Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

আমরা কি সত্যিই ভাল আছি, আনন্দে আছি?

চারপাশে উন্নয়ন চলছে। এ দিকে, নবীন প্রজন্মের অনেকেই দিশাহীন অবসাদে হাবুডুবু খেতে খেতে মুক্তির পথও খুঁজছে অভিশপ্ত আত্মহননে। লিখছেন সুদীপ্তকুমার চক্রবর্তীতিন জনের উল্লাস এবং তাদের দেখে বড়দের বিস্ময় এক জীবন্ত বাস্তব ছবি যা উন্নয়ন শব্দটিকে এক প্রকাণ্ড প্রশ্নচিহ্নের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

শেষ আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০১৯ ০১:১৬
Share: Save:

আপাত সামান্য কিন্তু অসামান্য একটি ঘটনার দিকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ না করে পারছি না। একটি সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার জেলা স্তরে যোগ দিয়েছিল ষষ্ঠ শ্রেণির তিন জন ছাত্র। তিন বন্ধু তাঁরা। একই বিদ্যালয়ে পড়ে। ওই প্রতিযোগিতার নিয়ম অনুযায়ী, যারা প্রথম স্থান অধিকার করবে তারা রাজ্য স্তরে যোগ দেওয়ার সুযোগ পাবে। বিকেল নাগাদ প্রতিযোগিতার ফল ঘোষিত হতে শুরু করল। অনেক ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা, অভিভাবক-অভিভাবিকা দুরু দুরু বক্ষে অপেক্ষমান।

তিন বন্ধুর এক জন দ্বিতীয়, অন্য জন তৃতীয় স্থান অধিকার করেছে। অর্থাৎ তারা রাজ্য স্তরে যাওয়ার সুযোগ পায়নি। মিনিট পনেরো পরে সাঁওতালি গানের ফল প্রকাশিত হলে দেখা গেল, তৃতীয় বন্ধুটি প্রথম স্থান অধিকার করে রাজ্য স্তরে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। তৃতীয় বন্ধুটি একটু লাজুক ও মুখচোরা গোছের। ফল শুনে সে সংহত আবেগ নিয়েই দাঁড়িয়ে রইল। কিন্তু তাকে ঘিরে সেই পূর্ণ সভাকক্ষে বাকি দুই বন্ধুর উল্লাস ও লাগামছাড়া অনাবিল আবেগ উপস্থিত অনেককেই অত্যন্ত বিস্মিত করে তুলল। তাঁদের চোখ মুখের ভাষা বলছিল, এই যুগেও এমনটি হয় নাকি? অন্যের সাফল্যে এত আনন্দ কোথা থেকে আসে?

ওই তিন জনের উল্লাস এবং তাদের দেখে বড়দের বিস্ময় এক জীবন্ত বাস্তব ছবি যা উন্নয়ন শব্দটিকে এক প্রকাণ্ড প্রশ্নচিহ্নের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়। যে পরার্থপরতা মনুষ্য চরিত্রের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হওয়ার কথা তা অাজ ‘ব্যতিক্রমী’ তকমাপ্রাপ্ত। কারণ, আমাদের ‘উন্নয়ন’-এর সংজ্ঞা চরিত্র এবং চরিত্রের বিকাশ সম্পর্কে একটি কথাও

বলে না। উন্নয়নের সংজ্ঞা খুঁজতে গিয়ে দেখি, সেখানে বিস্তর ভারী ভারী কথা বলা আছে। যেমন, বিশ্বায়ন, আধুনিকীকরণ, হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইন্ডেক্স, গ্রস ডোমেস্টিক প্রডাক্ট, দারিদ্র দূরীকরণ, মাথাপিছু আয় ইত্যাদি। যদি বলি এত আয়োজন কাদের জন্য? নিশ্চয়ই বলবেন, ‘‘মানুষের জন্য।’’ কিন্তু মানুষ মানে কি একটা অবয়ব মাত্র, শুধু আহার নিদ্রা আর মৈথুনে যিনি বাঁচেন? মানুষ তো তাঁকেই বলি যিনি ‘ব্যক্তিত্ব থেকে বিকশিত ব্যক্তিত্বে’, ‘ক্ষুদ্র আমিত্ব থেকে বৃহৎ আমিত্বে’ উত্তীর্ণ হন। কিন্তু মানব চরিত্রের এই প্রসারের কথা তো উন্নয়নের সংজ্ঞায় কিছুই বলা নেই।

আমাদের পাঠ্যসূচিতে আমরা কি আমাদের সন্তানদের শেখাই মনুষ্যত্ব, সামাজিকতা, পরার্থপরতা কিংবা অহংশূন্যতার কথা? তারা কি জানে ‘সম্প্রসারণই জীবন আর ক্ষুদ্রতাই মৃত্যু?’ আমরা কি তাদের শেখাই, ‘কী করে রাস্তা পার হতে হয় অথবা কাউকে রাস্তা পার করিয়ে দিতে হয়?’ আমাদের পাঠ্যসূচিতে কি প্রত্যক্ষ ভাবে সেই শিক্ষাদানের ব্যবস্থা আছে যে, কী ভাবে সুজন এবং স্বজন হয়ে ওঠা যায়। কিংবা কী ভাবে মনের মধ্যে গেঁথে রাখা যায় সেই মহা মূল্যবান কথা—‘সন্তোষের সমান ধন নাই?’ আমাদের শিশুরা তাদের বিজ্ঞান বই থেকে জানে আগুনের দাহিকাশক্তির কথা। কিন্তু ‘যে ঘরে বাস করছি, সেই ঘরে আগুন লাগলে নিজেরাও যে পুড়ব’— এই সত্যি তারা জানে কি? কোন পাঠ্য বইয়ে লেখা আছে সত্যি করে ভাল থাকার পথ?

উন্নয়নের সংজ্ঞায় চরিত্রের বিকাশের কথা ব্রাত্য বলে উন্নয়নের মূল উদ্দেশ্য অর্থাৎ ‘ভাল থাকা, আনন্দে থাকা’ পদে পদে ব্যাহত হচ্ছে। তথাকথিত উন্নয়ন হচ্ছে বিস্তর, শিক্ষারও বিস্তার এখন বিপুল। কিন্তু আনন্দে আছেন কি বৃদ্ধাবাসের সেই বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা যাঁদের অনেককে প্রায় ভুলেই গিয়েছেন তাঁদের আত্মজরা! কিংবা সচ্ছল বাড়ির সেই বৃদ্ধের কথা ভাবুন। বাড়ির এক প্রান্তে বেতনভুক সেবিকার দায়িত্বে পড়ে থাকেন। সারা দিনে তাঁর পাশে বসে একটু সঙ্গ দেওয়ার সময় কারও হয় না। সেই ঋজু মানুষটিকে মনে আছে? শরণাগত ভিন্ন ধর্মাবলম্বীকে মানবধর্ম মেনে আশ্রয় দেওয়ার অপরাধে যাঁর ধোপা-নাপিত বন্ধ হয়?

উন্নয়নের জন্য কত প্রজেক্ট, কত স্কিম, মিটিংয়ের পর মিটিং। নতুন, নতুন রাস্তা, সেতু, হাসপাতাল, স্কুল কলেজ তৈরি হচ্ছে। উন্নয়নের জোয়ার দেখে এবং দেখিয়ে রাজপুরুষেরা সন্তুষ্টচিত্তে তথ্যচিত্র নির্মাণ করছেন। আর এ দিকে নবীন প্রজন্ম, আমাদের ভবিষ্যতের ভারত নেশায় বুঁদ হয়ে ঝিমোচ্ছে অসুস্থ মুরগির মতো। দিশাহীন অবসাদে হাবুডুবু খেতে খেতে তারা মুক্তির পথ খোঁজে অভিশপ্ত আত্মহননে। উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত উচ্চ পদস্থদের অন্তর্জগতের উন্নয়নের জন্য কতটা জায়গা রয়েছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায়?

শ্রীরামকৃষ্ণের বলা একটি গল্প মনে হয় এ ক্ষেত্রে খুব প্রাসঙ্গিক হবে। দুই মদ্যপের গল্প। এক রাতে নেশায় বুঁদ অবস্থায় তাঁদের ইচ্ছে হল, তাঁরা নৌকা করে দক্ষিণেশ্বর থেকে কাশী যাবেন। যেমন ভাবা তেমন কাজ। দক্ষিণেশ্বরের গঙ্গার ঘাটে নৌকো বাঁধাই ছিল। অন্ধকারে দুই মদ্যপ নৌকায় বসে প্রাণপণে বৈঠা বাইতে লাগলেন। ভয়ানক পরিশ্রম সারারাত। যখন ভোর হয়েছে তখন তাঁদের নেশা গিয়েছে টুটে। সবিস্ময়ে তাঁরা আবিষ্কার করলেন যে, তাঁরা সারারাত একটুও এগোতে পারেননি, দাঁড়িয়ে আছেন একই জায়গায়। এ কী কাণ্ড! কেন এমনটি হল? দেখা গেল, তাঁরা সারারাত প্রাণপণে নৌকা বেয়েছেন, কিন্তু নোঙরটা তুলতেই ভুলে গিয়েছেন। মনে হয়, এর পরে আর কোনও

ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন।

সহকারী প্রধান শিক্ষক, সারগাছি

রামকৃষ্ণ মিশন উচ্চ বিদ্যালয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Depression Society Suicide
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE