E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: ওই বাঁধ ভেঙে দাও

সামাজিক ধ্যানধারণা একটি বৃহৎ বাধা। অনেক পরিবার এখনও মনে করে রাজনীতি নাকি পুরুষের কাজ। মেয়েদের ঘরে থাকা, সংসার সামলানো, বা নিরাপদ কাজ বেছে নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।

শেষ আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৬:৩০

প্রহেলী ধর চৌধুরীর লেখা ‘রাজনীতিতে মেয়েরা কম কেন’ (২৬-১১) প্রসঙ্গে কিছু কথা। ভারত-সহ দক্ষিণ এশিয়ার বেশিরভাগ দেশে রাজনীতিতে মেয়েদের যোগদান আজও সন্তোষজনক নয়। সমাজ, পরিবার, অর্থনীতি এবং রাজনৈতিক কাঠামো— সব মিলিয়ে বহু স্তরের বাধা মেয়েদের রাজনৈতিক জীবনে আগ্রহ ও সুযোগকে সীমিত করে।

প্রথমত, সামাজিক ধ্যানধারণা একটি বৃহৎ বাধা। অনেক পরিবার এখনও মনে করে রাজনীতি নাকি পুরুষের কাজ। মেয়েদের ঘরে থাকা, সংসার সামলানো, বা নিরাপদ কাজ বেছে নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। ছোটবেলা থেকেই নেতৃত্বের শিক্ষা বা রাজনৈতিক চর্চা মেয়েরা খুব কম ক্ষেত্রেই পান। ফলস্বরূপ, আত্মবিশ্বাস ও রাজনৈতিক দক্ষতা গড়ে ওঠার সুযোগ কম থাকে। দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতাও বড় কারণ। প্রচার, ভ্রমণ, দলীয় কার্যক্রম, মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ— এ সবের জন্য আর্থিক স্বনির্ভরতা জরুরি। অনেক মেয়েই অর্থনৈতিক ভাবে স্বাধীন না হওয়ায় ইচ্ছা সত্ত্বেও রাজনৈতিক যাত্রা শুরু করতে পারেন না। তৃতীয়ত, নিরাপত্তাহীনতা ও মানসিক ভয় মেয়েদের বাধা হয়ে দাঁড়ায়। রাজনৈতিক মিছিল, রাতের বৈঠক, বাড়ি থেকে দূরে প্রচার— এগুলোকে অনেকেই নিরাপদ মনে করেন না। এর সঙ্গে যুক্ত হয় সামাজিক ভাবে তৈরি করা হুঙ্কারের ভয়— “রাজনীতি মেয়েদের জন্য নয়”— যা তাঁদের মন থেকে এগিয়ে যাওয়ার সাহসটাই কেড়ে নেয়। চতুর্থত, রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরেই নারী-নেতৃত্ব তৈরির সুযোগ সীমিত। সিদ্ধান্ত গ্রহণের মূল জায়গায় পুরুষদের আধিপত্য বেশি, ফলে নারীরা মনোনয়ন, দায়িত্ব বা মঞ্চ— কোনও ক্ষেত্রেই যথেষ্ট প্রতিনিধিত্ব পান না।

তবে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নেতিবাচক নয়। শিক্ষা, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা, সামাজিক সচেতনতা এবং প্রশাসক, দলগুলির ইতিবাচক উদ্যোগ— এইগুলো মিললেই মেয়েরা বাধা পেরিয়ে যথেষ্ট সফল নেতা হয়ে উঠতে পারেন। সুযোগ পেলেই মেয়েরা দক্ষতা, সততা ও মানবিকতা দিয়ে রাজনীতিকে আরও শক্তিশালী করতে সক্ষম। তার দৃষ্টান্ত যে কতশত, তা আর মনে করিয়ে দেওয়ার দরকার নেই। অতএব, ভবিষ্যতে আরও নারীর রাজনীতিতে যোগদান নিশ্চিত করতে প্রয়োজন ঠিক পরিবেশ, নিরাপত্তা, সমান সুযোগ এবং পরিবার-সমাজের সহযোগিতা।

দীপক কুমার প্রামাণিক, গোপীবল্লভপুর, ঝাড়গ্রাম

অমর্যাদাই নিয়ম

প্রহেলী ধর চৌধুরীর ‘রাজনীতিতে মেয়েরা কম কেন’ শীর্ষক প্রবন্ধটি সময়োপযোগী এবং যথাযথ। বাস্তব বড় কঠিন। আজ একুশ শতকেও মানুষের মনে রয়ে গিয়েছে সেই মান্ধাতার আমল। তাই শত দৃষ্টান্ত সত্ত্বেও ভাবা হয়, নারী শাসক হয়ে উঠবেন, এমনটা কী করে হবে! তাই তো শিক্ষাদীক্ষায় অগ্রগণ্য ও অর্থনৈতিক ভাবে পুষ্ট আমেরিকার সাধারণ মানুষও নারীবিদ্বেষী ট্রাম্পের শাসন চান।

আসলে এমনটা হয়ে থাকে আর হয়ে এসেছে। আমার ভারতও যে সমান ভুক্তভোগী। প্রসঙ্গত মনে পড়ছে, সতীনাথ ভাদুড়ীর সেই বিখ্যাত ‘ডাকাতের মা’ গল্পে ছিল, “আগে সে ছিল ডাকাতের বউ। সৌখীর বাপ মরে যাবার পর থেকে তার পরিচয় ডাকাতের মা বলে।” পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজব্যবস্থায় পিতৃপ্রদত্ত নামটিও মুছে যায় কালের নিয়মে। আজ তো তবু রাজনীতির নানা স্তরে মহিলাদের আসন সংরক্ষিত হওয়ায় বড় সংখ্যক নারী রাজনীতির ময়দানে নেমে পড়তে পেরেছেন। কিন্তু তার পরেও দেখা যাচ্ছে, পঞ্চায়েতের বিবিধ পদে তিনি আসীন হলেও শেষ পর্যন্ত তাঁর স্বামী বা পুত্রের পরিচয়ই বড় হয়ে দাঁড়াচ্ছে, নেপথ্যে থেকে কাজও তাঁরাই সামলাচ্ছেন। নারীর জন্য আসন সংরক্ষণের নামে এই অমর্যাদা ও দমনমূলক নীতিই কি প্রাপ্য?

সূর্যকান্ত মণ্ডল, কলকাতা-৮৪

প্রস্তরাকীর্ণ

প্রহেলী ধর চৌধুরীর ‘রাজনীতিতে মেয়েরা কম কেন’ শীর্ষক প্রবন্ধটি পড়তে পড়তে ভারতীয় সমাজে সাড়া ফেলে দেওয়া একটি সংবাদের কথা মনে পড়ে গেল।

পঞ্জাবের অধুনা প্রয়াত ‘সুপার কপ’ কে পি এস গিল এক সময় অশান্ত পঞ্জাবে উগ্রপন্থীদের শায়েস্তা করতে প্রধান ভূমিকা নিয়েছিলেন। কিন্তু তিনিই পঞ্জাবের মহিলা আইএএস অফিসার রূপান দেওল বজাজের শ্লীলতাহানির দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন। শোরগোল ফেলে দেওয়া এই মামলাটি শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টে গড়ায়। তবে কারাদণ্ড মকুবও হয়ে যায়। দেশের এক জন আইএএস অফিসারের সঙ্গে এমন ঘটনা ঘটলে, সাধারণ মহিলাদের নিরাপত্তা যে কতটা অনিশ্চিত, তা ফের বেআব্রু হয়ে যায়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এই অবদমনই মহিলাদের এগিয়ে চলার পথটি প্রস্তরাকীর্ণ করে দেয়।

আরও মনে পড়ে যায়, দেশে জরুরি অবস্থার পর ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে বিরোধীদের আক্রমণ ছিল অত্যন্ত তীব্র ও ব্যক্তিগত পর্যায়ের। সে সময় পত্রপত্রিকায়, দেওয়াল জুড়ে কার্টুন এঁকে তাঁকে সাংঘাতিক সব অভিধায় ভূষিত করা হত। এমনকি তাঁকে ‘তন্ত্রসাধিকা’ও বলে দেওয়া হয়েছিল! আসলে নারী যখন শক্তি ও ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছে যান, তাঁর শাসন মেনে নিতে বাধ্য হন বীরপুঙ্গবরা, তখন তাঁকে শুধু রাজনৈতিক ভাবে নয়, ব্যক্তিগত ভাবেও আক্রমণ করার প্রবণতা বাড়ে। এক জন নারীকে অভিযুক্ত করার জন্য ‘ডাকিনী’, ‘কালো জাদু বিশেষজ্ঞ’ বা এই ধরনের নানা হিংসাত্মক শব্দচয়নের উদ্দেশ্য শুধু রাজনৈতিক আক্রমণই নয়, বরং তাঁকে মেনে নেওয়ার অপারগতা থেকে জাত পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার তিক্ত বহিঃপ্রকাশও।

অজয় ভট্টাচার্য, বনগাঁ, উত্তর ২৪ পরগনা

বৈষম্য মেটে না

সীমন্তিনী মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘শাস্তি দেওয়ার সহজ উপায়’ (৪-১১) শীর্ষক প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। আমরা যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমতা এখনও পাইনি তা সুস্পষ্ট। ভারতীয় সংবিধানের পাতায় সাম্যের বাণীর কথা থাকলেও বাস্তবে দলিত অনু্ন্নত বর্গের মানুষদের জন্য রয়ে গিয়েছে অসাম্যের অজস্র দৃষ্টান্ত। স্কুলে বসার জায়গা, মন্দিরে প্রবেশের ক্ষেত্রে, পোশাক, খাবার, জল— প্রায় সর্বক্ষেত্রে দলিতদের জন্য পৃথক ব্যবস্থা অলিখিত ভাবে চলে আসছে। দলিত যুবক কেন জন্মদিনে কেক কাটবেন, সেই জন্য তাঁকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে! দলিত যুবকের কেন ঘোড়ায় চড়ার স্পর্ধা জাগবে, বিয়ের আসরে দলিত যুবকের বাড়িতে কেন মাইক বাজবে, দলিত যুবতী কেন ব্রাহ্মণের সঙ্গে এক কুয়ো থেকে জল তুলবেন— এ সব বিচারে কেবলই বসে সালিশি সভা।

উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও দলিতদের প্রতি যে বৈষম্য এখনও বর্তমান, তার প্রমাণ রোহিত ভেমুলার ঘটনা। কয়েক মাস আগের একটা ঘটনায় গোটা দেশ স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। চণ্ডীগড়ে নিজের বাড়ি থেকে উদ্ধার হয় আইপিএস অফিসার ওয়াই পূরণ কুমারের দেহ। দলিত বলে তাঁকে নিজের কর্মক্ষেত্রেই নাকি উঠতে-বসতে নানা কথা শুনতে হত। এই মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করতে পারেননি, ফলে কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি নিজেকেই শেষ করে দেন। এক জন আইপিএস অফিসারের যদি এই মর্মান্তিক দশা হয়, তা হলে দেশের গ্রামেগঞ্জে অগুনতি দলিত নারী-পুরুষের অবস্থা কেমন আছে, তা সহজে অনুমেয়।

প্রশাসনেরও এই দলিত প্রান্তিক শ্রেণির মানুষদের কথা মনে পড়ে শুধু দেশে ভোট এলে! দেখা যায়, সবাই তখন দলিতদের কাছে টানার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছেন, সবাই ব্যস্ত দলিতদের বাড়িতে পাত পেড়ে খাওয়ার প্রতিযোগিতায়। যে দেশ দলিতদের ন্যূনতম সামাজিক মর্যাদা দিতে শেখেনি, সেই দেশে আর যা-ই হোক গণতন্ত্র নিয়ে গর্ববোধ করা সাজে না।

রতন চক্রবর্তী, উত্তর হাবড়া, উত্তর ২৪ পরগনা

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Women Empowerment Society

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy