ভোটে জিততে হলে মহিলাদের জন্য প্রত্যক্ষ নগদ হস্তান্তরের ব্যবস্থা করতেই হবে, এ কথাটি এখন ভারতীয় রাজনীতির স্বতঃসিদ্ধ হয়ে উঠেছে। এমনকি যে প্রধানমন্ত্রী বিরোধী-শাসিত রাজ্যের এমন হস্তান্তর নীতিকে ‘রেউড়ি’ বলে ব্যঙ্গ করতে অভ্যস্ত, তাঁর দলও রাজ্যে রাজ্যে ভোটের আগে নগদ হস্তান্তর প্রকল্পেরই শরণ নেয়। কাজেই, পশ্চিমবঙ্গের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনেও লক্ষ্মীর ভান্ডার নিঃসন্দেহে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে উঠবে— হাজার হোক, এ-হেন হস্তান্তর প্রকল্পের দেশব্যাপী গ্রহণযোগ্যতার সূচনা হয়েছিল লক্ষ্মীর ভান্ডারের হাত ধরেই। মেয়েদের জন্য নগদ হস্তান্তরের প্রকল্প ভারতের রাজনৈতিক ভাষ্যে এখন এমনই অপরিহার্য হয়ে উঠেছে যে, কেবল সেই ভরসাতেই নির্বাচনী বৈতরণি পার করা যাবে কি না, তেমন একটি প্রশ্নও হাওয়ায় ভাসছে। সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা বলছে, ‘অ্যান্টি-ইনকাম্বেন্সি’ বা শাসকবিরোধী ভোটের প্রবণতা কম থাকছে সরকারপক্ষের তরফে এই গোত্রের প্রকল্পগুলির ‘ডেলিভারি’-র নিশ্চয়তার কারণেই। যে পক্ষ এত দিন এই টাকা দিয়ে এসেছে, তাদের দেওয়ার ক্ষমতা এবং ইচ্ছার উপরে সাধারণ মানুষ, বিশেষত মহিলারা, বিশ্বাস রেখেছেন। অতএব, পশ্চিমবঙ্গের আসন্ন নির্বাচনেও লক্ষ্মীর ভান্ডার একেবারে প্রথম সারির প্রশ্ন হিসাবেই বিবেচিত হবে বলে অনুমান করা চলে।
তবে, রাজনৈতিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ হলেই কি প্রকল্পটি অর্থশাস্ত্রের কষ্টিপাথরেও উতরোয়? এই প্রশ্নের দু’টি দিক রয়েছে— এক, প্রকল্পের জন্য যত টাকা খরচ করা হচ্ছে, সে টাকার শ্রেষ্ঠ ব্যবহার কি এটাই; এবং দুই, এই প্রকল্প কি তার উন্নয়ন-উদ্দেশ্য পূরণ করতে সক্ষম? পশ্চিমবঙ্গের মতো আর্থিক ভাবে ক্রমে পিছিয়ে পড়া রাজ্যের ক্ষেত্রে দু’টি প্রশ্নই সমান গুরুত্বপূর্ণ। এ রাজ্যে লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ ২৬,০০০ কোটি টাকা— রাজ্যের মোট রাজস্ব আদায়ের প্রায় ১০%। ২০২১ সালে প্রকল্পের সূচনালগ্নে এই অনুপাত ছিল ৩%, ফলে রাজ্যের বাজেটে প্রকল্পের গুরুত্ব তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বেড়েছে। তুলনায় রাজ্যে পরিকাঠামো খাতে বরাদ্দের পরিমাণ কম; স্বাস্থ্য খাতে মোট বরাদ্দের পরিমাণও লক্ষ্মীর ভান্ডারের বাজেটের চেয়ে কম। মহিলাদের হাতে ১০০০-১২০০ টাকা তুলে না দিয়ে এই খাতগুলিতে বাড়তি টাকা খরচ করলে সার্বিক ভাবে রাজ্যের উপকার হত কি না, সে প্রশ্নের উত্তর জটিল বিশ্লেষণসাপেক্ষ। কিন্তু, প্রশ্নটি আদৌ ‘বনাম’-এর কেন হবে, ‘এবং’-এর কেন নয়? মূল প্রশ্ন হওয়া উচিত ছিল, রাজ্য এখনও আর্থিক ভাবে যথেষ্ট সচ্ছল নয় কেন, যাতে মেয়েদের হাতে নগদ তুলে দিতে গেলে অন্য খাতে টাকা কমানোর অভিযোগ না ওঠে? দেড় দশক রাজ্য পরিচালনা করার পরেও এই প্রশ্নের সদুত্তর দিতে না পারার দায় মুখ্যমন্ত্রীকে স্বীকার করতেই হবে।
দ্বিতীয় প্রশ্নটির উত্তরে কোনও জটিলতা নেই। মেয়েদের হাতে নগদ টাকা তুলে দিলে এক দিকে তাঁদের ক্ষমতায়ন, আর অন্য দিকে পরিবারের উন্নতি দুই-ই যে হয়, বিশ্বের বহু দেশে বহু গবেষণায় সে কথা স্পষ্ট ভাবে প্রমাণিত হয়েছে। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ এস্থার ডুফলো আনন্দবাজার পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে (‘বিনা শর্তে নগদই ভাল’, ২৩ জুন ২০২৪) বলেছিলেন, “নিজেদের উন্নয়নে কী ভাবে টাকা খরচ করতে হয়, গরিব মানুষ জানেন।” পশ্চিমবঙ্গেও মেয়েদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা একই কথা বলছে। কঠোর ভাবে পুরুষতান্ত্রিক একটি সমাজে মেয়েদের হাতে টাকা খরচের স্বাধীনতা তুলে দিতে পারে যে প্রকল্প, তার সামাজিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। এবং ঘটনা হল, আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত এই রাজ্যেও লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্প থেকে কাউকে অন্যায় ভাবে বাদ দেওয়ার অভিযোগ তেমন নেই। কাজেই, প্রকল্পটির অর্থনৈতিক যাথার্থ্য বিচার করতে বসলে এই কথাগুলিকে বিশেষ ভাবে গুরুত্ব দেওয়া বিধেয়।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)