Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Chandrabhaga Literary Festival

আলো ক্রমে আসিতেছে

এমনই কিছু দুর্লভ মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে রইলাম কোনারকের ‘চন্দ্রভাগা পোয়েট্রি ফেস্টিভ্যাল’-এ অংশ নিতে গিয়ে। ভারতের নানা প্রান্ত থেকে এসেছিলেন বিভিন্ন ভাষার কবিরা। প্রায় সকলেই পড়ছিলেন সাম্প্রতিক সময়ে লেখা কবিতা।

অংশুমান কর
শেষ আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

কবিতা পড়ছে ক্লাস ইলেভেনের ছাত্র শাশ্বত উপাধ্যায়। কবিতায় সে বলছে এক বিভাজনহীন পৃথিবীর কথা। পড়তে পড়তেই কাঁদতে শুরু করল। আমরা, যারা বয়সে অনেক বড়, বসে রইলাম কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে। রাষ্ট্র যখন বিভাজিত করতে চাইছে তার নাগরিকদের, তখন এক কিশোর বিভাজনহীন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতে চেয়ে অশ্রুপাত করছে, আর তার অশ্রু ঝরে পড়ছে সভাকক্ষের মার্বেল পাথরে। এমনই কিছু দুর্লভ মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে রইলাম কোনারকের ‘চন্দ্রভাগা পোয়েট্রি ফেস্টিভ্যাল’-এ অংশ নিতে গিয়ে। ভারতের নানা প্রান্ত থেকে এসেছিলেন বিভিন্ন ভাষার কবিরা। প্রায় সকলেই পড়ছিলেন সাম্প্রতিক সময়ে লেখা কবিতা। বিস্ময়ে লক্ষ করছিলাম, প্রায় সকলের কবিতাতেই বিষয় হিসেবে উঠে এসেছে সিএএ বা এনআরসি।

এই উৎসবের মধ্যমণি ইংরেজি ভাষার কবি জয়ন্ত মহাপাত্র। ‘চন্দ্রভাগা’ নামে পত্রিকাও দীর্ঘ দিন ধরে প্রকাশ করেন তিনি। ৯৫ বছর বয়সে, কটক থেকে এসেছেন উৎসবে। কবিতা পড়েননি, কিন্তু বললেন অমূল্য কিছু কথা। জয়ন্ত নিজে সারা জীবন চিৎকৃত কবিতা লেখেননি। তাঁর প্রতিবাদও থেকেছে নিচু তারে বাঁধা। কিন্তু তিনিও বললেন, সারা দেশ জুড়ে যে ভাবে সিএএ আর এনআরসি বিরোধী আন্দোলনে সামনের সারিতে এসে দাঁড়িয়েছে মেয়েরা, তাতে তিনি উচ্ছ্বসিত, গর্বিত। মেয়েদের কথা বললেন ওড়িয়া ভাষার কবি কেদার মিশ্রও। বললেন, এই সময়টা কবিতা লেখার নয়। বরং রাস্তায় থাকার। আর, মেয়েদের চোখেমুখে দীপ্ত হয়ে উঠছে যে স্লোগান— সেগুলোই তাঁর লেখা কবিতা। মহারাষ্ট্র থেকে এসেছেন সঞ্জীব খান্দেকর। তাঁর সঙ্গে ঘুরছে দু’জন সিকিয়োরিটি গার্ড। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কলম ধরার জন্য হুমকি পেয়েছেন তিনি। সঞ্জীব বললেন, মহারাষ্ট্রে কী ভাবে কবিরা সরব হয়ে উঠেছেন এনআরসির বিরুদ্ধে। কী ভাবে জল-জঙ্গল রক্ষার জন্যও কলম ধরেছেন তাঁরা। হিন্দি ভাষার কবি, দিল্লি-নিবাসী সবিতা সিংহ বললেন, কী ভাবে জনসমুদ্রে আটকে পড়ে, পুলিশের ব্যারিকেড ডিঙিয়ে তিনি যেতে পারেননি শাহিনবাগে কবিতা পড়তে। এক দিকে যখন গোটা দেশ জুড়ে চাপিয়ে দিতে চাওয়া হচ্ছে একটাই ভাষা, নির্মাণ করার চেষ্টা হচ্ছে ‘লিংগুইস্টিক হোস্টিলিটি’, তখন কবিতা হচ্ছে সেই পরিসর যেখানে এক ভাষার শব্দ ঢুকে পড়ছে অন্য ভাষায়, দেখা যাচ্ছে ‘লিংগুইস্টিক হসপিটালিটি’। দেরিদাকে ছুঁয়ে এ কথা বললেন মুম্বই-নিবাসী ইংরেজি ভাষার কবি অশ্বিনীকুমার।

চমকে উঠেছি উৎসবে অংশ নেওয়া মহিলা ও দলিত কবিদের কবিতা শুনে। সাহিত্য অকাদেমি যুবা পুরস্কার পেয়েছেন তরুণ দলিত কবি জয়দ্রথ সুনা। থাকেন কুখ্যাত, দারিদ্রপীড়িত কালাহান্ডিতে। তিনি যে কবিতাটি পড়লেন, তার বিষয় দেশ। আদিবাসী অধ্যুষিত মালকানগিরি থেকে কবিতা পড়তে এসেছিলেন এক তরুণী, তাঁর নাম কনক মহাকুদ। তিনিও যে কবিতা দু’টি পড়লেন, তাতে মেয়েদের সমস্যার কথা নেই। আছে দেশচ্যুত হওয়ার দুশ্চিন্তা। তাঁর কবিতা প্রশ্ন তুলছিল: জল-জঙ্গল-জমির সঙ্গে একাত্মতাই যাঁদের পরিচয়, এ দেশের সেই ‘আদি’ বাসিন্দারা কেন দাখিল করবেন নাগরিকত্ব প্রমাণের কাগজ? দু’দিনের এই উৎসবে দেখলাম, এমনকি বাংলা ভাষায় লেখা সিএএ-বিরোধী কবিতা অতি দ্রুত অনূদিত হয়ে গিয়েছে ওড়িয়া আর অসমিয়া ভাষায়। বুঝতে পারলাম, কবিতাকে আশ্রয় করে কাছাকাছি চলে আসছেন ভারতের নানা ভাষাভাষী মানুষ। তৈরি হচ্ছে সংযোগের সেতু।

আরও দু’টি জিনিস মনে হল। এক, সিএএ’র বিরুদ্ধে কবিতা লিখছেন যাঁরা, তাঁরা খুব স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিতে চাইছেন, রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কলম ধরা মানেই দেশদ্রোহ নয়। বরং তা দেশপ্রেমেরই দ্যোতক। দেশকে ভালবাসলে, রাষ্ট্রকে কখনও কখনও প্রশ্ন করতেই হবে। দ্বিতীয় জিনিসটি আরও গুরুত্বপূর্ণ এক সম্ভাবনার ইঙ্গিতবাহী। মহিলা বা দলিত কবিরা, তাঁদের খণ্ড-পরিচিতির ঊর্ধ্বে উঠে, প্রাধান্য দিচ্ছেন তাঁদের ‘ভারতবাসী’ পরিচিতিকে। জিজ্ঞেস করেছিলাম কনক মহাকুদকে, মেয়েদের সমস্যার কথা তো লিখতেন আপনি, এখন কেন লিখছেন দেশ, নাগরিকত্ব নিয়ে? বললেন, “এটাই সময়ের দাবি। রাষ্ট্র যদি বলে কাগজ দেখাতে না পারলে দেশ ছেড়ে চলে যাও, তা হলে আমি মনে রাখব না যে, আমি এক জন মহিলা, আমার প্রথমে মনে হবে, আমি এক জন ভারতীয়। রাষ্ট্র বললেই আমি দেশ ছেড়ে যাব না।”

আমাদের তো থাকে একাধিক পরিচিতি। তার থেকে যে-কোনও একটি পরিচিতিকে প্রধান করে তুললে কী বিপদ হয়, তা কী ভাবে অন্ধত্বের এবং হিংসার জন্ম দিতে পারে, সে কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন অমর্ত্য সেন। কিন্তু চন্দ্রভাগার তীরে কনকের কথা শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, পরিচিতি-সত্তার রাজনীতি, দেশের এই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে এক নতুন মাত্রা পাচ্ছে। কবিতার জগতের মতোই সামাজিক পরিসরটিতেও তো ‘আমি ভারতীয়’ এই একটিই পরিচয়কে সামনে নিয়ে এসে নির্মিত হচ্ছে এক অভূতপূর্ব জনঐক্য।

উৎসবে কনকের পড়া কবিতার একটি পঙ্‌ক্তির বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়, ‘রাত্রি বড় দীর্ঘ ও শীতল’। কিন্তু কবিদের কবিতা শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, কালো রাতি যাবে ঘুচে, আলো তারে দিবে মুছে। মনে হচ্ছিল, আলো ক্রমে আসিতেছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Chandrabhaga Literary Festival Literary Festival
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE