E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: শেকল ছেঁড়া হাত

মানুষের আশ্রয়হীন হওয়ার পিছনে একটিই মূল শর্ত আছে। ব্যক্তি থেকে সমাজে সেই শর্তটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন চেহারা নেয় মাত্র। মূল শর্তটা কি মানুষের দ্বারা সৃষ্ট বিভাজন এবং সীমান্ত নির্ধারণ নয়?

শেষ আপডেট: ১০ অগস্ট ২০২৫ ০৫:৪৬

রুশতী সেন-এর লেখা বহু দিন ধরে এই পাঠককে সমৃদ্ধ করে চলেছে। ‘অথ নিখুঁজি-কথা’ (১৩-৭) প্রবন্ধটি সেই তালিকায় আরও একটি সংযোজন। উদ্বাস্তু যখন আশ্রয়ের সন্ধানে ছিন্নমূল হয়, তখন আশ্রয় যদি বা পায়, তার আপন পরিচয় কি সেখানে প্রকট হয়, না কি শরণার্থীকে পরভূমে প্রচ্ছন্ন করে রাখতে হয় তার অনেক আবেগ আর চাওয়া-পাওয়া? নিজভূম ছেড়ে যাওয়ার পরিস্থিতি হত আদিম সমাজেও। কিন্তু তখন ভৌগোলিক স্তরে কোথাও কোনও কাঁটাতারের সীমান্ত ছিল না, তখন গোষ্ঠীগত আশ্রয়হীনতা ঘটত শুধুই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শর্তে। একটি অঞ্চলে খাবার অপ্রতুল হলে গোষ্ঠীগত ভাবে পরিযাণ হত। তখন পৃথিবীতে শরণার্থী শব্দটি ছিল না। মানুষের আশ্রয়হীন হওয়ার পিছনে একটিই মূল শর্ত আছে। ব্যক্তি থেকে সমাজে সেই শর্তটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন চেহারা নেয় মাত্র। মূল শর্তটা কি মানুষের দ্বারা সৃষ্ট বিভাজন এবং সীমান্ত নির্ধারণ নয়? আর্থসামাজিক, লিঙ্গভিত্তিক, ভাষাভিত্তিক, বর্ণভিত্তিক, ধর্মভিত্তিক, অর্থনৈতিক শ্রেণিভিত্তিক এবং ভৌগোলিক— সব রকমের বিভাজন। যেখানে যেখানে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হয়েছে, সেখানেই কিছু মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছেন। আশ্রয়হীনতা, পারিবারিক স্তর থেকে শুরু করে সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় স্তর পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রতিটি বিষয়ই কিন্তু ঘটে বিভাজনের কারণে।

বিস্তৃত অর্থে, দেশত্যাগ করাই শরণার্থী হয়ে ওঠার একমাত্র শর্ত নয়। দেশত্যাগ একটা চরম পরিস্থিতি। কিন্তু তার আগেও আশ্রয়হীন মানুষ তাঁর আপন অনুভবে শরণার্থী হয়ে উঠতেই পারেন। শরণার্থী হয়ে ওঠার একটা বিপন্ন মনস্তাত্ত্বিক দিকও আছে। মানবীয় বিভাজনের কাঁটাতার মানুষকে সেই নিদারুণ বিপন্নতাবোধে আচ্ছন্ন করে। কাঁটাতার দৃশ্যমান বা অদৃশ্য দুই রকমেরই হতে পারে। অদৃশ্য কাঁটাতার থাকে ব্যক্তির অনুভবে। কাঁটাতারই আশ্রয়হীনতার মূল শর্ত— তখন দেশের মধ্যেও কি অসংখ্য দেশ আর ঘরের মধ্যেও অসংখ্য ঘর নয়? আশ্রয়ও তো শুধুই একটা দেশ বা বাড়ি নয়, আশ্রয় একটা মানসিক অনুভব। নিজের ঘরে সে অনুভব থাকতে পারে, আবার না-ও থাকতে পারে। এমনকি জলবায়ু শরণার্থীদের ক্ষেত্রেও বিপন্নতার মাত্রা নির্ধারণে, মূল শর্তটির ভূমিকা কিন্তু থেকেই যায়।

উর্বশী বুটালিয়া-র লেখা দি আদার সাইড অব সাইলেন্স: ভয়েসেস ফ্রম দ্য পার্টিশন অব ইন্ডিয়া গ্রন্থে দেশভাগের ইতিহাসে আপাত-অদৃশ্য ফাঁকগুলি দৃশ্যমান হয়েছিল। আমরা জেনেছিলাম দেশভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সহিংসতার ঘটনাগুলিতে লিঙ্গ, বর্ণ ও সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে ক্ষমতাশালী ও অপর-এর নীরবতার তারতম্য। জন্ম নিয়েছে ও নিয়েই চলেছে, অপরত্বের অনুভব। ‘পলিটিক্স অব আদারনেস’— অপরত্বের রাজনীতি অর্ধশতাব্দী ধরে বৌদ্ধিক সমাজের অন্যতম প্রধান ‘ডিসকোর্স’। এই রাজনীতি ভাবছে এক বিরাট রামধনু চালচিত্রের কথা, যেখানে প্রতিটি মানুষের একান্ত নিজস্ব সত্তা স্বীকৃত ও সম্মানিত— অপরত্বের রাজনীতিই আজ ‘শেকল ছেঁড়া হাতের খোঁজে’।

অনিরুদ্ধ রাহা, কলকাতা-১০

যন্ত্রণার কাঁটা

রুশতী সেনের লেখা ‘অথ নিখুঁজি-কথা’ পড়ে অনেক পুরনো স্মৃতি আর ক্ষত মনে জেগে উঠল। আদালত, আইন, শান্তি ও সুবিচার পাবার জন্য বছরের পর বছর চলে যায়। এখনও কি সুবিচার গঠিত হয়েছে? এত চক্রান্তের বীজ ছড়ায় কিছু পদলোভী মানুষের ক্ষমতার লোভ ও লালসা থেকে। তা ব্রিটিশ যুগ থেকে আজকের দিন অবধিও সমান ভাবে প্রযোজ্য।

আমাদের পরিবারের একটি ঘটনা জানাতে চাইছি। ১৯৪৭ সালে বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ থানার অন্তর্গত কাজলাকাঠি গ্রামে আমার এক কাকা হিংসার শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তখন আমাদের ত্রিশ জনের পরিবার সদস্য প্রায় ৫০ বিঘা জমির ও বিশাল গৃহটির মায়া ত্যাগ করে একেবারে নিঃস্ব হয়ে খুলনায় বরিশাল এক্সপ্রেস ট্রেন ধরে এ দেশে আসেন। তার পর কুপার্স ক্যাম্পে, অনাহারে অর্ধাহারে মারা যান চার-পাঁচ জন। বহু কষ্ট আর লড়াইয়ের দিনগুলো মনে করলে শিউরে উঠি আজও। ভাবি, কী ভাবে বেঁচে উঠলাম বাকিরা! ধন্যবাদ জানাই তৎকালীন সরকারকে, দূরে ফেলে না দিয়ে, অসময়ে আশ্রয় দেওয়ার জন্য।

উদ্বাস্তু জীবনযন্ত্রণার যাঁরা শিকার হয়েছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই এই প্রবন্ধটির মধ্য থেকে মহামূল্য কিছু উপাদান খুঁজে পাবেন।

বাসুদেব সেন, রামচন্দ্র রোড, উত্তর ২৪ পরগনা

উত্থান-পতন

রাজদীপ বিশ্বাসের লেখা ‘প্রগতি-চেতনার ছন্দপতন’ প্রবন্ধে (৩-৭) বাংলার একদা-অর্জিত প্রগতির অধোগতি নিয়ে যে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে তা যথার্থ। ব্রিটিশ রাজধানী এবং তার সুবাদে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও চিন্তা ভাবনার সুযোগের মধ্য দিয়ে এ রাজ্যের প্রগতি-চিন্তার যাত্রা শুরু। নবজাগরণ, স্বাধীনতা আন্দোলন সেই চিন্তাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যায়। সেই অগ্রগতিই প্রথমে রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব এবং পরে চিন বিপ্লবের আবহাওয়ায় শিক্ষিত মানুষের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশকে বামপন্থী চিন্তায় উদ্বুদ্ধ করে। তাই স্বাধীনতার পর এ রাজ্যে কংগ্রেস শাসনের বিরুদ্ধে বামপন্থী আন্দোলন শক্তিশালী হয়। শ্রমিক-কৃষকের মনে শোষণমুক্তির আকাঙ্ক্ষা জায়গা করে নেয়। নবজাগরণ, স্বাধীনতা আন্দোলন ও বামপন্থী আন্দোলনের দীর্ঘ যাত্রায় মানুষ বহু দূর পর্যন্ত জাতপাত, ধর্মীয় কুসংস্কার থেকে মুক্ত হয়ে যুক্তি ও বৈজ্ঞানিক মননে প্রভাবিত হন। এই সমস্ত কিছুকে পুঁজি করেই ১৯৭৭-এ রাজ্যে ক্ষমতায় বসে বামফ্রন্ট।

এত দূর পর্যন্ত চলার পর বাংলার মননে শুরু হয় নতুন বাঁক। নাগরিক সমাজের একটি বড় অংশ যাঁরা এক সময় রাজ্যের বামপন্থার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন তাঁদের একাংশ বামপন্থাকে সচল রাখার, এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বটি সরকারের উপর ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হন। অন্য একটি অংশ যাঁরা তার পরও প্রশ্ন করতে থাকেন, নানা তর্ক তুলতে থাকেন, তাঁদের বিরুদ্ধে সরকারি অসহযোগিতা, অবহেলার অস্ত্র ব্যবহার হতে থাকে।

সরকারও ক্রমে পরিষদীয় বাধ্যতায়, ক্ষমতায় টিকে থাকতে সংগ্রামী রাস্তা ছেড়ে আপস এবং জনতোষণের রাস্তা নেয়। যুক্তি-তর্ক-বিরোধিতাকে আনুগত্যের স্খলন হিসাবে চিহ্নিত করতে থাকে। ধীরে ধীরে বামপন্থা আলখাল্লায় পরিণত হয়। শ্রেণি-স্লোগান পরিণত হয় শ্রমজীবী মানুষকে পক্ষে রাখার কৌশল হিসাবে। বিরোধী শক্তিকে দমন করতে পুলিশ-প্রশাসনকে কাজে লাগানো চলতে থাকে। ক্রমে বামপন্থার স্লোগানও পিছনে সরে যায়। দলবাজি, স্বজনপোষণ, দুর্নীতি, সুবিধাবাদ দল এবং প্রশাসনকে গ্রাস করতে থাকে। দলের মধ্যে বামপন্থার চর্চা পিছনে চলে যায়। এই সরকারি বামপন্থা নতুন প্রজন্মকে আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হয়। যদিও সংগ্রামী বামপন্থা অপেক্ষাকৃত দুর্বল ধারা হলেও পাশাপাশি চলতে থাকে।

শিক্ষা ক্ষেত্রে অযোগ্যদের নিয়োগ, দুর্নীতি, দলবাজি শিক্ষিত সমাজকেও ক্রমে সরকার বিরোধী করে তোলে। কায়েমি শক্তি একেই বামপন্থা হিসাবে দেখিয়ে বামপন্থাকে জনমনে আরও হেয় করে তোলে। যতই বামপন্থা দুর্বল হতে থাকে ততই দক্ষিণপন্থা গুঁড়ি মেরে এগোতে থাকে। সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম আন্দোলনে সরকারের মুখ্যমন্ত্রী যে দিন কৃষক আন্দোলন তথা শ্রেণি-আন্দোলনের সম্পূর্ণ বিপরীতে গিয়ে নিজের অবস্থান ঘোষণা করে বলেন, টাটার কেশাগ্র স্পর্শ করতে দেব না, সে দিন যেন বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়।

রাজ্যে পালাবদল ঘটে। কিন্তু পিছনে পড়ে থাকে কোন বাংলা? চিন্তায় ভাবনায় মননে সংগ্রামী চরিত্রে যে বাংলা এক দিন সারা দেশে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল যেন তার ভগ্নস্তূপ। বামপন্থী আন্দোলনের প্রতি মানুষের যে আকর্ষণ ছিল তা নষ্ট হয়ে যেতেই প্রতিক্রিয়ার শক্তি আত্মপ্রকাশ করতে থাকল। অর্থাৎ, জমি তৈরিই ছিল। দক্ষিণপন্থার বীজ সেই জমিতে তরতরিয়ে গজিয়ে উঠতে থাকল।

সমর মিত্র, কলকাতা-১৩

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Refugees Politics

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy