সন্দীপন নন্দীর ‘একটি চিঠির আশায় জীবন’ (২৯-৫) শীর্ষক প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। কবি জয় গোস্বামী তাঁর ‘নুন’ কবিতায় লিখেছেন, “আমরা তো অল্পে খুশি,/ কী হবে দুঃখ করে?/ আমাদের দিন চলে যায়/ সাধারণ ভাতকাপড়ে/... মাঝে মাঝে চলেও না দিন/ বাড়ি ফিরি দুপুররাতে;/ খেতে বসে রাগ চড়ে যায়/ নুন নেই ঠান্ডা ভাতে।” বাস্তব চিত্রটা আর একটু বোধ হয় অন্য রকম। কবি সমাজের যে স্তরের দুঃখকষ্টের কথা তাঁর কবিতায় তুলে ধরেছেন, সেই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে আমরা প্রায় প্রত্যেকেই কিছুটা পরিচিত। কিন্তু জানি না যেটা, সেটা হল— এই প্রান্তিক জনগণের ঠিক উপরের স্তরে বসবাসরত অগণিত জনসাধারণের কথা, যাঁরা বাস্তবে চরম দারিদ্রের মধ্যে জীবনযাপন করেও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেন না। কারণ, সামাজিক পরিমণ্ডলে নিজের ‘স্টেটাস’ ধরে রাখার একটি অসম প্রতিযোগিতা তাঁদের অজানতেই ক্রিয়াশীল থাকে।
সম্ভবত এই শ্রেণির প্রতিনিধিদের মধ্যেই পড়েন প্রবন্ধে উল্লিখিত ‘ডেলি রেটেড ওয়ার্কার’ বা সংক্ষেপে ‘ডিআরডব্লিউ’। দিনের পর দিন সরকারি কাজকর্মে এঁরা সহায়তা প্রদান করে যান, বেতন কাঠামোর বাইরে থেকেই। সামনে ঝোলানো থাকে ললিপপ— এক দিন হাতে আসবে স্থায়ী হওয়ার নিয়োগপত্র। প্রবন্ধটি পাঠ করে আমরা যারা প্রতিনিয়ত সরকারি দফতরে যাই, তারা এই সমস্ত কর্মচারীর অবস্থাটি হৃদয়ঙ্গম করতে পারি। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের গেরোয় আটকে থাকা এই কর্মীরাই দফতরের অক্সিজেন। অথচ, সংশ্লিষ্ট দফতরের কেষ্টবিষ্টুদের কাছে এঁরা বহিরাগত। বেসরকারি সংস্থার মতো চাকরি চলে যাওয়ার আতঙ্কে প্রতি দিন রক্তচাপ বাড়তে থাকে।
সরকারি দফতরে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে যাঁরা কাজ করেন, কিংবা কম্পিউটারের মাধ্যমে সরকারি দফতরে যাঁরা ডেটা এন্ট্রি অপারেটর হিসেবে কাজ করেন, তাঁরা প্রত্যেকেই ঠিকা কর্মচারী। কাজের দায়িত্ব পালন করতে হবে পুরোদমে, পান থেকে চুন খসলে চলবে না। বড়বাবুদের কথার খেলাপিও না। কিন্তু মাসের শেষের দিকে বেতন হিসেবে যা হাতে আসবে, সেটা দিয়ে সংসার চালানো দায় হয়ে ওঠে। অবশ্য সরকারের একটি বাড়তি সুবিধা রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলি যেমন এঁদের দিয়ে সহজেই সম্পন্ন হয়, তেমনই দায় নেওয়ার বিষয়টিও স্বচ্ছন্দে এড়িয়ে যাওয়া যায়।
ব্যয় সঙ্কোচন নীতির ঘেরাটোপে সরকারি দফতরে এখন ঠিকা কর্মী নিয়োগের একটি ধারা চলছে। এর ভালমন্দ বিচারের দায় আমাদের নয়। কিন্তু সরকারি সুবিধাপ্রাপ্ত আধিকারিক যাঁরা আছেন, তাঁদের বোঝা উচিত উচ্চমানের শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন এই ঠিকা কর্মীরাও মানুষ। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, অর্থ, খাদ্য— সব দফতরের কাজের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ঠিকা কর্মীদের প্রয়োজন হয়। ‘জব সিকিয়োরিটি’ না থাকলে কাজের প্রতি কত ক্ষণ তাঁরা দায়িত্ববান থাকতে পারবেন? প্রায়শই শোনা যায়, সরকারি কর্মচারীদের যা বেতনকাঠামো, তা দিয়ে নাকি তিন-চার জন অথবা তার চেয়েও বেশি ঠিকা কর্মী নিয়োগ করা যায়। অথচ, বেতন প্রদানের সময় সরকার সেই সহজ সত্যটি উপলব্ধি করতে পারে না। এর বিপরীতে আছে রাজনৈতিক বিধায়ক, সাংসদ, মন্ত্রীদের বছর বছর বেড়ে যাওয়া ভাতা, সরকারি সুযোগসুবিধা।
শেষ করব ‘নুন’ কবিতাটির শেষ পঙ্ক্তিটি উল্লেখ করে। “আমরা তো সামান্য লোক।/ আমাদের ভাতের পাতে/ লবণের ব্যবস্থা হোক!” লবণটি প্রতীকী। খেয়ে-পরে ছেলেমেয়েদের উপযুক্ত শিক্ষার ব্যবস্থা করে সমাজের অসম প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারার জন্য যেটুকু প্রয়োজন, সেটুকু নিয়ে যেন সরকার ভাবনাচিন্তা করে।
রাজা বাগচী, গুপ্তিপাড়া, হুগলি
আলোর ঘটা
পথ-নিরাপত্তার ক্ষেত্রে পথবাতির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পথবাতি সংক্রান্ত বিভিন্ন রকম সমস্যা কমবেশি সব এলাকাতেই আছে। কোথাও পথবাতি নেই, কোথাও থাকা সত্ত্বেও নিয়মিত জ্বলে না, কোথাও দুষ্কৃতীদের দ্বারা বাতিগুলি বার বার ভেঙেচুরে যায় ইত্যাদি। কিন্তু এই সমস্যাগুলি যদি মুদ্রার এক পিঠ হয়, তা হলে বিপরীত পিঠে অন্য রকমের সমস্যা রয়েছে, যা গত কয়েক বছরে অত্যন্ত প্রকট হয়ে উঠেছে।
কলকাতা পুর এলাকায় এখন এমন কোনও রাস্তা বোধ হয় নেই, যে রাস্তায় পথবাতি নেই। বেশির ভাগ পথবাতি এখন এলইডি প্রযুক্তিনির্ভর। এই প্রযুক্তির বাতিতে এক দিকে যেমন আলোর উজ্জ্বলতা অনেক বেশি, অন্য দিকে বিদ্যুৎ খরচ বেশ কিছুটা কম। ফলে এই বাতির ব্যবহার সব দিক থেকেই লাভজনক। কিন্তু বড় রাস্তা থেকে গলিপথ সর্বত্র পথবাতিগুলোর মধ্যে ব্যবধান অত্যন্ত কম। অনেক জায়গায় পর পর দুটো বাতির দূরত্ব কুড়ি থেকে ত্রিশ মিটারের মধ্যে থাকে। এত ঘন ঘন পথবাতি জ্বালানোর কোনও যৌক্তিকতা নেই। মোটামুটি পঞ্চাশ মিটার থেকে আশি মিটার দূরত্বে একটা করে পথবাতি জ্বললে তা সকলকেই যথেষ্ট নিরাপত্তা দেবে।
দ্বিতীয়ত, পথবাতিগুলোর আলোর তীব্রতা পথের পক্ষে অনেক বেশি। এত আলো পথচারীদের সাধারণত প্রয়োজন হয় না। উপরন্তু এই তীব্র আলো পথ সংলগ্ন বাড়ির বাসিন্দাদের, বিশেষত একতলা ও দোতলার বাসিন্দাদের রাতের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটার অন্যতম বড় কারণ। ঘরে এসি থাকলে দরজা-জানলা বন্ধ করে ঘুমোনো সম্ভব। কিন্তু এসি না থাকলে জানলা বন্ধ করে বা মোটা পর্দা লাগিয়ে ঘুমোনো নিশ্চয়ই সম্ভব নয়। তাই পথবাতির আলোর তীব্রতা অবশ্যই কমাতে হবে। বাতির ক্ষমতা এইটুকু হলেই চলবে যাতে রাস্তার খানাখন্দ দেখা যায় ও কাছাকাছি থাকা মানুষজনকে স্পষ্ট ভাবে দেখা যায়। তা হলে বিদ্যুৎ খরচও কিছুটা কমতে পারে। তৃতীয়ত, এত বেশি সংখ্যক তীব্র আলোর পথবাতি পশুপাখিদের জন্যও যথেষ্ট বিরক্তি ও কষ্টের কারণ। তবে এ নিয়ে আমাদের বেশির ভাগ মানুষ বা প্রশাসনের কোনও মাথাব্যথা নেই। রাস্তায় আলো না থাকা বা প্রয়োজনের তুলনায় কম আলো থাকার বহু অভিযোগ অনেক বছর ধরে প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিরা পেয়ে আসছেন ও সেগুলো সমাধানের চেষ্টা করে আসছেন। কিন্তু রাস্তায় অতিরিক্ত আলো থাকার অভিযোগ তাঁরা এর আগে পেয়েছেন কি না, সন্দেহ। আগামী দিনে তাঁরা এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করবেন, এমনটাই আশা।
ইন্দ্রনীল ঘোষ, লিলুয়া, হাওড়া
প্রাণ দিয়ে
সৃজন ভট্টাচার্যের ‘তবু শেষ সত্য নয়’ (২-৬) প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে এই চিঠি। দেশের হয়ে লড়াইয়ের ময়দানে নামা এক জন সেনার কোনও জাত বা ধর্মীয় পরিচয় থাকে না। সব পরিচয় সরিয়ে রেখেই, দেশের হয়ে সেনার পোশাক পরতে হয়, ভারতভূমির মর্যাদা রাখতে জীবন পণ করতে হয় তাঁকে। এক জন সেনা রণাঙ্গনে নিহত হলে তাঁকে শহিদের সম্মানে বরণ করে নেওয়ার রীতি প্রচলিত। পহেলগাম জঙ্গি হামলার পরবর্তী সময়ে ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষে শহিদ হলেন ঝন্টু আলি শেখ। তাঁর মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর কাঁদতে কাঁদতে তাঁর বাবা বললেন, এ বার প্রমাণ হল তো আমরা কোন দিকে?
এই কথা মন ছুঁয়ে যায়। এ আমরা কোথায় চলেছি? এক জন সংখ্যালঘু মানুষকে নিজের দেশকে ভালবাসার প্রমাণ দিতে গেলে শহিদ হওয়ার মতো চরম মূল্য দেওয়া ছাড়া পথ থাকে না? কফিনবন্দি তাঁর নিথর দেহ যখন নদিয়ার গ্রামের বাড়ি ঢুকল, ভিড় উপচে পড়ল তাঁকে বীরের শ্রদ্ধা জানাতে। কিন্তু সে ভাবে চোখে পড়ল না একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের উপস্থিতি। আসলে আমাদের আজন্ম পরিচিত হিন্দু ধর্মের ধারার সঙ্গে বিজেপি, আরএসএস প্রচারিত ‘হিন্দুত্ব’-এর ফারাক অনেকটাই। তাই আগামী দিনে বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, অসম, তামিলনাড়ু, কেরলের নির্বাচনের সামনে দাঁড়িয়ে শান্তি, সম্প্রীতির জল ছড়ানো কেন্দ্রীয় শাসক দল যে ভাল চোখে নেবে না, সেটা প্রত্যাশিতই।
দিলীপ কুমার সেনগুপ্ত, বিরাটি, উত্তর চব্বিশ পরগনা
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)