E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: তিনিই যে বাংলার মুখ

উত্তমকুমার কি সর্বজনগৃহীত হয়েছিলেন, না কি বর্জিত হওয়ার শ্রান্তিও তাঁকে আপন্ন করেছিল? কেন গৃহীত হলেন, আবার বর্জিত হলেও বা কেন হলেন, এই আলোচনাই তাঁর জন্মশতবর্ষে আলোচ্য হওয়া দরকার।

শেষ আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০২৫ ০৫:২৯

সায়নদেব চৌধুরী লিখিত ‘তোমার পূজার ছলে’ (২১-৯) মূল্যবান প্রসঙ্গের অবতারণা করল। ৫৩ বছর বয়সে উত্তমকুমারের চলে যাওয়াটাও এতই আকস্মিক যে অশীতিপর গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস-এর মতো তাঁর এ-কথা বলারও অবকাশ ছিল না যে, গভীর বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হচ্ছি কিন্তু তবু, বিষণ্ণতায় আপন্ন না হলে কি শিল্প সৃষ্টি করা যায়? ‘ব্যাগি ট্রাউজ়ার্স পরিহিত’ এক মানবমিত্র বলেছিলেন, “ক্লোজ়-আপ-এ দেখলে জীবন ট্র্যাজেডি, কিন্তু লং-শট থেকে জীবন কমেডি”— বিশ্ব চলচ্চিত্রের আসর তাঁকে বলেছে ‘ট্র্যাজেডি কিং’– তিনি চার্লি চ্যাপলিন।

চলচ্চিত্র একটি দৃশ্যশ্রাব্য শিল্পমাধ্যম। কিন্তু কী দেখব আর কী শুনব, সে বিষয়টা ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে ভিন্ন। তা আবার ব্যক্তির আবাল্যলালিত নানা বিধিবিধানের তারতম্যে প্রভাবিত হয়— অর্থাৎ বহু ক্ষেত্রেই আমাদের দেখতে বা শুনতে দেওয়া হয় না, দেখতে বা শুনতে শেখানো হয়। এই শেখানোর উপরে নির্ভর করে শিল্প ও শিল্পী গৃহীত বা বর্জিত হন। উত্তমকুমার কি সর্বজনগৃহীত হয়েছিলেন, না কি বর্জিত হওয়ার শ্রান্তিও তাঁকে আপন্ন করেছিল? কেন গৃহীত হলেন, আবার বর্জিত হলেও বা কেন হলেন, এই আলোচনাই তাঁর জন্মশতবর্ষে আলোচ্য হওয়া দরকার। মৃত্যুর ৪৫ বছর পরে আমরা কি তাঁকে মরণোত্তর মৃত্যু উপহার দেব, না কি প্রকৃত উত্তমালোকে স্নাত হয়ে অসামান্য এই শিল্পীর জীবনসাধনা উপলব্ধি করে মৃতপ্রায় বাংলা চলচ্চিত্রে মৃতসঞ্জীবনীর সন্ধান করব? ৫৩ বছর বয়সে কেউ কি লং-শট থেকে জীবন দেখতে পায়? সাধারণ মানুষ না দেখতে পেলেও শিল্পীরা হয়তো পান— উত্তমকুমার নিশ্চয়ই দেখতে পেয়েছিলেন। পেয়েছিলেন বলেই হয়তো তথাকথিত স্বঘোষিত বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের চলচ্চিত্রবেত্তাদের চোখে যথাযথ মূল্য না পাওয়ার পরেও, তিনি খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের ম্যাটিনি আইডল। মানুষ তাঁর ছবিতে নিজেদের কান্না, ঘাম, স্বপ্ন, ভালবাসা দেখতে পেয়েছিলেন। বাংলা চলচ্চিত্রের কালপুরুষ সত্যজিৎ তাঁর নায়ক-এ আর দ্বিতীয় কোনও মুখ দেখতে পাননি এ কথা বহুশ্রুত।

তা হলে কি আমরা বলতে পারি যে ৫৩-তে প্রয়াত শিল্পীও তাঁর নিভৃতে বলেছিলেন, “গভীর বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হচ্ছি?” শিল্পীর বিষণ্ণতা ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়, শিল্পীর মননে ধরা পড়া তাঁর সময়ের বিষণ্ণতা তাঁকে আক্রান্ত করে— সেই সুর শাহরিক শাপমোচনে চলচ্চিত্রায়িত হয়েছিল প্রায় অভিব্যক্তিহীন বিপন্ন নিষ্পলক যে দৃষ্টির মাধ্যমে, তার দৃশ্যায়ন হয়তো একান্তই উত্তম-সুলভ। যে বিষণ্ণতা, যে বিপন্নতা মেলোড্রামা না হয়েও অভিব্যক্ত অসংখ্য ছবিতে। আমরা কি সত্যিই নজর করে দেখেছি এই বঙ্গে উত্তর-ঔপনিবেশিক কালে মানবীয় বিপন্নতার স্মারক তাঁর অসংখ্য অভিব্যক্তি কী ভাবে মধ্যবিত্ত ও খেটে খাওয়া ‘বাংলার মুখ’ হয়ে উঠেছিল?

উত্তমকুমার ‘ম্যাটিনি আইডল’ হিসাবে গৃহীত হয়েছিলেন কারণ তাঁর রূপায়িত পজ়িটিভ বা নেগেটিভ চরিত্রেরা সাধারণ মধ্যবিত্ত ও খেটে খাওয়া মানুষের ব্যক্তিগত ও বিষয়ভিত্তিক অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলে যায়। আমরা হয়তো প্রকৃত বস্তুনিষ্ঠ ভাবে ছবিগুলোর পাতায় পাতায় চোখ মেলে দেখলে দেখতে পাব মানবমনের প্রেম, হর্ষ, বিষাদ, বিপন্নতা, ক্রোধ, মোহ, কামনা, যন্ত্রণা ও স্বপ্ন কী আশ্চর্য শৈল্পিক দক্ষতায় ফুটে উঠেছে তাঁর মুখের রেখায় রেখায়, স্বরক্ষেপণে। সে সব দৃশ্য মন দিয়ে পড়লে অনুভব করব কী আশ্চর্য সাধনায়, মুহূর্তে ‘বাংলার মুখ’ পেরিয়ে গিয়েছে সমস্ত আঞ্চলিকতা, জাতীয় স্তরও পার হয়ে তিনি কখনও কখনও হয়ে উঠেছেন মার্লন ব্র্যান্ডো বা রিচার্ড বার্টন-এর মতো আন্তর্জাতিক।

অনিরুদ্ধ রাহা, কলকাতা–১০

কতটা পথ...

সায়নদেব চৌধুরী লিখিত ‘তোমার পূজার ছলে’ (২১-৯) প্রবন্ধটি মহানায়ক উত্তমকুমারের জন্ম-শতবর্ষে বলিষ্ঠ বিশ্লেষণ ও বিনম্র শ্রদ্ধামালা। প্রয়াণ পরবর্তী দীর্ঘ ৪৫ বছরে উত্তমের স্মৃতিরক্ষায় প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের চরম অবহেলা আর অভাব অনুভব করে লেখকের উক্তি, “পৃথিবীর যে কোনও বিখ্যাত, অপ্রতিরোধ্য অভিনেতার সঙ্গেই যে উত্তমের তুলনা করা চলে, শুধু তা-ই নয়— যাঁরা উত্তমকে পর্দায় খুব ভাল ভাবে দেখেছেন, তাঁরা জানবেন যে, উত্তম নিজের জোরে সেই তুলনা দাবি করেন।”

বক্তব্যের রসাস্বাদন করতে যেতে হবে উত্তমের সিনেমা-শিল্পে পা-রাখার প্রথম দিনগুলিতে, যেখানে ক্রমাগত হোঁচট খেতে খেতে এক দিকে মাস মাইনের চাকরি অন্য দিকে অভিনয়ের মোহে পড়ে হন্যে হয়ে স্টুডিয়োপাড়ায় ইতস্তত শম্বুক গতিতে ঘুরে বেড়িয়েছেন।

১৯৪৭ সাল। মায়াডোর নামে এক হিন্দি ছবিতে কাজ করেছিলেন কয়েক দিন। সে ছবি মুক্তিলাভ করেনি। দৃষ্টিদান ছবিতে প্রতিষ্ঠিত অভিনেতা অসিতবরণ-এর ছোটবেলার চরিত্রে অভিনয় করেই বলা যায় সিনেমার সোনালি পর্দায় উত্তমের প্রথম আত্মপ্রকাশ। দৃষ্টিদান-সহ উত্তম অভিনীত পরবর্তী ছবি কামনা, মর্যাদা, ওরে যাত্রী চরমতম অসফল। অনেকে জানেন, আবার না-ও জানতে পারেন উত্তমের সে দিনের মনের অবস্থা ! উত্তম তাঁর আত্মজীবনী আমার আমি-তে অকপটে লিখেছেন, “সে সময় এম পি (স্টুডিও) কর্তৃপক্ষ ‘সহযাত্রী’ (’৫১) নামে একটি ছবি তৈরি করবেন বলে মনস্থ করছেন। ভেতরে ভেতরে ওই ছবির হিরো হওয়ার স্বপ্ন দেখছি। এমন সময় জানতে পারলাম, ছবির নায়ক স্থির করা হয়েছে অসিতবরণকে। অসিতবরণ ছবির নায়ক শুনে মনটা আমার খারাপ হয়ে গেল। পরে খবর পেলাম, অসিতবাবু আরও কয়েকটি ছবির কাজে ব্যস্ত থাকার জন্য সহযাত্রী ছবিতে কাজ করতে পারবেন না। নিতান্ত স্বার্থপরের মতো আমার মনটা তখন উদ্বেলিত হয়ে উঠল। অবশেষে ভাগ্যদেবতা সুপ্রসন্ন হলেন। কর্তৃপক্ষ শেষ পর্যন্ত আমাকেই নায়ক হিসাবে মনোনীত করলেন।” দুর্ভাগ্য, সে ছবিও সাড়া ফেলেনি।

তার পর নির্মল দে পরিচালিত ছবি বসু পরিবার। এল আশাতীত সাফল্য! উত্তমকুমার লিখেছেন, “...আর সেদিন থেকেই হ’ল আমার নবজন্ম! আমি আগামী দিনের প্রতীক্ষায় রইলাম। মনে মনে সাধনা করে চললাম, পূজা করে চললাম অভিনয়-শিল্পের। অর্ঘ্য সাজালাম আগামী দিনের দর্শকদের জন্য।”

পরবর্তী প্রায় তিন দশকে সহজাত প্রতিভা, কঠোর অধ্যবসায়, একনিষ্ঠ সাধনা, অদম্য জেদ, সুদক্ষ কর্মনিপুণতা আর ভুবনমোহন হাসিতে, বাংলা-হিন্দি অগণিত স্মরণীয় ছবিতে প্রাণবন্ত অভিনয়গুণে, অজানতেই কখন যেন নিজেকে জড়িয়ে ফেললেন দেশীয় সীমা ছাড়িয়ে বিশ্ব-জনমানসে।

ভানুপ্রসাদ ভৌমিক, ডানকুনি, হুগলি

পূর্ণ মূল্যায়ন

সায়নদেব চৌধুরীর ‘তোমার পূজার ছলে’ প্রবন্ধটির অনুষঙ্গে কিছু কথা। উত্তমকুমারের জন্মশতবর্ষের প্রাক্কালে বাংলা চলচ্চিত্রে তাঁর অবদানের এটি একটি সময়োচিত নির্মোহ মূল্যায়ন। সমস্ত বাঙালি তার যৌবনে মশগুল থেকেছে ‘উত্তম-সৌমিত্র’ নিয়ে তর্কাতর্কিতে। সৌমিত্র প্রকৃত অ্যাক্টর, উত্তম কেবলই স্টার। সৌমিত্র বিদগ্ধজনের, উত্তম গড়পড়তা বাঙালির— এই তর্কে উন্মাদনা ছিল,আমোদ ছিল; কিন্তু সারবস্তু ছিল না। তাই বলে এই তর্কে অন্যায়ও ছিল না। ছিল কেবল যুক্তিপূর্ণ মূল্যায়নের অভাব। হাতে গোনা ব্যতিক্রম বাদ দিলে, সেই অভাবে আমরা ভুগছি উত্তমকুমারের মৃত্যুর ৪৫ বছর পরেও।

উত্তমকুমার যখন ধীরে ধীরে বাংলা সিনেমার অবিসংবাদিত নায়ক হয়ে উঠছেন তখন তাঁর চার পাশে অত্যন্ত শক্তিশালী একাধিক অভিনেতা। কী ভাবে সেই জ্যোতিষ্ক বলয় অতিক্রম করে শীর্ষে আরোহণ করলেন তার তেমন তথ্যসমৃদ্ধ বিশ্লেষণ কই? নায়ক থেকে মহানায়ক হয়ে ওঠার যাত্রাপথে তাঁর নায়িকাদের ও বিশিষ্ট চরিত্রাভিনেতাদের অবদানও অবিস্মরণীয়। সেই বিষয়টিরও যথাযথ মূল্যায়ন কতটা? নায়কের পাশাপাশি চরিত্রাভিনেতা, এমনকি খলনায়ক হিসাবেও একাধিক সিনেমায় যে অনবদ্য অভিনয়ের স্মৃতি রেখে গিয়েছেন, তারও বিশেষ আলোচনা হয় না। ‘গুরু’ বন্দনা সীমাবদ্ধ রোম্যান্টিক নায়কের আলোচনায়। শতবর্ষের উদ্‌যাপন এই চেনা গণ্ডির বাইরে বেরিয়ে যথার্থ মূল্যায়নে ব্রতী হবে, আশা রইল।

অম্বরীষ মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-৯৫

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Indian actor Arun Kumar Chatterjee Film Director

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy