Advertisement
E-Paper

এই মার আর কট্টুকু! থাকত খাপ পঞ্চায়েত, দেখিয়ে দিতাম

আসলে আমাদের এখানে তো ও সব হয় না, ওই খাপ পঞ্চায়েতের কথা বলছি। খাপ পঞ্চায়েত থাকত তো দেখাত মজা। এই অসভ্য কাজের জন্য ছেলেটা আর মেয়েটাকে লোকের সামনে গাছে বেঁধে জামাকাপড় খুলিয়ে পেটানোর রায়ও দিয়ে ফেলত হয়তো।

তাপস সিংহ

শেষ আপডেট: ০৫ মে ২০১৮ ০০:০৫

এই শহর আমার সব কিছু জানে না! এ শহর জানে না, এক বৈশাখী রাতে মেট্রো রেলের কামরায় আলিঙ্গনাবদ্ধ যুগলকে দেখে রাগে সর্বাঙ্গ জ্বলে গিয়েছিল আমার। ভিড়ের মেট্রোর কামরায় দু’জন এমন ভাবে দাঁড়িয়েছিল, মনে হল পাড়ার ছেলেরা রাস্তায় কুকুরযুগলকে দেখে যেমন ‘হ্যা হ্যা’ করতে করতে বাঁশ দিয়ে পিটিয়ে আলাদা করে, সে ভাবেই ওদের পিটিয়ে আলাদা করে দিই। ভেবেছে কী? যেখানে সেখানে যা তা করে বেড়াবে! সমাজ বলে কিছু নেই? লাজলজ্জাও নেই!

বললাম, ‘‘এ সব কী হচ্ছে?’’ ছোকরা বলে কিনা, ‘‘আপনি বসে থাকুন। চাপ নেবেন না। আপনার ব্লাড প্রেশার বেড়ে যাবে।’’ এত লোকের সামনে এ ভাবে মুখের উপর বলে বসল! খুব বেড়েছে দেখছি। বললাম, ‘‘নিজেকে সলমন খান ভেবেছে!’’ বলামাত্রই সে করল কী জানেন? জামার কলারটা আলতো করে তুলে কামরার আরও দশটা লোককে শোনাবে বলে গলাটা চড়িয়ে বলল, ‘‘আপনারা শুনলেন, উনি আমাকে সলমন খান বললেন! এটা আমি কিন্তু কমপ্লিমেন্ট হিসেবেই নিচ্ছি।’’

আর ধৈর্য রাখতে পারিনি। চিৎকার করে কাঁচা খিস্তি দিয়ে বললাম, ‘‘দমদমে নাম আগে, দেখছি।’’ এত বড় সাহস! আমার সঙ্গে লোক আছে। ওরাও ডেলি প্যাসেঞ্জার। হাওয়া গরম করতে চিৎকার করে উঠলাম। ব্যস, কামরা গরম।

আসলে আমাদের এখানে তো ও সব হয় না, ওই খাপ পঞ্চায়েতের কথা বলছি। খাপ পঞ্চায়েত থাকত তো দেখাত মজা। এই অসভ্য কাজের জন্য ছেলেটা আর মেয়েটাকে লোকের সামনে গাছে বেঁধে জামাকাপড় খুলিয়ে পেটানোর রায়ও দিয়ে ফেলত হয়তো। দলিত ছেলে জাঠ মেয়ের সঙ্গে প্রেম করে তাকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে গেল। খাপ পঞ্চায়েত ছেলেটার পরিবারকে বলল, ওরা যদি না আসে তা হলে ছেলের দুই বোনকে রেপ করে উলঙ্গ করে ঘোরানো হবে। ভেবেছে কী? দলিত হয়ে এত সাহস! আহা, মোড়লদের কী সুন্দর নির্দেশ দেখেছেন?

আরে, ট্রেনের ওই ছেলেটাও তো প্রায় দলিতদের মতোই আচরণ করছিল, তাই না? তুই একটা ফর্সা টুকটুকে, হাই-ফাই যুবতীকে বুকে জড়িয়ে এতটা রাস্তা যাবি? আর আমরা বসে বসে দেখব? ক’টা তালিবান যদি এখানে থাকত তো মজা বুঝতিস! শহিদ মিনারের সামনে লোক জড়ো করে খুঁটিতে বেঁধে দুটোকে চাবকাত। চাবুকের ঘা খেতে খেতে, ঘা খেতে খেতে দু’জনে এক সময় নেতিয়ে পড়ত, টিভিতে লাইভ দেখাত। ব্যস, পরের দিন থেকেই বোরখা পরার হিড়িক দেখতে! ঘরের কোণে হাঁটুতে মাথা গুঁজে বসে থাকতিস।

আবার ‘হোক আলিঙ্গন’ বলে গলা ফাটানো হচ্ছে। মিডিয়া ডেকে ক্যামেরার সামনে জড়ামড়ি চলছে। হুঁ হুঁ বাবা, আমাদের ছোটবেলা যদি দেখতিস! মা চোখের জল ফেলত আর রান্না করত। বাপ-কাকাদের তো মাঝেমধ্যেই মা-কাকিমাদের পেটাতে দেখেছি। মেয়েছেলের আবার গলা চড়িয়ে কথা কী! বাপের বাড়ির খোঁজ নেওয়া কী? ভোরবেলা উঠেই রান্নাঘর... পুরুষমানুষগুলো বেলা করে উঠেই চা চাইবে, জলখাবার... উনুনের কয়লা বাছতে হবে... ব্যাটাছেলেরা বেরোবে, পঞ্চব্যঞ্জন ধরে দিতে হবে মুখের সামনে... রান্না সেরে, ছেলেমেয়েদের স্নান করিয়ে খাইয়ে স্কুলের ব্যাগ গুছিয়ে পাঠাতে হবে... সংসারের নানা ঝক্কি সামলে অনেক বেলায় কড়ায় যা পড়ে থাকবে তা-ই খেতে হবে... বেশির ভাগ দিন ভাতে টান... তাতে কী? মেয়েছেলে মেয়েছেলের মতো থাকত তখন, ঠিক থাকত।

আর এখন? মেয়েছেলেগুলোর বড্ড বাড় বেড়েছে! দু’পাতা ইংরেজি পড়েই ধরাকে সরা। ছোট জামাকাপড় পরছে, কলেজ ফেস্টে নাচছে-গাইছে, রাত করে বাড়ি ফিরছে, ব্যাটাছেলে-মেয়েছেলে কোনও ভেদাভেদ রাখছে না, সিগারেট-মদ খাচ্ছে, গুরুজন দেখলেও ফুরফুর করে ধোঁয়া ছাড়ে!

তবে, আড়ালে একটা কথা বলি, পাঁচ কান করবেন না যেন। বেশ লাগে দেখতে, জানেন? ছোট ছোট হাতকাটা জামা, জিনস, পারফিউম— বেশ লাগে। শুধু মেট্রোর কামরা কেন? রাস্তাঘাটে-বাসে-লোকাল ট্রেনে, পাশ দিয়ে যখন যায়... ওহ্হ্! আমাদের সময়ে এ সব ছিল না। মেয়ে দেখাটাও বড় হ্যাপার ছিল। মেয়েদের স্কুলকলেজের উল্টো দিকে দাঁড়ানো, পাড়া দিয়ে সাইকেলে আনাগোনা, লুকোচুরি, দু’পাতার চিঠি কী ভাবে হাতে দেওয়া যায় তার জন্য গোলটেবিল বৈঠক বসিয়ে দেওয়া— কী না করেছি?

আরও পড়ুন: ইতিহাস নিয়ে আজও আড়ালেই ওল্ড দমদম রোড

তবে সে কিন্তু বাইরে। ঘরে এ সব চলবে না। ঘরের মেয়ে-বৌ ও সব পরুক বা করুক দেখি, মজা টের পাইয়ে দেব! ঘরে আমি খাপ পঞ্চায়েতের মোড়ল, ঘরে আমি তালিবান!

শুধু একটা কথা বুঝতে পারি না, আমার ছেলেমেয়ে বাইরে কী করে? বাড়িতে এত শাসন আর লাল চোখ দেখে বাইরে কি ও রকমই জুজুবেড়াল হয়ে থাকে? না কি মেট্রোর কামরার ছেলেটা আর মেয়েটার মতোই অসভ্যতা করে?

আমার মেট্রো রেল আর ট্রেনের ডেলি প্যাসেঞ্জার ভগিনী ও ভ্রাতাগণ, শুধু দেখবেন, দলে পড়ে আমি ওই ছেলেটা আর মেয়েটার সঙ্গে যা করেছি, আমার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ও রকম করবেন না প্লিজ! দোহাই আপনাদের!

Moral Policing Hugging Metro Couple Assault Intimacy
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy