‘শিকল ছাড়া ওঁরা সর্বহারা’ (৭-২) খবরটি দেশের জনগণকে নতুন ভাবনায় ডুবিয়ে দিল। অবৈধ অভিবাসীদের ফেরত পাঠানো যে-কোনও দেশের অভিবাসন আইনের অন্যতম অঙ্গ। ডোনাল্ড ট্রাম্প আবার আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই অবৈধ অভিবাসনের বিষয়ে কড়া মনোভাব দেখাচ্ছে সে দেশের সরকার। খবরে প্রকাশ, সে দেশে এই মুহূর্তে প্রায় সাত লক্ষ পঁচিশ হাজার ভারতীয় রয়েছেন, যাঁদের দেশে ফেরত পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে ট্রাম্প সরকারের। সেই প্রক্রিয়ার প্রথম দফায় সামরিক বিমানে চাপিয়ে ১০৪ জন অবৈধ ভারতীয় অভিবাসীকে সে দেশ থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছিল। পরেও পাঠানো হয়েছে আরও অনেককে। এ ছাড়াও অনেকে সেখানকার ‘ডিটেনশন সেন্টার’-এ বন্দি, হাতে হাতকড়া, পায়ে শিকল বাঁধা অবস্থায় ফেরার দিন গুনছেন।
স্বদেশ ছেড়ে বিদেশে যাওয়ার ঝুঁকি নেন কেন এঁরা? নিছক ভ্রমণ বা পড়াশোনা কিংবা কাজের খোঁজে বিদেশ যাওয়া যেতেই পারে। সে ক্ষেত্রে গন্তব্য দেশের ভিসা বা পারমিট থাকতে হয়। কিন্তু এ দেশে কাজের সংস্থান না করতে পেরে বা ডলারে আয় করার বাসনায় পঞ্জাব, হরিয়ানা, গুজরাত প্রভৃতি রাজ্য থেকে বহু ভারতবাসী লুকিয়ে-চুরিয়ে অন্য দেশে পাড়ি দেওয়ার ঝুঁকি নেন। লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে নৌকায় সাগর পেরিয়ে, পাহাড় ডিঙিয়ে, দীর্ঘ বিপদসঙ্কুল ঘন বৃষ্টি-বনানী পথ পায়ে হেঁটে বিদেশে পৌঁছন এজেন্সির এমন আশ্বাস নিয়ে যে, ও দেশে থাকার ও কাজ করার বৈধ কাগজপত্র জোগাড় করে দেবে তারা। মাঝপথে এজেন্সির লোকজন সুযোগ বুঝে যাত্রীদের থেকে আলাদা হয়েও যান। এখন পঞ্জাব-হরিয়ানা-গুজরাতের অধিকাংশ পরিবারের ছবি এটা— জমি-বাড়ি বিক্রি-বন্ধক দিয়ে যাঁরা গিয়েছিলেন সুখের খোঁজে, তাঁদের ফিরতে হয় কপর্দকশূন্য হয়ে, অমানবিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। তাঁরা তো সন্ত্রাসবাদী ছিলেন না, তবুও কেন তাঁদের সঙ্গে এমন আচরণ? শুধু পুরুষ নয়, মহিলা ও শিশুদের ক্ষেত্রেও? তার কিছু দিনের মধ্যেই তো ভারতের প্রধানমন্ত্রী গেলেন আমেরিকা সফরে। বহু কাল ধরে শোনা গিয়েছে দুই রাষ্ট্রনেতার মিত্রতার কথা। তা হলে, আমেরিকার এমন অমানবিক প্রক্রিয়া বন্ধ করার ক্ষেত্রে কোনও চেষ্টা দেখা গেল না কেন?
দক্ষিণ আমেরিকার ছোট্ট দেশ কলম্বিয়া-র প্রেসিডেন্ট নিজের দেশের নাগরিকদের সামরিক বিমানে বন্দি অবস্থায় নামতে দেননি। আমেরিকার বিমান অবতরণে বাধা দিয়ে তিনি বলেন, অবৈধ অভিবাসীদের সসম্মানে ফেরত পাঠাতে হবে। একশো চল্লিশ কোটি জনসংখ্যার দেশ ভারত কলম্বিয়ার মতো স্বর উঁচু করতে পারল না, এটা আক্ষেপের। কিন্তু কেন? এর উত্তর কে দেবে?
সৌম্যেন্দ্র নাথ জানা, কলকাতা-১৫৪
অপমানজনক
অবৈধ অভিবাসীদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো যে-কোনও দেশের ক্ষেত্রেই সঠিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু ফেরত পাঠানোর পদ্ধতি যদি অমানবিক হয় এবং অভিবাসীরা যদি নিজের দেশের নাগরিক হন, তবে দুঃখ লাগে বইকি। হাতে হাতকড়া পরিয়ে, পায়ে শিকল বেঁধে, সেনাবাহিনীর পণ্যবাহী বিমানে ১০৪ জন মানুষের জন্য একটি মাত্র শৌচাগারে, ৪০ ঘণ্টা সফর করিয়ে ভারতে ফেরত পাঠাল আমেরিকা সরকার। এ ভাবে কোনও দেশের নাগরিকদের ফেরত পাঠানো রাষ্ট্রপুঞ্জের সনদের বিরোধী নয় কি?
এখনও পর্যন্ত ভারত আমেরিকাকে বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে অভিহিত করলেও আমেরিকা কি ভারতকে সমপর্যায়ের বন্ধু হিসেবে ভাবতে প্রস্তুত? অভিবাসীদের সঙ্গে আচরণে অন্তত তেমন কোনও ইঙ্গিত মিলল না। আমেরিকার সীমান্তরক্ষা দফতরের প্রধান মাইকেল ডব্লিউ ব্যাঙ্কস সমাজমাধ্যমে পোস্ট করে বলেন ‘ভিন গ্রহের মানুষদের আমরা সফল ভাবে ভারতে ফেরত পাঠাতে পেরেছি’। ভারত সম্বন্ধে কতটা তাচ্ছিল্য, উপেক্ষা, অবজ্ঞা থাকলে এই ধরনের মন্তব্য করা যায়, তা সহজেই অনুমেয়।
এখন প্রশ্ন হল, ভারত থেকে এত অভিবাসী এত কষ্ট করে, প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে, বিদেশে অবর্ণনীয় নির্যাতন সহ্য করেও কেন যান? পৃথিবীর পঞ্চম বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে চিহ্নিত এবং শীঘ্রই তৃতীয় অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে উঠে আসার অঙ্গীকার করা ভারতের পক্ষে কি এই ঘটনা লজ্জার নয়? যে সব রাজ্য অর্থনৈতিক ভাবে সমৃদ্ধ বলে বিবেচিত হয় তার মধ্যে পঞ্জাব ও গুজরাত অন্যতম। অথচ, ১০৪ জন অবৈধ অভিবাসীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুজরাত, পঞ্জাব ও হরিয়ানার নাগরিক। তা হলে কি ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাত’ বা পঞ্জাবের যে ছবি আমাদের দেখানো হয়, সেটা তত উজ্জ্বল নয় শেষ পর্যন্ত? আরও খারাপ লাগে যখন দেখা যায় আমেরিকার এমন অমানবিক আচরণের নিন্দা বা প্রতিবাদ জানানোর পরিবর্তে ভারতের বিদেশমন্ত্রী তাঁদের হয়ে সাফাই দেওয়ার চেষ্টা করেন। তা-ও আবার সংসদে বিরোধীরা এই বিষয়ে সরব হওয়ার পরে। এই লজ্জা শুধু ওই মানুষগুলোর নয়, কেন্দ্রীয় সরকারেরও, সেটা কি ভুলে গেলেন জয়শঙ্কররা?
সুরজিৎ কুন্ডু, উত্তরপাড়া, হুগলি
পরিবেশ রক্ষা
‘উষ্ণতম’ (২৫-১) শীর্ষক সম্পাদকীয়তে যথার্থ ভাবেই সারা বিশ্বে তাপমাত্রার অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। যত দিন যাচ্ছে ততই তাপমাত্রার দাপট বাড়ছে। সমুদ্রের জলস্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে, বরফ গলছে, বন্যা ও খরার প্রকোপ বৃদ্ধি পাচ্ছে, দাবানলের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে।
২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশসমূহ পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে ১.৫ সেলসিয়াসের মধ্যে আটকে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু রাষ্ট্রপুঞ্জের আবহাওয়া সংস্থা ডব্লিউএমও-র মতে, এখনকার তাপমাত্রার বৃদ্ধি সেই লক্ষ্যমাত্রাকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। তা ছাড়া, দু’টি গবেষণা সংস্থা ওয়ার্ল্ড ওয়েদার অ্যাট্রিবিউশন এবং ক্লাইমেট সেন্ট্রাল-এর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, গত বছর বিশ্ব জুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে গড়ে অতিরিক্ত ৪১ দিনের আবহাওয়া ছিল বিপজ্জনক ভাবে তপ্ত। একই বিশ্লেষণ দেখিয়েছে কী ভাবে ওই বছরই দাবদাহ ছোট ছোট দ্বীপ ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে দগ্ধ করেছিল। অন্য দিকে, অতিবৃষ্টি এবং বিধ্বংসী বন্যায় ভেসে গিয়েছিল কত শহর। ব্রাজ়িল, চিন, সার্বিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও জার্মানি-সহ অনেকে ২০২৪ সালকেই উষ্ণতম বলে আখ্যা দিয়েছে।
সম্পাদকীয়তে সঠিক ভাবেই প্যারিস চুক্তির সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। এই চুক্তিতে উন্নয়নশীল দেশগুলিকে উন্নত দেশগুলির পক্ষ থেকে আর্থিক সাহায্য এবং প্রযুক্তি হস্তান্তরের কথা বলা হয়েছিল, যাতে তাদের অর্থনীতি পরিবেশবান্ধব হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু উন্নত দেশগুলি তাদের সেই প্রতিশ্রুতি রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, আমেরিকার মতো উন্নত দেশ এই চুক্তি থেকে সরে এসেছে। অথচ, পরিবেশে কার্বন ছড়ানোর ক্ষেত্রে আমেরিকার স্থান একেবারে উপরের দিকে। প্যারিস চুক্তিতে অনেক ইতিবাচক সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু দূষণ রোধে কড়া পদক্ষেপের অভাব, চুক্তি স্বাক্ষরকারী দেশগুলির আর্থিক বাধ্যবাধকতার মতো বিষয় এই চুক্তিকে ব্যর্থতার দিকে ঠেলে দিয়েছে।
গত বছর আজ়াবাইজানের বাকু-তে রাষ্ট্রপুঞ্জের ২৯তম জলবায়ু সম্মেলনে পরিবেশ দূষণ রোধে নানা পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। একটি হিসাব অনুযায়ী, ২০৩০ সাল নাগাদ উন্নয়নশীল দেশগুলিকে যদি কার্বন নির্গমন বন্ধ করে পরিবেশবান্ধব অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হতে হয়, তা হলে বছরে ২ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করতে হবে। উন্নত দেশগুলির সাহায্য ছাড়া এটা সম্ভব নয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প ডিগবাজি খেয়ে বলছেন, তিনি এখন নিজের দেশ নিয়েই ভাববেন।
কিন্তু বিশ্ব জুড়ে পরিবেশ বিপর্যয়ের তাপ থেকে তাঁর দেশ কি বাঁচতে পারবে?
নারায়ণ দত্ত, বর্ধমান
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)