এখন পুজো মানেই থিম। সাবেকিয়ানা হারিয়ে এখন অধিকাংশ সর্বজনীন পুজোই হয়ে উঠেছে থিম-নির্ভর। আর, প্যান্ডেলের পাশাপাশি এখন দেবীমূর্তিও চলে এসেছে সেই থিমের আওতায়। বিষয় নির্বাচন, প্রস্তুতি ও তার রূপদান ইত্যাদি বিষয়গুলো এক প্রকার সারা বছর ধরেই চলে। আয়োজকরা সারা বছর ধরে একটু একটু করে বিভিন্ন ভাবে তাকে রূপদান করেন। দর্শনার্থীরা তা দেখতে পান পুজোর ক’টা দিন মাত্র, প্রায় সব কিছুই হয় তাঁদের ক্যামেরা-বন্দি। এ ক্ষেত্রে থিমের একটা প্রতিযোগিতা চলে, নানা ভাবনা ও পরিকল্পনার মাধ্যমে। তবে, অনেক সময়েই মনে হয় এই থিম যখন মুখ্য হয়ে ওঠে, তখন মাতৃ আরাধনায় কোথাও নিষ্ঠা-ভক্তি কি গৌণ হয়ে ওঠে? জাঁকজমক-পূর্ণ, আলোকসজ্জায় সজ্জিত পুজোর মধ্যে দিয়ে কোথাও কি বিনোদনকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে?
তবে এ কথাও অনস্বীকার্য যে, সুপরিকল্পিত থিম সত্যিই পুজোয় আলাদা মাত্রা এনে দেয়। বর্তমানে ‘থিম’-হীন পুজো কেমন যেন ম্যাড়মেড়ে লাগে। বিভিন্ন ধরনের থিম শিল্পীকে দেয় নতুন উৎসাহ। বিভিন্ন শিল্প স্থাপত্য, সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনা, গ্ৰামজীবন, আধুনিক জীবনশৈলীর পাশাপাশি সাহিত্য গল্প উপন্যাসের বিশেষ কোনও দিক উঠে আসে পুজো প্যান্ডেলে। দূরের এক চিলতে শহর, প্রত্যন্ত গ্ৰাম কিংবা পাহাড় যেন মন ছুঁয়ে যায়, প্রকৃতির ছোঁয়ায় মনোমুগ্ধকর হয়ে ওঠে। কোনও স্থাপত্যে সেই রূপ ফুটিয়ে তোলার পাশাপাশি অন্য যে কোনও বিষয়ে তার প্রকৃত আদল তৈরির জন্য দক্ষ শিল্পীর প্রয়োজন হয়। তার রূপ যখন পুজোর প্যান্ডেলে উঠে আসে, তখনই শিল্প ও শিল্পীর সার্থকতা। আর তারই ফল— দর্শনার্থীর চোখে-মুখে ফুটে ওঠা মুগ্ধতা, আর উদ্যোক্তাদের সাফল্যের আনন্দ।
সনৎ ঘোষখালোড়, বাগনান।
বাড়ির পুজো
সুজিত ভট্টাচার্যের ‘বাড়ির পুজোর ভবিষ্যৎ’ (রবিবাসরীয়, ১০-৮) শীর্ষক প্রবন্ধটি পড়লাম। কিছু মৌলিক বিষয় নিয়ে আরও কিছু আলোচনার দরকার। প্রথম কথা, বাড়ির পুজোর ভবিষ্যৎ নির্ভর করে সেই বাড়ির বর্তমানে জীবিত মানুষের সংখ্যা ও তাঁদের আন্তরিক ইচ্ছার উপর। শুনেছি, চন্দননগরে একটি বাড়িতে বহুদিনের দুর্গাপুজো বাড়ির লোকের অভাবে এখন বারোয়ারি পুজো হয়ে গিয়েছে। তারকেশ্বরে এক বাড়ির দুর্গাপুজো বারোয়ারি হয়ে এখন সরকারি অনুদান পাচ্ছে। এমন নজির বাড়ছে।
দুর্গাপুজোর অখণ্ড বাঙালিয়ানায় ভৌগোলিক সীমা, রাজনৈতিক মানচিত্র মুছে যায়। গ্রাম্যপুজোয় পারিবারিক কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য থাকে। নানা মতামতের ঝড় ওঠে। মনোমালিন্য হয়। কিন্তু পুজোর আগে সব মিটমাট হয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে পুরোহিত থাকেন বংশানুক্রমে। সেই সঙ্গে থাকেন মৃৎশিল্পী, ঢাকি, গয়নাশিল্পীরাও। এই সার্বিক সহযোগিতায় ‘বাড়ির পুজোর অর্থনীতি দুর্বল’— এমনটা মানা কঠিন। আসলে জমিদারি ব্যবস্থা বিলুপ্তির সঙ্গে পারিবারিক দুর্গাপুজোর জাঁকজমক কমে গিয়েছে। তবুও বাঙালি তার বাড়ির দুর্গাপুজোর জন্য সারা বছর কষ্ট করেও সংস্থান করে। অবশ্যই হয়তো তার বাহ্যিক আড়ম্বর হ্রাস পেয়েছে। এখানে পুজো নিছক ‘সংস্কার’ নয়। বাঙালি তার মাতৃভক্তিতে মন উজাড় করে দেয়। মনে রাখতে হবে, বাংলার দুর্গাপুজোর মাতৃতান্ত্রিক চরিত্র বাকি ভারতের শেরাওয়ালি শক্তিরূপিণীর থেকে স্বতন্ত্র। শহুরে বারোয়ারি দুর্গোৎসবের জৌলুস বেশি। তা সত্ত্বেও দুর্গাপুজোয় পঞ্চমী থেকে রাঢ় বাংলা অভিমুখে ব্যক্তিগত গাড়ির প্রায় মিছিল যায়। শহুরেদের শারদীয় অভিযান।
দুর্গাপুজো মানেই গ্রাম, পাড়ার সবাইকে কোনও না কোনও কারণে কাজে লাগে। ব্যক্তিগত থেকে এক সমষ্টিগত সম্পর্ক থেকে যায়। সেই স্মৃতি ফের বাঁচিয়ে রাখা হয় আগামী বছর দুর্গোৎসবের উদ্দেশ্যে। বিসর্জনের দিন অস্ফুট বেদনা মিশে যায় আকাশে— আবার এসো মা, আবার এই ভাবেই এক রেখো। চারিদিকে বিচ্ছিন্নতার দুর্গতিতে এই দুর্গাপুজো পরিবারগুলির মধ্যে যোগাযোগ অটুট রাখে।
শেষে পারিবারিক এক পরম্পরার কথা বলি। ছোটবেলায় দেখেছি পুরোহিত-কাকা বিসর্জনের সময় মাকে বিদায় দিয়ে হাউ-হাউ করে কাঁদছেন। অপরাজিতা লতা হাতে বেঁধে সেই বিষাদ কাটত। আর গ্রামের পুকুরে প্রতিমা নিরঞ্জনের পর বাড়ির এক ছেলে মশাল হাতে, ঢাকি ও হ্যাজাকবাহক সঙ্গে নিয়ে যেত গ্রাম্যদেবতা ভদ্রকালীর স্থানের অদূরে এক নির্জন বনে (এই ভদ্রকালী ও দুর্গা, দুই বোনের অন্য কাহিনি আছে)। সেই মশাল মাটিতে পুঁতে পূর্বপুরুষদের জানাত— তোমাদের পুজো আমরা করলাম, তোমাদের দেখানো পথেই আমরা চলেছি। আমাদের বাড়ির দুর্গাপুজোর ভবিষ্যৎ এই ভাবে প্রতিষ্ঠিত।
শুভ্রাংশু কুমার রায়, চন্দননগর, হুগলি।
পুজোয় নিরাপত্তা
দুর্গাপুজো বাঙালির অন্যতম বৃহৎ উৎসব। এই সময় শহর ও মফস্সলের প্রতিটি অঞ্চলে বিপুল জনসমাগম হয়। ভিড়ের সুযোগে চুরি, ছিনতাই, উত্ত্যক্ত করা প্রভৃতি অপরাধমূলক কার্যকলাপ ঘটে থাকে। সে ক্ষেত্রে এই সময়ে জন-নিরাপত্তা নিশ্চিত করা খুবই জরুরি। এই সূত্রে এক বিশেষ পদক্ষেপ করা যেতে পারে। প্রতিটি পুজোমণ্ডপে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো হোক। সিসিটিভি থাকলে প্রথমত, অপরাধীদের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে। দ্বিতীয়ত, ভিড় নিয়ন্ত্রণ ও জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলা দ্রুত সম্ভব হবে। তৃতীয়ত, সাধারণ দর্শনার্থীদের মধ্যে নিরাপত্তার বার্তা পৌঁছবে। আশা করব পুজো উদ্যোক্তারা এই বিষয়ে ভেবে দেখবেন।
তপন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা-৯৪।
প্ল্যাটফর্ম নিচু
হাওড়া-তারকেশ্বর-আরামবাগ-গোঘাট লাইনে ব্যস্ততম স্টেশনগুলির মধ্যে সিঙ্গুর অন্যতম। এই স্টেশন থেকে প্রতি দিন কয়েক হাজার যাত্রী ট্রেন ধরে নিজ গন্তব্যে যান। কিন্তু এই স্টেশনের দু’নম্বর প্ল্যাটফর্মটি নিচু থাকার কারণে প্রবীণ মানুষ এবং মহিলাদের ট্রেনে উঠতে খুবই অসুবিধা হচ্ছে। তাই রেলওয়ে বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে বিনীত অনুরোধ, যাত্রী-নিরাপত্তার স্বার্থে সিঙ্গুর স্টেশনের দু’নম্বর প্ল্যাটফর্মটি উঁচু করার উপযুক্ত ব্যবস্থা করা হোক
তাপস দাস, সিঙ্গুর, হুগলি।
গল্পকথা
গল্পের বই উপহার দেওয়া তো কবেই উঠে গেছে। এমনকি, স্কুলে যে গল্পের বইয়ের লাইব্রেরি থাকত, তা-ও আর নেই বললেই চলে। ছোটবেলায় দেখেছি, মা-কাকিমারা শীতের দুপুরে কাজ সেরে আধশোয়া হয়ে গল্পের বই পড়তেন। শক্তিপদ চট্টোপাধ্যায়, আশাপূর্ণা দেবী কিংবা নীহাররঞ্জন গুপ্তের বই পেলে তো শেষ না করে ছাড়তেন না। এখন মোবাইল তো সে সময় গিলে নিয়েছে। আশার কথা, সিন্ধুতে বিন্দু হলেও দু’-এক জন এখনও মোবাইলে গল্প পড়েন। কিছু দিন আগে পর্যন্ত দেখেছি, চায়ের দোকানে কিংবা স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে বয়স্ক মানুষজন নির্ভেজাল গল্প জুড়তেন। সেখানেও এখন মোবাইল থাবা বসিয়েছে। পাঁচ জনের দু’জন গল্প করলেও, তিন জনের দৃষ্টি মোবাইলের দিকে থাকে। গল্প পড়া আর গল্প করার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য থাকলেও, উভয় ক্ষেত্রেই এর উপকারিতা অসীম।
গল্প পড়লে জ্ঞান বাড়ে, মনের একাগ্রতা তৈরি হয়, আলস্য দূর হয়, এমনকি রাতে নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটে না। কিন্তু একাধিক ব্যক্তি এক সঙ্গে বসে গল্প করলে উভয়ের চিত্তের বিকাশ তথা প্রসার ঘটে। এটা একপ্রকার মানসিক ব্যায়াম, যা অন্য কোনও উপায়েই সংগ্রহ করা যায় না। আজ সেই সোনালি দিনগুলো হারিয়ে আমরা প্রত্যেকেই নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছি।
স্বপন কুমার ঘোষ, আন্দুল, হাওড়া।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)