— ফাইল চিত্র
আবার সে আসিয়াছে ফিরিয়া। ক্ষুধার বিভীষিকা ফের বাংলার পল্লির ঘরে ঘরে। ক্ষুধা, অপুষ্টি, রক্তাল্পতা ক্রমবর্ধমান। ২০১৯-২০ সালের জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা জানাইয়াছে, দেশের দশটি বড় রাজ্যের মধ্যে সাতটিতেই শিশু-অপুষ্টি বাড়িয়াছে। শিশুর বয়সের অনুপাতে উচ্চতা, ওজন, এবং রক্তাল্পতা, এই তিনটি সূচক সেই সাক্ষ্য দিতেছে। একই চিত্র নারীস্বাস্থ্যেও। পাঁচ বৎসরের ব্যবধানে প্রসূতিদের মধ্যে রক্তাল্পতা বাড়িয়াছে। পশ্চিমবঙ্গের চিত্রটিও উদ্বেগজনক। প্রতি দশ জন প্রসূতির ছয় জন রক্তাল্পতায় ভুগিতেছেন, প্রতি তিন জন শিশুর এক জন পুষ্টির অভাবে যথাযথ উচ্চতা লাভ করে নাই। পাঁচ বৎসরের পূর্বে শিশুর দেহ ও মেধাশক্তির বিকাশের অতি গুরুত্বপূর্ণ ধাপগুলি অতিক্রান্ত হইয়া যায়। এই সময়ে অপুষ্টি শিশুকে সারা জীবনের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত করে। দেশেরও ক্ষতি কম নহে— শ্রমশক্তির দক্ষতা ও সক্ষমতা হ্রাস পাইলে অর্থনীতি দুর্বল হয়। প্রসূতি ও শিশু-অপুষ্টির সুদূরপ্রসারী আর্থ-সামাজিক প্রভাবের কথা চিন্তা করিয়াই বিশেষজ্ঞরা এগুলিকে মানব উন্নয়নের সূচকে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দিয়াছেন, এবং নিয়মিত পরিমাপের সুপারিশ করিয়াছেন। আক্ষেপ, রাজনৈতিক দলগুলির নিকট এই সকল সূচক কয়েকটি সংখ্যামাত্র হইয়া রহিয়াছে। সেগুলিকে নিজেদের সাফল্য প্রচারের অস্ত্ররূপে ব্যবহার করিতেই দলগুলি উৎসাহী, মূল বিষয়টিকে তাহারা এড়াইয়া যায়। তাই পশ্চিমবঙ্গে শিশু-অপুষ্টির বিপুল সঙ্কটের সম্মুখে দাঁড়াইয়া স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য মনে করাইয়াছেন শিশুমৃত্যু হ্রাসে এ রাজ্যে সাফল্য অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় অধিক। তিনি ভুলিয়াছেন, অসুস্থ, অশক্ত হইয়া বাঁচিয়া থাকা অর্থহীন। সক্ষম, সার্থক জীবনের জন্য শিশুর প্রথম প্রয়োজন পুষ্টিকর খাদ্য।
কোভিড অতিমারি দেখা দিবার পূর্বেই অর্থনীতির মন্দ দশা, কর্মহীনতা বৃদ্ধি, ব্যয়ক্ষমতা হ্রাস সাধারণ নাগরিকের খাদ্য নিরাপত্তায় আঘাত হানিয়াছিল। তাহার উপর কোভিড অতিমারি খাদ্য সঙ্কটকে তীব্রতর করিয়াছে। পশ্চিমবঙ্গে একটি অসরকারি সমীক্ষায় এই তথ্য মিলিয়াছে যে, গত এক মাসে আঠারো শতাংশেরও অধিক মানুষ অভুক্ত অবস্থায় নিদ্রা গিয়াছেন, এবং চুয়াল্লিশ শতাংশ খাদ্যের প্রয়োজন মিটাইতে টাকা ধার করিয়াছেন। ডাল, আনাজ এবং মাছ-ডিম প্রভৃতি পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ যে হারে কমিয়াছে, তাহা আশঙ্কাজনক। এই পরিসংখ্যান লইয়া প্রশাসন প্রশ্ন তুলিতে পারে। কিন্তু প্রকৃত চিত্র কী, তাহা বুঝিবার প্রয়োজন তাহাতে কমে না। লকডাউনে খাদ্যাভাবের কতখানি তীব্র হইয়াছিল, বিবিধ সমীক্ষা স্পষ্ট করিয়াছে। আনলক পর্বেও সেই খাদ্যসঙ্কটের রেশ চলিতেছে, এই অনুমান অসঙ্গত নহে।
খাদ্যাভাবই অপুষ্টির একমাত্র কারণ নহে। সুষম খাদ্যের অভ্যাস, উন্মুক্ত শৌচ দূরীকরণ, এইগুলিও গুরুত্বপূর্ণ। সেই সকল বিষয়ে সতর্ক থাকিতে হইবে। কিন্তু আজ সর্বাগ্রে ক্ষুধার ব্যাপকতা ও তীব্রতাকে স্বীকৃতি দিয়া, তাহার প্রতিকারে সর্বশক্তি প্রয়োগ করা প্রয়োজন। কেন্দ্র রেশনে বিনামূল্যে অতিরিক্ত খাদ্যশস্য বিতরণ বন্ধ করিয়াছে, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র এবং স্কুলগুলি বন্ধ থাকিবার জন্য পুষ্টি প্রকল্পগুলিও ক্ষতিগ্রস্ত। একটি হিসাব, লকডাউন কালে অন্তত ১৭ হাজার টন খাদ্যশস্য হইতে বঞ্চিত হইয়াছে প্রসূতি ও শিশুরা। মাছ-ডিমের মতো প্রোটিনযুক্ত খাদ্যও মেলে নাই শিশুদের। অর্থাৎ, কোভিড পরিস্থিতিতে নাগরিকের খাদ্যের অধিকার উপেক্ষিত হইয়াছে, তাহার ফলে বিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছে শিশুরা। কেবল চাল-গম বিতরণই যথেষ্ট নহে, দরিদ্র পরিবারের কর্মসংস্থান, খাদ্যের মূল্যস্ফীতি রোধ, এমন বহুমাত্রিক ব্যবস্থা প্রয়োজন। শিশুর ক্ষুধা, প্রসূতির অপুষ্টি আজ রাষ্ট্রের নিকট অগ্রাধিকার দাবি করিতেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy