Advertisement
E-Paper

নতুন আন্দোলন, নতুন অর্জন

জীবনানন্দ তখনকার প্রেক্ষপটে যেমনটি বলেছিলেন, তা আজও সমান সত্যি। বাংলাদেশে রাষ্ট্রভাষা বাংলা, তবু বাংলার জন্য সংগ্রাম এখনও চালিয়ে যেতে হচ্ছে।

পিয়াস মজিদ

শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০০:৩০

জীবনানন্দ দাশ এবং ১৯৫২-র বাংলা ভাষা আন্দোলন একই মাসের জাতক। আগের শতাব্দীর ১৭ ফেব্রুয়ারি বরিশালে জীবনানন্দের জন্ম আর পরের শতাব্দীর ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলার স্বীকৃতির দাবিতে নতুন ইতিহাসের জন্ম। তৎকালীন পূর্ববঙ্গে সংঘটিত ভাষা আন্দোলনের তরঙ্গ কলকাতায় বসবাসরত জীবনানন্দের হৃদয়েও আলোড়ন তুলে গিয়েছে। তাই দেখি ভাষা আন্দোলনের প্রতিক্রিয়ায় তিনি লিখেছেন ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ভবিষ্যৎ’ নামে ভাবনানিবিড় প্রবন্ধ। লিখেছেন— ‘পূর্ব পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা নিয়ে কিছুকাল থেকে আলোড়ন চলছে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সমস্ত লোকই বরাবর বাংলা ব্যবহার করে আসছে। শিক্ষিতেরা ইংরেজি জানেন। কিন্তু ইংরেজি যত মহৎই হোক; বিদেশী ভাষা। রাষ্ট্রের ভাষা দেশী হওয়া দরকার।’

জীবনানন্দ তখনকার প্রেক্ষাপটে যেমনটি বলেছিলেন, তা আজও সমান সত্যি। বাংলাদেশে রাষ্ট্রভাষা বাংলা, তবু বাংলার জন্য সংগ্রাম এখনও চালিয়ে যেতে হচ্ছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পরই বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে যে সব তর্ক-বিতর্ক হয়েছে, তাতে বাংলা-বিরোধী পক্ষের মূল কথাটি ছিল, ‘বাংলা ভাষায় বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা সম্ভব নয় এবং উচ্চতর জ্ঞান-পরিভাষার সম্ভাবনা বাংলায় অপ্রতুলপ্রায়।’ কিন্তু এখন তাঁদের মত পালটানো উচিত, ‘তাল মিলিয়ে চলার’ জন্য বাংলার অসীম সম্ভাবনা আজ মোটামুটি প্রমাণিত।

মানতেই হবে, বাংলাদেশের বাংলাভাষী জনগোষ্ঠী একটা বিশিষ্ট অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়েছে। অতীতের প্রেক্ষাপটে বর্তমানে দাঁড়িয়ে আগামীর আকাশে সে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে তার ভাষাকে অবলম্বন করে। এক সময় ভাষা উপনিবেশ প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে বাংলাকে উর্দুর গন্ধমাখা করার চেষ্টা চলেছে এমন ভাবে যে, বিবিসি বাংলা বিভাগে ১৯৫২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ সম্রাট ষষ্ঠ জর্জ প্রয়াত হলে পাকিস্তানি বাংলায় সেই সংবাদ প্রচারিত হয় এই ভাবে: ‘বাদশা ষষ্ঠ জর্জ-এর ইন্তেকালে সারা বরতনিয়া গমগিন হয়ে আছে।’

আরও পড়ুন: ভাষা আন্দোলনের আখ্যান বর্ধমানের ভূমিপুত্রের হাতে

পাকিস্তানিরা রোমান হরফে বাংলা চালুর চেষ্টা করেছেন। তবে, এই সব কোনও প্রয়াসই সফল হয়নি। কিন্তু বর্তমানে মোবাইল ফোনে বার্তা আদানপ্রদানের মাধ্যম যখন হয়ে ওঠে রোমান হরফ, কিছুটা হতাশা জাগে। যদিও এখন অনেকেই ফোনে বার্তা আদানপ্রদানে বাংলা ব্যবহার শিখে নিয়েছেন। আর বিজ্ঞান-প্রযুক্তির জটিল বাক্যবন্ধ বাংলায় সম্ভব নয় বলে যাঁরা মনে করতেন, তাঁদের সেই ধারণা ভ্রান্ত বলে প্রমাণ করেছেন বাংলাদেশের অনেক কবি-লেখক। কবি নির্মলেন্দু গুণ মোবাইল ফোনের বাংলা করেছেন ‘মুঠোফোন’। এই নিয়ে তিনি কবিতার বইও লিখেছেন, ‘মুঠোফোনের কাব্য’। ইন্টারনেটের চলনসই বাংলা হয়েছে ‘অন্তর্জাল’। এই ভাবেই বাংলা তার বহতা প্রকৃতি ও নিত্য আবিষ্কারের প্রবণতা প্রমাণ করতে পেরেছে।

এখন বাংলাদেশের বাঙালি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে বাংলা ভাষার ভূগোল বিস্তৃত করে চলেছে। বাংলাদেশের শান্তিসেনা আফ্রিকার সিয়েরা লিয়োনে তাদের মানবিক তৎপরতা চালিয়েছে, তাদের মুখের বাংলা ভাষা সে দেশের মানুষকে এতটাই আপন করে নিয়েছে যে সিয়েরা লিয়োন বাংলাকে তাদের অন্যতম ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার ফেডারেল সংসদ বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি দিয়ে জাতীয় স্তরে ২১ ফেব্রুয়ারি পালনের প্রস্তাব অনুমোদন করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে খোলা হচ্ছে বাংলা বিভাগ। বাংলাদেশের মানুষ কর্মসূত্রে আরব থেকে মার্কিন মুলুক পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিকায়নের পথ প্রশস্ত করছে। বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশিত হচ্ছে। প্রবাসে বসবাসরত বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি পত্রিকা তাদের উত্তর আমেরিকা ও উপসাগরীয় সংস্করণ প্রকাশ শুরু করেছে। কিল্টন বুথ সিলি, কাজুও আজুমা, উইলিয়ম রাদিচে, ফ্রাঁস ভট্টাচার্য, ফাদার দ্যতিয়েন, হান্স হার্ডারের মতো ভিনদেশি বাংলাপ্রেমীদের কথা তো আমরা জানি। সেই সঙ্গে বলা দরকার, সদ্যপ্রয়াত ফাদার মারিনো রিগানোর কথা, যিনি খুলনার প্রত্যন্ত শেলবুনিয়াতে বসে লালন, রবীন্দ্রনাথ, জসীমউদ‌্দীনসহ তাঁর প্রিয় সুনির্বাচিত বাংলা সাহিত্যের অনুবাদ করেছেন। এই ভাবে বিদেশিদের মাঝে ক্রমশই বাংলা ভাষা-সাহিত্য ও বঙ্গবিদ্যাচর্চা বাড়ছে। বাংলা ভাষার সংগ্রামে এ এক অর্জন বটে!

বাংলাদেশের তরুণরা ‘ভাষা হোক উন্মুক্ত’ স্লোগান তুলে ‘অভ্র’ নামে সহজ বাংলা ফন্ট আবিষ্কার করেছে। ফলে বাংলাভাষা চর্চায় স্থানিক দূরত্ব এখন আর কোনও প্রতিবন্ধকই নয়। কানাডা থেকে রাশিয়া, ইরান থেকে জাপান— যে কোনও জায়গায় বসে সহজ বাংলা ফন্টের ব্যবহারে বাঙালি ব্যক্ত করছে তার একান্ত অনুভব কিংবা গূঢ় ভাবনা। ফেসবুক-ব্লগ গুঁড়িয়ে দিচ্ছে ভৌগোলিক সীমারেখা। এখনও অনেক ইংরেজি মাধ্যম স্কুল ও ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বাংলা প্রচলনের ক্ষেত্রে বহু দূর যেতে হবে ঠিকই, তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলা ভাষা-সাহিত্যের কোর্স চালু হওয়া একটা অগ্রগতি।

অনুবাদের মাধ্যমে বাংলা ভাষার বিস্তার দিন দিন বাড়ছে। মহাফেজখানায় স্থান পাওয়া ঐতিহাসিক দলিল-দস্তাবেজও (যাদের অধিকাংশই ইংরেজিসহ অন্যান্য বিদেশি ভাষার) যখন এ-কালের অনুবাদক বাংলায় রূপান্তর করেন, তখন সে-সব সাধারণ মানুষের পাঠ্য হয়ে ওঠে। পাশাপাশি, বাংলাদেশের প্রয়াত বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান যখন ‘কোরানসূত্র’, ‘কোরান শরিফ: সরল বঙ্গানুবাদ’ কিংবা ‘যার যার ধর্ম’ নামে বাংলা ভাষায় ধর্ম-অভিধান প্রণয়ন করেন এবং বইগুলো বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে।

১৯৫২ সালে বাংলাভাষার জন্য যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, আজও তা চলছে। প্রসঙ্গ বা প্রেক্ষিত পালটেছে। কিন্তু আন্দোলনের প্রয়োজন পালটায়নি।

Bengali Language Movement Bangladesh
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy