Advertisement
E-Paper

দেশপ্রেম? এ হল স্বার্থপরতা

প্রেসিডেন্ট মাকরঁর কথাগুলো শুনে অন্য একটা কারণেও রবীন্দ্রনাথকে মনে পড়তে পারে

সেমন্তী ঘোষ

শেষ আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০১৮ ০০:০০
ভিন্নমত: ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাকরঁ ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্যারিস, ১০ নভেম্বর। এএফপি

ভিন্নমত: ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাকরঁ ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্যারিস, ১০ নভেম্বর। এএফপি

ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাকরঁ কি রবীন্দ্রনাথের নাম শুনেছেন? কে জানে! শুনে থাকলেও হয়তো এটা তাঁর অজানা যে, আন্তর্জাতিক সমাবেশের মঞ্চে তিনি সে দিন যা বললেন, রবীন্দ্রনাথের কথার সঙ্গে তার ছত্রে ছত্রে মিল! প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির শতবর্ষ উদ্‌যাপন হচ্ছিল প্যারিসে। বিরাট বিশ্বের সেই কোলাহলের মধ্যে মাকরঁ বললেন, ন্যাশনালিজ়ম হল ‘সেলফিশ’ বা স্বার্থপরতাময় আদর্শ, ‘অন্যের যা হয় হোক, আমাদেরটাই আগে’, এই জাতীয় অর্বাচীন আত্মকেন্দ্রিকতাই তার সত্যিকারের পরিচয়। অবাক কাণ্ড। আজ থেকে ১০১-২ বছর আগে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের এক দূর ভূখণ্ডের কবি প্রায় এই ভাষাতেই ন্যাশনালিজ়মকে সভ্যতার সর্বনাশ বলে বর্ণনা করেছিলেন।

প্রেসিডেন্ট মাকরঁর কথাগুলো শুনে অন্য একটা কারণেও রবীন্দ্রনাথকে মনে পড়তে পারে। জনা ষাটেক রাষ্ট্রনায়কের সম্মিলিত উপস্থিতিতে, ‘আমেরিকা ফার্স্ট’-এর প্রবল প্রবক্তা প্রেসিডেন্টের সোনালি-কেশশোভিত আক্রমণপ্রবণ মুখমণ্ডলকে উপেক্ষা করে তরুণ ফরাসি প্রেসিডেন্টকে অমন জোরালো ভাষায় হারিয়ে-যেতে-বসা বিশ্বকল্যাণ-নীতিটিকে ফিরিয়ে আনার কথা বলতে শুনে (‘বাই পুটিং আওয়ার ওন ইন্টারেস্টস ফার্স্ট, উইথ নো রিগার্ডস ফর আদার্স, উই ইরেজ় দ্য ভেরি থিং দ্যাট আ নেশন হোল্ডস ডিয়ারেস্ট, অ্যান্ড দ্য থিং দ্যাট কিপস ইট অ্যালাইভ: ইটস মরাল ভ্যালুজ়’) রবীন্দ্রনাথের জাপান সফরের সহানুভূতিহীন পরিবেশের কথা মনে পড়তেই পারে। রবীন্দ্রনাথের পক্ষেও সে দিন এতটাই দুঃসাহসিক ছিল জাপানের নবলব্ধ জাতীয় আবেগ-উত্তেজনার মধ্যে দাঁড়িয়ে জাতীয়তাবাদের সমালোচনা করা। জাপানিদের মনোমতো কথা মোটেই বলেননি তিনি। ও দেশে পৌঁছনোর সময় উৎসাহমুখর সংবর্ধনার পর তাঁর বক্তৃতা শুনে তাঁর সম্পর্কে সে দেশের মানুষের উৎসাহ দ্রুত কমে গিয়েছিল।

নিজের দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিতে গিয়ে মাকরঁও প্রায় একই রকম আক্রান্ত হলেন। ফ্রান্স ও আশপাশের দেশে বয়ে গেল সমালোচনার ঝড়। পাশাপাশি, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প টুইট করে দু’কথা শুনিয়ে দিলেন। অভিযোগ করলেন যে মাকরঁ নাকি আমেরিকা, কানাডা ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউরোপকে ঐক্যবদ্ধ করার শপথ নিচ্ছেন। মাকরঁর হয়ে ফরাসি রাষ্ট্রদূতকে দ্রুত সাফাই দিতে হল যে, না না, কোনও আমেরিকাবিরোধী কার্যক্রমের কথা বলতে চাননি প্রেসিডেন্ট, শুধু ন্যাশনালিজ়ম-এর বিপদ বিষয়ে সাবধান করে দিতে চেয়েছেন! কে শোনে কার কথা। বিশ্বজোড়া জাতীয়তাবাদীরা ঝাঁপিয়ে পড়লেন: মাকরঁ অন্যায় করলেন, দেশকে ভালবাসা ন্যাশনালিস্ট মানুষদের ছোট করলেন! বড় বড় সংবাদপত্র থেকে ছোট ছোট ট্যাবলয়েড পর দিনই জানাল: ‘মাকরঁ টোট্যালি মিসড দ্য পয়েন্ট হোয়েন কনডেমিং ন্যাশনালিজ়ম।’

মাকরঁ বিষয়ে মার্কিন দেশের সমালোচনার সুর যে তারে উঠল, তাতে বোঝা সম্ভব সে দেশের কত মানুষ এখন ট্রাম্প-যুগের টগবগে জাতীয়তাবাদী ভাবাবেগের শিকার। তাই, ভোটের যুদ্ধে ট্রাম্প কতটা এগিয়ে রইলেন কতটা পিছিয়ে, সে সব নেহাত উপরের কথা। ভিতরের কথা হল, অন্য এক জায়গায় ট্রাম্প অত্যন্ত সফল— মানুষকে খেপিয়ে টগবগে জাতীয়তাবাদী করে তোলার কাজটাতে।

একা ট্রাম্প নন। ন্যাশনালিজ়মের নামে এই টগবগে আদর্শ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে রাজনীতির ময়দানে নেমে পড়েছেন অনেক দেশের নেতারাই। কোথাও তাই মহাদেশীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসার জন্য পার্লামেন্ট জয়ের প্রয়াস হচ্ছে। কোথাও গরিব দুঃখী অভিবাসী আগন্তুকদের তাড়িয়ে জাতিশুদ্ধির চেষ্টা হচ্ছে। কোথাও আবার ন্যাশনালিজ়ম-এর নামে চলছে দেশের বহু মানুষকে দ্বিতীয় শ্রেণির সন্ত্রস্ত নাগরিক বানানোর অভিযান, সেই অভিযান-পথে কখনও লাঠ্যৌষধে নিধন, কখনও মন্দির-মন্দির হুমকি, কখনও নামধাম-পরিচিতির হেঁচকা পরিবর্তন।

আসল চিন্তা এখানেই। কিছু দিন আগেও রবীন্দ্রনাথের ন্যাশনালিজ়ম-এর উপর বক্তৃতাগুলো পড়তে গিয়ে মনে হত, যদিও এ সব কথা আজকাল আর নতুন বা বৈপ্লবিক কিছু নয়, বিস্মিত হতে হয় ভেবে যে অত দিন আগে মানুষটি কী করে দেখতে পেয়েছিলেন এত সব বিপদ! অথচ, কয়েক বছরের মধ্যে চার পাশটা কেমন পাল্টে গেল। যেন ঝড় বয়ে গেল দশদিগন্ত জুড়ে। আমরা বুঝে গেলাম— না, রবীন্দ্রনাথের পুরনো কথাগুলো আজও একই রকম নতুন থেকে গিয়েছে, একই রকম বৈপ্লবিক। যে ভয়ঙ্কর প্রবণতার কথা বলেছিলেন তিনি, এক শতাব্দীর এ ফোঁড় ও ফোঁড় করে দেওয়া ঘটনাবলির পরও চক্রাকারে তাতে আমরা ফিরে এসেছি। ফরাসি ভাষায় একটা কথা আছে: ‘দেজা ভু’, যার অর্থ, যা আগেই দেখা হয়ে গিয়েছে। ফরাসি প্রেসিডেন্ট মাকরঁর কথা শুনে আমাদের এখন একটা ‘দেজা ভু’ অনুভূতি হচ্ছে। এবং যে হেতু বিপদটাও ‘দেখে ফেলেছি’, তাই ভয়ানক দুশ্চিন্তাও হচ্ছে।

দুশ্চিন্তা হচ্ছে মাকরঁর জন্যও। আশা করি, এতগুলো দেশের সামনে সাহসিকতা দেখানোর ফলে তাঁকে রাজনৈতিক সঙ্কটে পড়তে হবে না। দুশ্চিন্তা কি সাধে! কথা বিকৃত করার চল আজকাল সর্বত্র। যে কথা সকলেই শুনছে, তাতে এমন একটা প্যাঁচ দিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যাতে লোকে ক্রমে ভয়ানক চটে যেতে শুরু করে। এই যেমন, মাকরঁ বললেন, ন্যাশনালিজ়ম আর পেট্রিয়টিজ়ম দুটো আলাদা আদর্শ, ন্যাশনালিজ়ম হচ্ছে পেট্রিয়টিজ়ম-এর বিকৃত রূপ: ‘বিট্রেয়াল অব পেট্রিয়টিজ়ম’। অথচ তার পরই শোনা গেল তিনি নাকি দেশকেই ‘বিট্রে’ করতে বসেছেন। মাকরঁ বললেন, নৈতিকতার বোধটাকে বাইরে রেখে যদি কেউ নিজের কথাই শুধু ভাবে, তা হলে তাকে আর মঙ্গলময় আদর্শ বলা যায় না, অথচ ন্যাশনালিজ়ম বলতে আমরা আজকাল স্বার্থপর ভাবে নিজেরটুকুই বুঝি। পেট্রিয়টিজ়ম তাঁর মতে অন্য জিনিস। নিজের দেশকে ভালবাসার সঙ্গে যেখানে বিশ্বজনীন সৌভ্রাতৃত্বের বিষয়টাও মাথায় রাখা হয়, পরস্পরের বিরুদ্ধে ভয়ের ভাষা ব্যবহার না করে পরস্পরের জন্য আশার ভাষা তৈরি করা হয়, সেটাই পেট্রিয়টিজ়ম। অথচ পর দিনই শোনা গেল যে, মাকরঁর আসল অভিসন্ধি নাকি দেশপ্রেম নামক মহান বিষয়টাকে জলাঞ্জলি দেওয়া এবং লিবারাল নীতির দাসত্বে ফিরে যাওয়া, যে নীতিতে নিজেদের ক্ষতি করে অন্যের উপকার করাই দস্তুর!

শোনা গেল, ট্রাম্প সোজা কথার মানুষ, মাকরঁর ওই বাঁকাচোরা কথায় দেশদ্রোহে ভোলার লোক নন। ট্রাম্পের সদর্প ঘোষণা: তিনি এক জন গর্বিত ন্যাশনালিস্ট, এবং তিনি এও জানেন, ফ্রান্সের দেশপ্রেমী মানুষরাও ‘ন্যাশনাল’ গৌরবে ভরপুর! মাকরঁর কথা শুনে তাঁরা যেন বিচলিত না হন। অর্থাৎ মাকরঁর কথাগুলোকে একটা ‘স্পিন’ দিয়ে ফ্রান্সের উগ্র জাতীয়তাবাদীদের তাদের প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে উস্কে তোলার চেষ্টা শুরু হল। বলা হল, যাঁরা ‘সোজা কথা সোজা ভাবে বলতে ভালবাসেন’, তাঁরা জানেন দেশপ্রেম আর জাতীয়তা একই। মাকরঁ জটিলতা তৈরি করছেন, খামকা।

সোজা কথা সোজা ভাবে বলার গর্ব করেন যাঁরা, তাঁরা অনেক সমস্যাই এড়িয়ে যাওয়ার রাস্তা ধরেন। পপুলিস্ট বা জনপ্রিয়তাবাদী রাজনীতির সঙ্গে বুদ্ধির রাজনীতির একটা গভীর বিরোধ— তাই বোধ হয় দেখছি ট্রাম্প ও বিশ্বের অন্য সফল জনপ্রিয়তাবাদী জাতীয়তাবাদী নেতাদের ‘সোজা কথা’র মধ্যে বুদ্ধি, বিবেচনা, চিন্তা, সত্যতা ইত্যাদির নিতান্ত অভাব। তাঁরা বোঝেন না, সোজা সোজা বাক্য জোর দিয়ে বললেই সেগুলো জাদুবলে সত্যি হয়ে যায় না। ট্রাম্পরা যা-ই বলুন না কেন, দেশপ্রেম আর জাতীয়তাবাদ যে এক নয়, তা আমরা বুদ্ধিবিবেচনার মানুষদের কাছে অনেক বার শুনেছি। মনস্তত্ত্ববিদ তথা ইতিহাসবিদ আশিস নন্দীর দু’একটা কথা এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করতেই হয়। ‘ন্যাশনালিজ়ম ইজ় নট পেট্রিয়টিজ়ম’ দিয়ে তাঁর একটি বিখ্যাত প্রবন্ধ শুরু হয়েছিল, যেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘নেশন’-এর ‘রাষ্ট্রিক’ আবেগের মধ্যে অবধারিত ভাবে নিজেদের পরিচিতিটার উপর অত্যধিক জোর দেওয়া হয়, আর সেই কারণে ওই পরিচিতির বাইরে যে ‘অন্য’রা, তাদেরও ‘আলাদা’ করে দেওয়া হয়। অর্থাৎ জাতীয়তাবাদের মধ্যে থাকে একটা বিরাট ‘ইগো’, যার বিপরীতে বাকিরা নির্দেশিত হয় ‘আউটসাইডার’ হিসেবে। উল্টো দিকে, পেট্রিয়টিজ়ম-এর মধ্যে ওরা-আমরা তৈরির দায়টা সাধারণত থাকে না, কেননা পেট্রিয়টের দেশপ্রেম এমন একটা ‘স্থানিক’ আবেগ, যার মধ্যে আগে থেকেই নানা রকম ভাগাভাগি বা খণ্ডপরিচিতি স্বীকৃত থাকে। সোজা কথায়, নেশন হল একমাত্রিক, আর দেশ বহুমাত্রিক। ন্যাশনালিস্ট-এর নেশন-কে হানা আরেন্ডট-এর মতো সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন ‘সিউডো-কমিউনিটি’, বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসনরা বলেন ‘ইমাজিনড কমিউনিটি’। কিন্তু পেট্রিয়ট-এর দেশ নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধানে মণ্ডিত বলে তাকে কমিউনিটি পরিচয়ে বাঁধা মুশকিল।

আশ্চর্য এই যে, নেশন-এর আবেগ দিয়ে ‘আউটসাইডার’ বানানোর ফল যে কী ভয়ানক হতে পারে, তা আমাদের বিলক্ষণ জানা। মাকরঁ সেটাও মনে করিয়েছেন। যে ইউরোপ কেবল ন্যাশনালিজ়ম-এর নামে একশো বছরে দু’দুটো কালান্তক বিশ্বযুদ্ধ আর একটা করালতম জেনোসাইড দেখেছে, তার কথাটা মন দিয়ে শুনতে বলেছেন।

কিন্তু শুনছেটা কে? ‘ইগো’ আর ‘আউটসাইডার’-এর লড়াইয়ে যখন বিদেশি মানেই শত্রু, আর ভিন্ন মানেই ব্রাত্য, মুঘলসরাইদের হটিয়ে যেখানে দ্রুত জায়গা করে নিতে ব্যস্ত দীনদয়ালরা— দেশ তো সেখানে ভেসে যাবেই নেশন-এর বাঁধভাঙা আবেগে। —সরি। ভাবাবেগে।

France USA Emmanuel Macron Donald Trump Nationalism Selfishness
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy