Advertisement
E-Paper

দানের ভিতর দিয়ে যখন

টাকা যা দিতে পারবে না, এই দাতা ইমেজ আমায় তা দেবে। ছিলাম লোকের হিংসের আর সমীহর ছোকরা, এ বার হতে চাইছি প্রণামের মনীষী।টাকা যা দিতে পারবে না, এই দাতা ইমেজ আমায় তা দেবে। ছিলাম লোকের হিংসের আর সমীহর ছোকরা, এ বার হতে চাইছি প্রণামের মনীষী।

শেষ আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০১৫ ০০:২৭
Share
Save

আরে বাপ রে বাপ! এই না হলে মানুষ জাত! বেইমানের গুষ্টি! আমি আর বউ মিলে ফেসবুকের ৯৯% শেয়ার দানছত্তর করে দিলাম, মানে সব মিলিয়ে মোট ৪৫ বিলিয়ন ডলার, মানে ভাবতে গেলে ললাটের রগ ঠেলে ওঠে মগজ পিলপিলিয়ে যায় এত টাকা, কোথায় তক্ষুনি সবাই মিলে ধন্য ধন্য করবে, সাষ্টাঙ্গে পায়ে পড়ে না-ধোয়া চেটোয় চুমু খাবে, গাঁদার মালা আনতে মাঝরাত্রে ফুলওলাকে ঝাঁপ খোলাবে, আসার পথে পাঁঠার ঘুগনিও আনবে, তা নয়কো, সবাই ছমছমে অভিসন্ধি খুঁজছে! নালিশ-ফালিশ সরিয়ে আগে একটা সোজা কথা ভাব না, এই ইয়াং বয়সে এতগুলো টাকা কেউ কোথাও দান করেছে? সব বুড়ো হাবড়াগুলো পয়সা দেয়-থোয়, যখন আর মাংস খাওয়ার দাঁত নেই, চিমটি কাটার হাত নেই। আমি সবে তিরিশ বছর পেরোতে না পেরোতে নিজের অতুল কীর্তিতে হরিশ্চন্দ্রকে খানায় ফেলে, বিল গেটসকে টুসকি মেরে, ইতিহাসের পাতায় ডবল-গ্যাঁট হচ্ছি (প্রথম স্ট্যাচুটি তো ফেসবুক প্রতিষ্ঠার পরেই উদ্যানে গরগরীয়ান), এ সময়েও তোরা ফিচেল কমেন্ট ছাড়বি? এও শুনছি, এই খবরের সঙ্গে আমার আর আমার বউয়ের যে ছবি সারা বিশ্বে ছাপা হয়েছে, তা দেখে একটা লোক নাকি প্রশস্তি করে বলেছে, উফ, উনি কী অসম্ভব মহান! উন্মাদের মতো বড়লোক হয়েও, অমন সাধারণ দেখতে মেয়েকে বিয়ে করেছেন! এ জাতের জন্যে কেউ এক নয়াও খরচা করে! ভুল হয়েছে!

বড় বড় কাগজে লেখা হচ্ছে, আমি কিস্যুই দান করিনি, সেরেফ এক পকেট থেকে আর এক পকেটে টাকা চালান করেছি মাত্তর। আর, তাতে পেল্লায় ট্যাক্স বাঁচিয়ে নিয়েছি নিজের। কেউ বলছে, দানই যদি করবে বাবা, চ্যারিটি-কেন্দ্রেই টাকা ঢালতে পারতে! তার বদলে, নিজে একটা লিমিটেড লায়াবিলিটি কোম্পানি তৈরি করে, তাতে দিলে কেন? এই কোম্পানি তো তার টাকা অন্য প্রফিটসর্বস্ব কোম্পানিতেও বিনিয়োগ করতে পারবে, পলিটিকাল পার্টির ফান্ডেও দিতে পারবে, এমনকী আইন বদলানোর জন্য লবি-ও করতে পারবে। এই দানে তো ঠিক নিঃস্বার্থ ত্যাগের গন্ধ নেই, বরঞ্চ ছুঁকছুঁক সুযোগসন্ধানের থাবা-ছাপ! ওরে গাধারা, কোথাও একটা ঝপাস করে টাকা ফেলে দিলেই সেটা ফিটফাট ‘দেওয়া’ হয় না, দিতেও জানতে হয়। একটা এক্সপার্টের কথা শোন। সে বলে, ধরা যাক, একটা বাড়িতে আগুন ধরেছে, তাতে একটা ঘরে একটা বাচ্চা, একটা ঘরে পিকাসোর একটা ছবি। যে কোনও একটাকে তুমি বাঁচাতে পারবে। কাকে বাঁচাবে? নিরানব্বুইটা লোক বলবে, বাচ্চাটাকে। কিন্তু এক্সপার্ট বলছে, ‘ঠিক’ বাঁচানো হচ্ছে পিকাসোর ছবিটাকে। সেটাকে বেচে তুমি যে বিপুল টাকাটা পেলে, তা দিয়ে আফ্রিকার কতশত বাচ্চাকে মশারি কিনে দাও, যাতে তারা ম্যালেরিয়ায় না মরে। সে রকমই, কোটি কোটি টাকা একটা আরবিট প্রণামীর বাক্সে ফসকে দেওয়া যায় না। ব্যাটারা সে পুঁজিতে নর্থ পোলে সহস্র ইগলুতে এসি ফিট করল কি না, তা-ও ভুরু কুঁচকে ভাবতে হয়। তার চেয়ে নিজের টাকা কোথায় যাবে কদ্দূর দৌড়বে, আমার কোম্পানিতে বসে আমিই ঠিক করব।

জানি, ‘দান’ শুনলেই একটা রোগা আতুর হাড়সর্বস্ব কেলটে হাতের ছবি ভেসে ওঠে। সেখানে আমি থাকব না, অন্য অচেনা লোকরা সে হাতে মলিন পাঁপড়ভাজা দেবে, আর আমার একটা আবক্ষ স্ট্যাচু লঙ্গরখানায় কাগবিষ্ঠা ঝেলবে। কিন্তু এ সব ন্যাকামি তো ঘোচাতে হবে, আমাদের ফোন স্মার্ট হচ্ছে, মন হবে না? ফান বদলে ফেলছি, দান বদলাব না? যে সংস্থায় দান করব, সেটা কেন বিশ্বক্যাবলা হতে হবে? সেটাকে কেন মাটির বাড়িতে ধ্যাবড়া আলপনায় অধিষ্ঠিত হতে হবে? সে সংস্থা ঢালুক না রাজনীতির ফান্ডে টাকা, করুক না পিঁপড়ের পেট চিপে নাগাড়ে গুড় বের করা কোম্পানিতে বিনিয়োগ, ক্ষতি কী? আসলি কথা হল, যে টাকাটা লাভ হচ্ছে, তা দিয়ে সে ভাল কাজ করছে কি না, ব্যস।

কী বললি? এতে নির্লজ্জ বেওসা ছাড়া কিচ্ছুরই গন্ধ আসছে না? লক্ষ্যে পৌঁছনোর জন্য বাজারে উদোম হয়ে নেত্য করলে তাকে সুকাজ বলে না? এই জন্যেই তোরা বিরাট হলি না, ক্ষুদ্র হয়ে থাকলি। বিরাট কোহলি বলে, খাটালের মতো পিচ বানালেও খেলাকে অপমান করা হয় না, খেলা যেমন করে হোক জিততে হয়। স্পোর্টসম্যান স্পিরিট মানে খেলার আত্মাটা বোঝা নয়, জেতার কৌশলগুলো বোঝা। মারাদোনা হাত দিয়ে গোল করল, তার মহিমা কণামাত্র কমলো? উঁহু, রেফারি বা শ্যাম, বাঁশি বাজিয়েছে মানে সব ঠিকঠাক আছে। আমার দানের এই বিশাল অংকটা একটা ন্যালাখ্যাপা কোম্পানির বদলে, দুরন্ত মার্কেট-মাতোয়ারা কোম্পানির হাতে দিলে, তারা তাবৎ ঘাঁতঘোঁত জেনে ও মেনে, নিজ কোলের দিকে স্পাইসি ঝোল টেনে, চাবকে টাকা তুলবে, জানবে কোনখানে আজকে তেল দিলে কালকে ফুয়েল উঠে আসে। আজ পাঁপড়, কাল পিৎজা পড়বে সেই প্রসারিত ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ক্লিপিং-এ।

বহুত ভ্যানতারা হল। আসল কথা বলি। আগেকার লোকে ভাবত, ব্যবসার মূলধন ও বুল’স আই শুধু টাকা। একেবারে বোকা কনসেপ্ট। ফেসবুক নিয়ে যা মাতামাতি, ফুলের তোড়া, সব হয়ে গেছে। টাকারও তো শেষ নেই। এ বার আমায় ‘আমি’ ব্র্যান্ডটা তৈরি করতে হবে। ইতিহাসে এন্ট্রি নিতে হবে। তাই অন্য ফ্ল্যাংক দিয়ে বল নিয়ে এগোচ্ছি। এখন লোকে আমায় চিনুক শুধু জমজমাট জিনিয়াস নয়, উরিব্বাস উদ্যোগপতি নয়, কম বয়সে মিরাক্‌ল-মার্কা ধনী নয়, এক ফুৎকারে পয়সা উড়িয়ে গরিবের কোলে ফেলার মতো উদ্দাম উদার হিসেবেও। টাকা যা দিতে পারবে না, এই দাতা ইমেজ আমায় তা দেবে। ছিলাম লোকের হিংসের আর সমীহর ছোকরা, এ বার হতে চাইছি প্রণামের মনীষী। কারণ, এই বিশ্ব এখনও এত ছ্যাঁচড়া, অফিশিয়ালি বুমবুম-বেনিয়াকে পেন্নাম ঠোকে না।

লেখাটির সঙ্গে বাস্তব চরিত্র বা ঘটনার মিল থাকলে তা নিতান্ত অনিচ্ছাকৃত, কাকতালীয়

mark zuckerberg donation facebook shares charity

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}