Advertisement
E-Paper

সবই অর্থনৈতিক স্বার্থে

জাতের অঙ্কে ভোট হয় না, বললেন সমাজতত্ত্ববিদ দীপঙ্কর গুপ্তজাতের অঙ্কে ভোট হয় না, বললেন সমাজতত্ত্ববিদ দীপঙ্কর গুপ্ত

শেষ আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০১৯ ০০:০০
সৌজন্য: ভোটের প্রচারে সমাজবাদী পার্টির নেতা মুলায়ম সিংহ যাদব ও বহুজন সমাজ পার্টির নেত্রী মায়াবতী, ১৯ এপ্রিল। পিটিআই

সৌজন্য: ভোটের প্রচারে সমাজবাদী পার্টির নেতা মুলায়ম সিংহ যাদব ও বহুজন সমাজ পার্টির নেত্রী মায়াবতী, ১৯ এপ্রিল। পিটিআই

প্রশ্ন: ভারতের রাজনীতিতে জাতের সমীকরণ নিয়ে আপনি দীর্ঘ দিন গবেষণা করেছেন। এই নির্বাচনেও তেমন বেশ কিছু সমীকরণ তৈরি হয়েছে— যেমন উত্তরপ্রদেশে বহুজন সমাজ পার্টির সঙ্গে সমাজবাদী পার্টির জোট। কর্নাটকে কংগ্রেস আর জনতা দল সেকুলারের জোটেও জাতের সমীকরণ স্পষ্ট। এই নির্বাচনে জাতের হিসেব কতখানি প্রভাব ফেলবে?

দীপঙ্কর গুপ্ত: এর উত্তরে আমি আগেও যা বলেছি, এখনও তা-ই বলব। প্রথম কথা হল, জেলাভিত্তিক যে জাতের হিসেব, সেটা সাধারণ লোকে বোঝে না। ফলে, জাতের ভিত্তিতে ভোটের কথাটা খুব প্রচলিত। কিন্তু, যদি জেলাওয়াড়ি হিসেবের দিকে তাকান, তা হলে দেখবেন, কোনও জেলায়, অথবা কোনও লোকসভা কেন্দ্রেই কোনও জাত নিরঙ্কুশ ভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়। আমরা যখন বলি যাদব কেন্দ্র অথবা জাঠ কেন্দ্র, আসলে কথাটা খুবই বাড়িয়ে-চড়িয়ে বলি। পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ জাঠ অঞ্চল হিসেবেই পরিচিত। কিন্তু, এখানে সংখ্যার হিসেবে জাঠের অনুপাত মাত্র আট শতাংশ। পুরো উত্তরপ্রদেশে যাদবদের অনুপাত সাত থেকে আট শতাংশ। যেখানে যাদবদের অনুপাত খুবই বেশি, যেমন বিহারে লালুপ্রসাদ যেখান থেকে ভোটে দাঁড়াতেন, মাধেপুরা— সেখানেও বড় জোর ২০% যাদব। ভারতে মরাঠাই একমাত্র জাত, গোটা রাজ্যে যার অনুপাত ত্রিশ শতাংশের বেশি। সেই কারণেই মরাঠাদের মধ্যে নকশাল থেকে বিজেপি, সব রাজনীতির লোক আছেন। যাঁরা জাতের হিসেবের ওপর ভিত্তি করে ভোটের ফলাফল অনুমান করেন, তাঁদের অনুমান খুব একটা মেলে না। এই কারণেই মেলে না যে জাত দিয়ে ভোট ধরা যায় না।

ধরুন, আপনি জাতে যাদব, আর সত্যিই যাদবদের জন্য কাজ করতে চান। লোকসভা ভোটে দাঁড়িয়ে আপনি ভোট চাইলেন। কিন্তু যাদবদের উপস্থিতি আছে, এমন কোনও গড়পড়তা লোকসভা কেন্দ্রে এই জাতের ভোটারদের অনুপাত তো মেরেকেটে আট শতাংশ। তার মানে, সেই কেন্দ্রে অন্য অন্তত আরও পাঁচটা জাত আছে, সংখ্যার হিসেবে যাদের জোর কম-বেশি সমান। অর্থাৎ, আপনি যদি জেতেনও, তা হলে শুধু যাদব ভোটে জেতেননি, অন্য জাতের লোকেরাও ভোট দিয়েছেন। এ বার, কেউই নিজের ভোটটা নষ্ট করতে চায় না। প্রত্যেকেই চায়, তার ভোটের যেন অর্থ থাকে। দেখবেন, বেশির ভাগ লোকসভা কেন্দ্রেই দু’জন প্রধান প্রার্থী থাকেন। পাঁচ-ছ’টা প্রধান জাত, আর দু’জন প্রধান প্রার্থী— অর্থাৎ, স্পষ্টতই বেশির ভাগ মানুষ নিজের জাতের বাইরে ভোট দিচ্ছেন।

তা হলে জাতের গুরুত্ব কোথায়? এখানেই, যে বিভিন্ন দলের নেতারা জাত দেখে প্রার্থী ঠিক করেন। আমি যদি নেতা হই, আমি চাইব আমার জ্ঞাতিগোষ্ঠীর লোকরা যেন ক্ষমতার কাছাকাছি থাকে। কিন্তু, ভোটাররাও যে সেই ছক মেনেই ভোট দেবেন, এটা নয়। ভোটাররা শুধু জাত দেখে ভোট দিলে কোনও প্রার্থীর পক্ষেই খুব বেশি ভোট পাওয়া সম্ভব হত না।

প্র: তা হলে, ভোটের মূল চালিকাশক্তিটা কী?

উ: এটা আসলে একটা ‘স্ট্রাকচারাল চেঞ্জ’-এর গল্প। ধরুন, এক সময় অবধি বলা হত, বিহারে ওবিসি বা অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির ভোট নিয়ন্ত্রণ করে যাদবরা। কেন? কারণ পূর্ব উত্তরপ্রদেশে বা বিহারের কিছু অংশে এই ওবিসি জনগোষ্ঠীর মানুষদের— যাঁরা মূলত ছোট চাষি কিন্তু আর্থিক ভাবে স্বনির্ভর— তাঁদের আশা-আকাঙ্ক্ষা বা প্রাপ্তির সঙ্গে যাদবদের যোগ ছিল। তার কারণ, যাদবদের মধ্যে লেখাপড়া জানা লোক ছিল, কেউ স্কুলমাস্টার, কেউ পুলিশ কনস্টেবল— ফলে, অনগ্রসর শ্রেণির লোকদের নিজেদের স্বার্থেই যাদবদের কাছে যেতে হত। গত পঁচিশ বছরে অন্যান্য তথাকথিত নিম্নবর্গের জাত, যেমন কোয়েরি, কুর্মিদের মধ্যেও লেখাপড়া জানা মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। তাঁরাও ক্ষমতাবান হয়েছেন। পুলিশের সঙ্গে, জেলাশাসকের সঙ্গে এঁদের যোগাযোগ তৈরি হয়েছে। সংরক্ষণের সুবিধা নিতে শিখেছেন তাঁরা। ফলে, যাদবের যে ক্ষমতার দাপট ছিল, সেটা কমে গিয়েছে। গত নির্বাচনে বিজেপি যখন প্রকাশ্যেই বলেছিল যে আমাদের যাদব ভোট চাই না, আমরা অন্য জাতগুলোর ভোট পাব, তখন কিন্তু অন্যান্য নিম্নবর্গের ভোটাররা যাদবদের প্রতি পুরনো আনুগত্য বজায় রাখেননি। কারণ, তাঁদের জাতের মধ্যেই এখন যথেষ্ট সামাজিক ক্ষমতা আছে, ক্ষমতার সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ আছে। ফলে, তাঁদের কাছে যাদবদের যে উপযোগিতা ছিল, সেটা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। পশ্চিম উত্তরপ্রদেশেও জাঠদের প্রাধান্য ছিল, কারণ অন্য যে জাত সংখ্যায় জাঠদের কাছাকাছি, সেই গুর্জর বা যাদবদের সঙ্গে শিক্ষায়, সামাজিক অবস্থানে জাঠদের ফারাক ছিল রীতিমতো। পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে যে কোনও কাজের জন্য অন্যদেরও জাঠদের মুখাপেক্ষী থাকতে হত, কারণ নিম্নবর্গের মধ্যে যাঁরা ক্ষমতাবান ছিলেন, তাঁরা সকলেই জাঠ। সেই পরিস্থিতিটা পাল্টেছে। শুধু ওবিসিদের মধ্যেই নয়, তফশিলি জাতিভুক্তদের ক্ষেত্রেও। উত্তরপ্রদেশে জাঠভ, মহারাষ্ট্রে মাহার— এদের গুরুত্ব কমেছে। প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রেও তার ছাপ পড়ছে, জোট তৈরির ক্ষেত্রেও।

প্র: তা হলে, মূল গল্পটা ক্লায়েন্টেলিজ়ম-এর, মানে, পাইয়ে দেওয়ার ভিত্তিতে আনুগত্য তৈরি করার?

উ: একেবারেই। যে হেতু এখন ক্ষমতায় এক ধরনের বিকেন্দ্রীকরণ ঘটেছে, বিভিন্ন জাতের উপস্থিতি বেড়েছে, ভোটের ছবিটাও পাল্টেছে। এখন যাদবদের পার্টিও অন্য জাতের লোককে টিকিট দিচ্ছে, জাঠদের দলও অন্যদের ভোটে দাঁড় করাচ্ছে। রাজনৈতিক সমর্থনের মূল উদ্দেশ্য সব সময়ই অর্থনৈতিক।

প্র: তার পরও, উত্তরপ্রদেশে সমাজবাদী পার্টি আর বহুজন সমাজ পার্টির জোটের প্রশ্নে আসি। মানুষ জাত দেখে ভোট দিক আর না-ই দিক, এই দলগুলোর রাজনীতি তো জাতের অঙ্কেই ছিল?

উ: উত্তরপ্রদেশে একেবারে বিধানসভা কেন্দ্র ধরে ধরে নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে আমি চর্চা করেছিলাম। ২০০২ আর ২০০৭ বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল ধরে দেখিয়ে দেওয়া যায়, প্রথম বারে মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টি যে কেন্দ্রগুলোতে ভোট পেয়েছিল এবং জিতেছিল, দ্বিতীয় বারে তার অনেকগুলোতেই হারল। আর, প্রথম বারের হেরে যাওয়া আসনে দ্বিতীয় বার জিতল। পাঁচ বছরের মধ্যে তো আর কেন্দ্রগুলোর জনসংখ্যায় জাতের অনুপাত বেবাক পাল্টে যাওয়া সম্ভব নয়। তা হলে কী দাঁড়াল? কোনও বারই জাতের লাইন ধরে ভোট হয়নি। এবং, এটা শুধু উত্তরপ্রদেশেই নয়, বিহার আর মহারাষ্ট্রের ভোটের ফলাফল বিশ্লেষণ করেও এই ছবিটাই পেয়েছি— বেশির ভাগ কেন্দ্রেই নির্বাচনী ফলাফলে ধারাবাহিকতা নেই। উত্তরপ্রদেশের বহু গ্রামে গবেষণার কাজ করে তাই দেখেছি।

ধরুন, কোনও এলাকায় কুর্মিদের আধিপত্য, চল্লিশ মাইল দূরে আর একটা এলাকায় আধিপত্য কোয়েরিদের। আমি কথা বলে দেখেছি, বহু কুর্মি জানেনই না যে কোয়েরি বলে আদৌ একটা জাত আছে! ফলে, জাতের অঙ্কে ভোটের হিসেব কষতে বসলে ঘোর মুশকিল। জাতের অঙ্কে যদি কোনও ভোটের ফলাফল নির্ধারিত হতে পারে, তবে সেটা গ্রাম পঞ্চায়েত। এটা হামেশাই হয় যে কোনও একটা গ্রামে কোনও একটি নির্দিষ্ট জাতের সংখ্যাধিপত্য আছে। ফলে, সেই জাতের প্রার্থীর সুবিধা। কিন্তু, তার চেয়ে বড় ভোটে জাতের অঙ্ক কাজে আসে না।

প্র: কিন্তু ধর্মের ভিত্তিতে ভোট? মুসলমান ভোটব্যাঙ্কের ধারণাও কি বিশ্বাসের উপর দাঁড়িয়ে?

উ: মুসলমানরা কাকে ভোট দেবেন, সেটা বলার চেয়ে বলা সহজ যে, তাঁরা কাকে ভোট দেবেন না। ধরে নেওয়া যায় যে, বেশির ভাগ মুসলমানই বিজেপি বা শিবসেনাকে ভোট দেবেন না। কিন্তু ধরুন উত্তরপ্রদেশেই কংগ্রেস ও সমাজবাদী পার্টি, দুটো দলই মুসলমান ভোটের প্রত্যাশী। সেই ভোট কোন দিকে যাবে, ভাগ হবে কি না, বলা খুব মুশকিল। ‘অঁ ব্লক ভোটিং’, মানে সমগ্র গোষ্ঠীভিত্তিক ভোট হতে গেলে একটা সর্বজনমান্য নেতৃত্বের প্রয়োজন হয়। মুসলমান সমাজের মধ্যে সেই নেতৃত্বের অভাব আছে। ফলে, পূর্বাভাস করা বিপজ্জনক।

জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজতত্ত্বের প্রাক্তন অধ্যাপক

সাক্ষাৎকার: অমিতাভ গুপ্ত

Lok Sabha Election 2019 Politics BJP SP BSP
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy