‘জাড্ডুর লড়াইয়ে গর্বিত গিল, হতাশ সচিন-সৌরভ’ (১৫-৭) প্রতিবেদন ও ইংল্যান্ড সফরে তৃতীয় টেস্টে ভারতের পরাজয়ের অন্যান্য খবরেও মন বিষণ্ণতায় ছেয়ে গেল না। কারণ, আগের দিন লর্ডসে খেলার শেষে সৌহার্দের দু’টি নজির আমরা চাক্ষুষ করলাম। বেন স্টোকস রবীন্দ্র জাডেজাকে আলিঙ্গন করে তাঁর সাহসী লড়াইকে কুর্নিশ জানালেন এবং লড়াইয়ের অন্যতম সৈনিক মহম্মদ সিরাজকে জ্যাক ক্রলি ও জো রুট পিঠে হাত রেখে সান্ত্বনা দিলেন। এ টেস্টে জয়-পরাজয়কে ছাপিয়ে ক্রিকেট তার মহানুভবতার জয়ও দেখাল। সাক্ষী অবশ্যই লর্ডসের মাঠে হাজির দর্শক ও বিশ্বের অগণিত ক্রিকেটপ্রেমী। খেলার পঞ্চম তথা শেষ দিনে শুরুতে কিছু ক্ষণের মধ্যেই ঠিক হয়ে গেল কারা জিততে চলেছে। কারণ ভারত তখন ৮ উইকেট খুইয়ে ফেলেছে। কিন্তু আমরা কী দেখলাম? হার তো অনেক দেখেছি। কিন্তু এমন লড়াই আমরা কম দেখেছি। মাত্র ১৯৩ রানের টার্গেট নিয়ে ভারত যখন ১১২ রানে ৮ উইকেট খুইয়ে ফেলেছে তখন কে ভেবেছিল সমগ্র বিশ্ব দেখবে দশম ও একাদশ স্থানের ব্যাটারদের এমন অদম্য লড়াই। এই মুহূর্তে সিরিজ়ের অন্যতম নায়ক সিরাজকে নিয়ে বন্দনা চলছে। এর আগেই, সে দিন ব্যাট হাতেও সিরাজ বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি কোন শৃঙ্গকে লক্ষ্য করেছেন।
ব্যাট হাতে এই লড়াইও ঐতিহাসিক। কারণ ইংল্যান্ড দলের বোলার জোফ্রা আর্চার, বেন স্টোকস, ক্রিস ওক্স ও ব্রাইডন কার্স সর্বশক্তি দিয়ে আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সে সময়, বল পিচে পড়ে অসম বাউন্স হচ্ছিল, সেখানে দাঁড়িয়ে ভারতের একমাত্র ভরসা রবীন্দ্র জাডেজাকে তথাকথিত টেলএন্ডাররা যে ভাবে সঙ্গ দিলেন তা ক্রিকেটপ্রেমীরা বহু দিন মনে রাখবেন। সে সময় তাঁরা কত রান করলেন সেটা বড় কথা নয়। স্পিনার শোয়েব বশিরের একটা লাফিয়ে ওঠা বলে কেতাবি ঢঙে মহম্মদ সিরাজ খেলার পর অতর্কিতে বলটা গড়িয়ে পিছনের দিকে গিয়ে উইকেট ভেঙে দেয়। স্তম্ভিত হওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। সে সময় মহম্মদ সিরাজের মনে কী চলছিল সেটা সহজে অনুমেয়। সিরাজ পিচে মাথা নিচু করে বসে পড়লেন। প্রায় এক মিনিট ধরে একই জায়গায় একই ভাবে ছিলেন। আর ঠিক সে সময়েই ইংল্যান্ডের জ্যাক ক্রলি ও জো রুট মুহূর্তের মধ্যে তাঁদের দলের জয়োল্লাস ছেড়ে বেরিয়ে এসে যে ভাবে সিরাজের দিকে হাত বাড়িয়ে এবং পিঠে হাত রেখে মানবতার জয়কে বরণ করে নিলেন, তা ক্রিকেট দুনিয়ার চিরন্তন প্রতীক। কারণ ইংল্যান্ডের ব্যাটারদের বল করার সময় হয়তো রক্তচক্ষু দেখিয়েছেন এই বোলাররাই, দৌড়ানোর সময় কাঁধে কাঁধে মৃদু সংঘর্ষে জড়িয়েছেন, কখনও বা মাঠে উত্তপ্ত পরিস্থিতিরও সৃষ্টি হয়েছে। তার পরেও, খেলোয়াড়ি মানসিকতাকেই প্রাধান্য দিয়ে অসহিষ্ণুতার পৃথিবীতে নজির গড়লেন এঁরা। হ্যাঁ, এটাই তো সত্যিকারের ক্রিকেট, যেখানে মাঠের খেলায় লড়াই থাকবে, কিন্তু খেলার শেষে বা বাইরে এক জন খেলোয়াড়ের আচরণে থাকবে অমলিন হৃদ্যতা, সখ্য বা পারস্পরিক সৌহার্দময় আচরণ। লর্ডসের মাঠে সেটাই আবার দেখলাম আমরা, ভরসা পেলাম।
স্বরাজ সাহা, কলকাতা-১৫০
টেস্টে নবজাগরণ
ভারতীয় ক্রিকেট দলের সময়টা ভাল যাচ্ছিল না। টেস্ট ম্যাচগুলি মন ভরাতে পারেনি বেশ কিছু দিন। গুঞ্জন উঠেছিল ভারতীয় টেস্ট ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ নিয়ে। তার উপর একই সঙ্গে অবসর নিয়েছেন রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলি। তাঁদের অনুপস্থিতিতে টেস্ট ক্রিকেটের ব্যাটন তুলে দেওয়া হয় তরুণ শুভমন গিলের হাতে এবং ভারতীয় ক্রিকেট দল তাঁর নেতৃত্বে শুরুতে দিশাহীন খেললেও ঘুরে দাঁড়াল ইংল্যান্ডের মাটিতে। সদ্যসমাপ্ত তেন্ডুলকর-অ্যান্ডারসন সিরিজ়ে পিছিয়ে পড়েও স্মরণীয় লড়াই করে সিরিজ় ড্র করে দেশের মাথা উঁচু রাখলেন তাঁরা।
সদ্যসমাপ্ত সিরিজ়ের শুরু থেকেই বিতর্ক ছিল নিত্যসঙ্গী। সিরিজের নাম পটৌডি ট্রফি থেকে বদলে করা হয়েছিল তেন্ডুলকর-অ্যান্ডারসন সিরিজ়। যদিও শেষ অবধি সচিন তেন্ডুলকরের অনুরোধে পটৌডি পদক দেওয়ার কথা জানানো হয়। সিরিজ়ে কী ছিল না? শুরুতেই অফ ফর্ম কাটিয়ে ঋষভ পন্থের দুরন্ত শতরান, শুভমন গিলের অসাধারণ ব্যাটিং প্রদর্শনী, বুমরা-সিরাজ-আকাশদীপের পৃথিবীর সেরা বোলিং আক্রমণের সারণিতে উন্নীত হওয়া, রবীন্দ্র জাডেজা-সাই সুদর্শন-ওয়াশিংটন সুন্দরের অলরাউন্ড পারফরম্যান্স ইংল্যান্ডকে সমস্যায় ফেলেছে। ভারতীয় টেস্ট ক্রিকেট দল হিমশীতল মানসিকতা যা টেস্টের মূল আভিজাত্য, তার প্রমাণ রেখেছে।
ভারতীয় টেস্ট ক্রিকেট বিগত কয়েক বছর শুধুই বিরাট নির্ভর হয়ে উঠেছিল। বিরাট এক প্রান্তে খেলে গেলেও অপর প্রান্তে নির্ভরতা জোগানকারী ব্যাটারের অভাব ভুগিয়ে এসেছে। সেই অন্ধকার কেটেছে। বোলিংয়েও অশ্বিন, বুমরার উপর নির্ভরতা কমে নতুন বোলারদের হার না মানা মানসিকতা ভারতকে অক্সিজেন জুগিয়েছে। ম্যাচে ভুল ফিল্ডিং, দ্রুত উইকেট পড়ে দিশাহীন হয়ে যাওয়া বা ক্যাচ ছাড়ার মতো ভুলে ডুবে না থেকে শেষ অবধি লড়াই করার অদম্য প্রবণতা ফুটে উঠেছে নতুন প্রজন্মের ভারতীয় ক্রিকেটারদের মধ্যে।
শুভমন গিল সমগ্র ব্যাটিং বিভাগকে যে আশ্বাস জুগিয়েছেন, তার ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে শুরু থেকে শেষ অবধি সকল ব্যাটারের মধ্যে। নতুন ও অভিজ্ঞদের মিশেল ভারতকে সমৃদ্ধ করেছে। বিশেষ ভাবে উল্লেখ করতেই হয় আকাশদীপ এবং মহম্মদ সিরাজের কথা। প্রথমে সিরাজ পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সময় নিলেও শেষে বিধ্বংসী হয়ে উঠেছিলেন, তুলে নিয়েছেন সিরিজ়ের সর্বাধিক ২৩টি উইকেট এবং প্রয়োজনে জাডেজার পাশে দাঁড়িয়ে ব্যাটেও ধৈর্যশীলতার ছাপ রেখেছেন। বাংলা দলে খেলা আকাশদীপ তাঁর অভিষেক ম্যাচে দশ উইকেট তুলে নেওয়ার সঙ্গে শেষ ম্যাচে ব্যাটে ও মোক্ষম সময়ে মূল্যবান উইকেট তুলে ভারতকে জয় উপহার দিয়েছেন যা বাংলার কাছেও গর্বের বিষয়। সব মিলিয়ে, বিস্মরণে যেতে বসা টেস্ট ক্রিকেটে যেন এক নবজাগরণের সূচনা হল।
শুভজিৎ বসাক, কলকাতা-৫০
দর্শক ফিরবেন?
ভারতের নাটকীয় জয়ের মুহূর্তগুলি নিয়ে লিখিত প্রতিবেদন ‘ওভালে ৫৬ মিনিটের ক্রিকেট-মহাকাব্য: পঞ্চম দিনে ভারত-ইংল্যান্ড দ্বৈরথের রুদ্ধশ্বাস নাটকীয় মুহূর্ত’ (৫-৮) প্রসঙ্গে কিছু কথা। চলতি সিরিজ়ে টেলিভিশনে পাঁচটি টেস্ট ম্যাচই দেখেছি। পাঁচটি স্টেডিয়ামই প্রতি দিন ছিল পরিপূর্ণ। ভারতে যদি এই টেস্ট ম্যাচগুলি খেলা হত, হয়তো বেশিরভাগ আসন খালি থাকত। ভারতীয় বোলারদের আর ব্যাটারদের উৎসাহিত করার জন্য কত জনই বা উপস্থিত হতেন? কারণ, ২০০১ সালে ইডেনে ভারত বনাম অস্ট্রেলিয়ার সেই ঐতিহাসিক টেস্ট ম্যাচ এবং গত দশকে সচিনের শেষ টেস্ট ম্যাচ ছাড়া গত দু’দশক ধরে যখনই কোনও টেস্ট ম্যাচ খেলা হয়েছে তখন মাঠ প্রায় খালি থেকেছে। পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের মতো দেশেও একই পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে।
ভারতে ক্রিকেট সারা বছর ধরে খেলা হয় এবং টেলিভিশনে তার স্বত্ব বিক্রি করে তা দেখানো হচ্ছে। সবচেয়ে ধনী ক্রিকেট বোর্ড ভারতের, বিজ্ঞাপন সংস্থাগুলির সঙ্গে পরিকল্পনা করে নির্দয় ব্যবসায়ীর মতো আচরণ শুরু করেছে। কেবলই পিচ স্পিন-বান্ধব করার ঘটনা ঘটে যাতে তিন দিনের মধ্যে জয় পাওয়া যায় এবং ম্যাচগুলি ভারতের পক্ষে যতটা সম্ভব ব্যবধানে নিষ্পত্তি করা যায়। আমরা নব্বই দশক থেকে এই অখেলোয়াড়োচিত মনোভাবটির অনুশীলন বেশ কয়েক বার দেখেছি। কিন্তু ভারতের ইংল্যান্ড সফরে আমরা দেখলাম টেস্ট ক্রিকেট এবং তার উত্তেজনা, তার প্রতিটি মুহূর্ত কতটা উচ্চ স্তরে পৌঁছতে পারে।
এই সিরিজ় জানান দিল বেশ কিছু তারকার আবির্ভাব হতে চলেছে। তাঁরা হয়তো ভারতীয় দর্শকদের আবার টেস্ট ম্যাচ দেখতে যাওয়ার অনুপ্রেরণা জোগাবেন।
সোমনাথ মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-৫৭
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)