রাজনীতি মানেই আদিঅন্তহীন কথার বেসাতি। ভোটের রাজনীতিতে কথার মাহাত্ম্য অস্বীকার করিবে কে? কিন্তু, ভোটে জিতিবার পর, কেন্দ্রে অথবা রাজ্যে মন্ত্রিসভা আলো করিয়া বসিবার পরও কথা বলিবার অভ্যাসটি যায় না। অবশ্য, অভ্যাস মাত্রেই দুর্মর। ফলে, যেখানে যাহা বলিবার নহে, মন্ত্রীরা বলিয়াই চলেন। ‘পদ্মাবতী’ নামক চলচ্চিত্রটিকে কেন্দ্র করিয়াও তাহাই ঘটিয়াছে। ছবিটি এখনও সেন্ট্রাল বোর্ড অব ফিল্ম সার্টিফিকেশনের বিচারাধীন। বোর্ড কী বলে, তাহা জানিবার পূর্বে ছবিটির প্রদর্শন সংক্রান্ত বিষয়ে কোনও কথা বলিবার এক্তিয়ার কাহারও নাই। এমনকী, সুপ্রিম কোর্ট স্মরণ করাইয়া দিয়াছে, দেশের সর্বোচ্চ আদালতেরও নাই। সেই ঔচিত্যের ধার ধারিতে রাজনীতিকদের অবশ্য বহিয়া গিয়াছে। ফলে, খুচরা সংগঠনগুলির সহিত মন্ত্রীরাও গলা মিলাইয়াছেন। মধ্যপ্রদেশে শিবরাজ সিংহ চৌহান, রাজস্থানে বসুন্ধরা রাজে, গুজরাতে বিজয় রূপাণী, বিহারে নীতীশ কুমার— মুখ্যমন্ত্রীরাই ছবিটির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান লইয়াছেন। সুপ্রিম কোর্ট কাহারও নাম উল্লেখ করে নাই, কিন্তু যে ভঙ্গিতে সরকারি কুর্সিতে বসিয়া থাকা রাজনীতিকদের স্মরণ করাইয়া দিয়াছে যে বিচারাধীন বিষয়ে কথা বলিতে নাই, তাহাতে অনুমান করা সম্ভব যে বক্তব্যটির অভিমুখ এই নেতাদের দিকেও ছিল। গুজরাতে নির্বাচনের আর মাত্র কয় দিন বাকি। ফলে, রাজনৈতিক লাভ ঘরে তুলিতে নেতারা আত্মহারা হইতেছেন। কিন্তু, এতখানি বেলাগামও যে হইতে নাই, শীর্ষ আদালতকে সেই কথাটি স্মরণ করাইয়া দিতে হইল। গণতন্ত্রের দুর্ভাগ্য, সর্বোচ্চ স্তরের নেতাদেরও এই প্রাথমিক কথাটি বলিয়া দিতে হয়।
আত্মসমীক্ষার কু-অভ্যাসটি রাজনীতিকদের আছে, এমন অভিযোগ কেহ করিবেন না। ফলে, রবিশংকর প্রসাদরা নির্দ্বিধায় আদালতের দিকে অতিসক্রিয়তার অভিযোগ তুলিতে পারেন। সেই অভিযোগের মূল কথা হইল অনধিকারচর্চা। সেই আঙুল তুলিবার পূর্বে তাঁহারা ভাবিয়া দেখিতে পারিতেন, তাঁহারা ঠিক কী করেন। শিবরাজ সিংহ চৌহান আদি মুখ্যমন্ত্রীদের বক্তব্য, ‘পদ্মাবতী’ প্রদর্শিত হইলে রাজ্যে আইনশৃঙ্খলার সমস্যা হইতে পারে। শীর্ষ প্রশাসক হিসাবে এই উদ্বেগ থাকা অস্বাভাবিক নহে। কিন্তু, ছবির প্রদর্শনী বন্ধ করিবার পক্ষে সওয়াল না করিয়া, মুখ বুজিয়া, শৃঙ্খলারক্ষার ব্যবস্থা করাই কি বিধেয় ছিল না? অবশ্য, তাঁহারা যদি দেশের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক কুর্সিতে বসিয়া থাকা কর্তাকে দেখিয়া অনুপ্রাণিত হন, এবং স্থির করেন যে মুখে জগৎ মাত করাই একমাত্র কর্তব্য, তবে তাহা ভিন্ন কথা।
আদালতের ধমকটিকে আরও এক ধাপ আগাইয়া লওয়া যাইতে পারে। শুধু বিচারাধীন বিষয়ে নহে, কোনও ক্ষেত্রেই এত কথা বলিবার কী আছে? ‘মন কি বাত’ খোলসা করিবার এত তাগিদ কিসের? তাঁহারা কাজ করিবার জন্য আইনসভায় নির্বাচিত হন, কথার পাহাড় গড়িবার জন্য নহে। এবং, স্মরণে রাখা প্রয়োজন, এহেন বাগ্বাহুল্যও কিন্তু জরুরি বিষয়গুলিতে কর্তাদের নীরবতা ভাঙিতে পারে না। দাদরির হত্যাকাণ্ড হউক বা এম এম কালবুর্গি অথবা গৌরী লঙ্কেশের হত্যা, হাসপাতালে শিশুমৃত্যু হউক বা আধার-এর অভাবে রেশন না পাইয়া অনাহারে মৃত্যুর অভিযোগ, গোরক্ষকদের তাণ্ডব হউক বা দিল্লির তীব্র দূষণ, কর্তাদের মনের কথা শোনা যায় নাই। এই সমস্যাগুলি লইয়া রাষ্ট্র কী ভাবিতেছে, তাহার সম্পূর্ণ ছবিটি এখনও অজ্ঞাত। অনুমান করা চলে, যে কথা বলিলে ভোটব্যাংকে আঁচ পড়িতে পারে, কর্তারা সেই কথা উচ্চারণ করিবেন না। তাহাতে গণতন্ত্রের অপূরণীয় ক্ষতিও যদি হয়, তবুও নেতাদের মুখ হইতে কথা সরিবে না। ভারতবাসী মানিয়া লইবে। বলিবে, নীবরতাই সই। কিন্তু, তাহা সর্বক্ষেত্রেই সমান হওয়া প্রয়োজন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy