারের নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার একটা পরিকল্পনা চলছে।
বিহারে ৬৫ লক্ষ ভোটারের নাম তালিকা থেকে বাদ গিয়েছে। কিন্তু ৬৫ লক্ষ মানুষের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে এ কথা কি সত্য? কারণ ২০ লক্ষ শোনা যাচ্ছে মৃত ভোটার। তাঁদের ভোটাধিকারের কোনও প্রশ্নই আসে না, তা ছাড়া যে ভোটারদের দু’জায়গায় ভোট আছে তাঁদের এক জায়গার তালিকা থেকে নাম বাদ গেলে কি সত্যি কারও নাগরিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়? প্রশ্ন থেকেই যায়।
অনেক সময় বড় বড় নেতাও ভুল অভিযোগ করে থাকেন। কিন্তু ভোটার তালিকা যে ত্রুটিমুক্ত নয়— শাসক বিরোধী এ কথা সবাই কম বেশি মেনে নেন। তবে, এর জন্য কোনও আমলেই নির্বাচন কমিশন তার দায় অস্বীকার করতে পারে না। শুধু পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে যদি বিচার করা যায় দেখা যাবে এক কালে ভোটার তালিকায় নাম সংযোজনের সময় নেতারা দাঁড়িয়ে থেকে তালিকায় নাম তোলাতেন। বয়সের নথির কোনও বালাই ছিল না, বর্তমানেও এই প্রথা প্রকারান্তরে, অন্য ভাবে চালু আছে বলেই অনেকের দাবি।
রাজনৈতিক দল সব সময় চাইবে নিজের ভোটব্যাঙ্ক সমৃদ্ধ করতে। ভোটার তালিকা থেকেই তাই নানা রকম ছল শুরু আর গণনার কারচুপি দিয়ে ছলনা শেষ।
তবে এ কথাও বুঝতে হবে যে, কমিশন একা তালিকা তৈরি করে না, প্রতিটা রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট জায়গায় উপস্থিত থেকে তালিকায় সংযোজন বা বিয়োজনের তালিকা জমা করতে হয়। এর পর সংযোজন হয়তো হয়ে যায়, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে যে বিয়োজন হয় না। রাজ্যের প্রতিটা বুথের ভোটার তালিকা পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে ৩০-৪০ জন মৃত ভোটার, এবং ভুয়ো ভোটার।
দরকার প্রচার, এবং নির্বাচন কমিশনের সদিচ্ছা, দেখতে হবে যে কোনও এক জনও যোগ্য ভোটার যেন তালিকা থেকে বাদ না পড়েন। তার জন্য সব পক্ষকে ওয়াকিবহাল থাকতে হবে। একই সঙ্গে প্রশ্ন তোলা দরকার যে, এক ব্যক্তির অনেকগুলি ভোট, জাল ভোটার কার্ড— এগুলো বন্ধ হওয়া কি কাম্য না? যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর কথাই ধরলে সবার মিলেমিশে বিষয়টিতে অগ্রসর হওয়া উচিত। তাতে সব পক্ষের ও ভোটারদের সুবিধা। ভোটার তালিকা স্বচ্ছ হোক এটাই কাম্য।
স্বপন চক্রবর্তী, জগৎবল্লভপুর, হাওড়া
প্রশ্ন উঠবেই
‘সাভারকরের ছবি, বিক্ষোভ কংগ্রেসের’ (১৭-৮) শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে জানা গেল, এ বারের স্বাধীনতা দিবসে কেন্দ্রীয় পেট্রলিয়াম প্রাকৃতিক গ্যাস মন্ত্রকের প্রচারিত পোস্টারে মহাত্মা গান্ধী, ভগৎ সিংহ, সুভাষচন্দ্র বসুর ছবির সঙ্গে একই ফ্রেমে স্থান পেয়েছে বিনায়ক দামোদর সাভারকরের ছবি।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে সাভারকরের ভূমিকা যে বরাবরই বিতর্কিত। এর কিছু কারণ আছে। অভিযোগ ওঠে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলনকে দেশের পক্ষে ক্ষতিকারক এবং প্রতিক্রিয়াশীল মনে করত সব সময় সাভারকরদের আরএসএস। তাই তাঁরা দেশকে স্বাধীন করার কর্মসূচি থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন। ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালা বাগ হত্যাকাণ্ডের পরেও আরএসএস ব্রিটিশদের সরকারের পক্ষে সহনশীল মনোভাব দেখিয়েছিল। অসহযোগ আন্দোলনে গোটা দেশ যখন উত্তাল হয়ে উঠেছিল এবং নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ-সহ অনেক নেতা-কর্মীকে আটক করা হয়েছিল, অনেকেরই জানা যে সেই সময় আরএসএসের পক্ষ থেকে কিন্তু এই অসহযোগ আন্দোলনকে ‘অশুভ শক্তির জাগরণ’ বলে কটাক্ষ করা হয়েছিল।
আজকাল দেখা যাচ্ছে শাসকদের পক্ষ থেকে তাঁদের দলের ভাষণেও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতাদের সঙ্গে সাভারকরের নামটা সুকৌশলে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। সাভারকরকে নিয়ে গেরুয়া দলের নেতাদের উন্মাদনা থাকলেও অনেকের কাছেই সাভারকর এখনও তেমন গ্রহণযোগ্য নাম নয়। এ কথাও শোনা যে, আন্দামান সেলুলার জেলে বন্দি থাকাকালীন অবস্থায় একাধিক বার ব্রিটিশ সরকারের কাছে মুক্তি ভিক্ষা চেয়ে মুচলেকা দিয়েছিলেন। মুক্তির বিনিময়ে ব্রিটিশ সরকারকে সর্বপ্রকার সাহায্য করতেও নাকি তিনি যে প্রস্তুত সে কথা জানাতে দ্বিধা বোধ করেননি। তাই হিন্দুত্ববাদী এই নেতাকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত এক জন জাতীয়তাবাদী নেতা হিসাবে গ্রহণ করা কতটা যুক্তিযুক্ত সে বিষয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।
রতন চক্রবর্তী, উত্তর হাবড়া, উত্তর ২৪ পরগনা
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)