Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

হারিয়ে যাওয়া মোষবাথান মইষাল, ভাওয়াইয়ার স্মৃতি

রকমারি রঙের ছোট মাছ, খয়ের আর চন্দনের ঘন বন। কালাপানি নদী আর বালুতট। দোতারা। আধুনিকতার ছোঁয়ায় দ্রুত মুছে যাচ্ছে উত্তরের এই চিরচেনা ছবি। লিখছেন অমিতকুমার দেকালাপানির জঙ্গলে নিয়ে গিয়েছিল আমার নেপালি ছাত্রী।

শেষ আপডেট: ১৫ মার্চ ২০১৯ ০৫:১২
Share: Save:

কালাপানির জঙ্গলে নিয়ে গিয়েছিল আমার নেপালি ছাত্রী। সেই কিশোরী আমায় দেখিয়েছিল মোষের বাথান। দূরে গরুমারার জঙ্গল। কালাপানি নদীর ওপারেই কালাপানি বন। নদীর এপারে-ওপারে ধু-ধু প্রান্তর। বালি আর বালি। দুপুর জুড়ে নদীর তিরতিরে জলে কত মাছ দেখলাম। নদীয়ালি রকমারি ছোট ছোট মাছ। খয়ের গাছের বন দেখলাম। দুপুর গড়িয়ে গেল বিকেলের দিকে। দাঁড়িয়ে রইলাম সম্মোহিতের মতো। বিকেল গড়াল ঢলেপড়া দিনের দিকে। দিগন্তের পাল্টে যাওয়া চিত্রপট এত কাছ থেকে না দেখলে অনুভব করা কঠিন।

ছাত্রীটি বলল, ‘‘ওই দেখুন! আমাদের বাথানের মোষগুলো জঙ্গল থেকে ফিরছে।’’ আমি দেখতে পাচ্ছি, জঙ্গলের সীমানায় নদীর ওপারে ধুলো উড়ছে আর নানান স্কেলে ঘণ্টা বাজছে। কোনওটা গভীর ঢং-ঢং, কোনওটা মিহি টুং-টাং, কোনওটা তার মধ্যবর্তী আওয়াজ। সব মিলে ঘণ্টাধ্বনির অনবদ্য কোরাস! চন্দনবন ধুলোয় ঢেকে গেল। ডুবতে থাকা সূর্যও ধুলোয় মুখ ঢাকল। ছাত্রীটিকে জিগ্যেস করলাম— গোধূলি মানে কী বল তো? ও বলল, ‘‘জানি না, স্যার। তবে গো মানে গরু আর ধূলি তো ধুলো!’’ আমি বললাম— ওই দ্যাখ, ওদের পায়ের ধুলোয় চারদিক ঢেকে গিয়ে কী ভাবে দিনটা শেষ হয়ে যাচ্ছে! এটাই গোধূলি! এমন ভাবে ‘গোধূলি’ শব্দটার অর্থ আমি নিজেও আগে কোনওদিন বুঝিনি! মেয়েটি অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর আমরা একশো মোষের পিছন পিছন চলতে লাগলাম বাথানের দিকে। তারপর বাথান, কালাপানি নদী, চন্দনবন আমার অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে গেল। নাথুয়ায় যেক’টা বছর ছিলাম, বার বার গিয়েছি অপরূপ সে সব গোধূলির টানে। উত্তরবঙ্গের ছেলে, ভাওয়াইয়া শুনতে শুনতে বড় হয়ে উঠেছি। মোষবাথান, মইষালবন্ধু ইত্যাদি শব্দগুলো শুনতে শুনতে বেড়ে ওঠা। অদ্ভুত ভালবাসায় উত্তরের শব্দ-সুর নিয়ে দিনযাপন। আমার পরম নিকটজনেরা এ ভাষায় কথা বলেন। বিনম্র ভালবাসায় তা গ্রহণ করেছি বারবার।

নাথুয়া ছেড়ে চলে আসার পরও সেই প্রথম দেখা সত্যিকারের গোধূলি আমায় পাগলের মতো ডাকে, ডেকেই যায়। লেখক ও পর্যটক গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য আমার এই অনুভবের কথা জানতেন। নাথুয়া থেকে চলে আসার কয়েক বছর পর তাঁর লেখা একটা পোস্টকার্ড পেয়েছিলাম— কালাপানির জঙ্গলের সেই চন্দনবনটা ভ্যানিশ! একটা চন্দনগাছও নেই। সব কেটে নিয়ে গিয়েছে। কী যে কষ্ট পেয়েছিলাম। তারপর আর যেতে ইচ্ছে করেনি জায়গাটিতে। শুনেছি, সেসব মোষের বাথানও আর আগের মতো নেই।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

পরবর্তী কালে একটা ভাওয়াইয়া গান লিখেছিলাম, যে গান অনেক শিল্পী এখনও গেয়ে থাকেন— ‘কোন্টে গেইল সেই মইষের বাথান / মইষালবন্ধুর দোতেরাখান / মইষগুলা হায় একলা ঘুরিছে / বনের টিয়া কান্দি উড়িছে/ কালাপানির জলে যাই / নাই বালিহাঁস ডাহুক নাই/ চক্ষু দুইখান জলে ভরিছে / মোর গেরামের রাখাল কই / জল ভরে না আর তো সই / নদীর বুকোত চর পড়িছে / নাই গুয়াপানেরই বন / হারেয়া গেইল হামার মন /মানষিগুলার পরান মরিছে।’ এই গানের স্তরে স্তরে, সুরের ওঠানামায় সেই সব হারানোর প্রত্যক্ষ কষ্ট লুকিয়ে রেখেছি! আমাদের মতো অনেকেই লুকিয়ে রেখেছেন!

রণজিৎ দেব তাঁর ‘লোকসাহিত্যে ভাওয়াইয়া গান’ গ্রন্থে মোষবাথান আর মইষালদের কথা এ ভাবে লিখেছেন— ‘এক সময় এইসব এলাকা ছিল বিস্তীর্ণ পতিত জমি, অরণ্য, নদীসঙ্কুল। পশুপালন ছিল আয়বৃদ্ধির পথ। গো-মহিষ পালনের মাধ্যমে দুধ, দই, ঘি বিক্রি করে আয় হত। জোতদাররা এক-একটি বাথানে শতাধিক মহিষ গোরু রেখে পালন করত। ঘাসের জন্য এদের নিয়ে চরানো হত বনের ধারে, নদীর ধারে বিস্তৃত চরে। মহিষের সংখ্যার উপর বাথানের মইষাল সংখ্যা নিরূপণ হত। এক-একটি বাথানে ৫/৬ জন মইষাল থাকত। গাড়িয়াল-মাহুত-মইষালরা গৃহস্থের বাড়িতে চাকুরি করত— খাওয়াদাওয়া আর সামান্য পয়সাকড়ির বিনিময়ে। মহিষ রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে বাড়িতে

স্ত্রী-কন্যাদের রেখে গৃহস্থ-বাড়ির চাকুরি নিয়ে চলে যেতে হত।’

এই বাথান আর মইষালরা উত্তরের ভাওয়াইয়া গানে বিরাট জায়গা দখল করে রয়েছে। রণজিৎ দেব লিখেছেন— ‘স্ত্রীর দুঃখে যেমন এই সকল ভাওয়াইয়া গানের উৎপত্তি, তেমনই যেখানে চাকুরিতে যাচ্ছে, সেখানে যাওয়ার পর সেই জায়গার পরস্ত্রী, যুবতী নারীর প্রেমে পড়ার গানের সংখ্যাও কম নয়। প্রিয় পত্নী ভালবাসার পাত্রীর অন্তরে যেমন বিরহের গানের পঙ্‌ক্তি ভেসে ওঠে, তেমনই নতুন জায়গায় নতুন প্রেমের সান্নিধ্যেও নতুন প্রেমের গান ভেসে ওঠে। পরকীয়া প্রেম ভাওয়াইয়া সঙ্গীতে এক বিরাট অংশ দখল করে আছে। যেখানে মইষালরা মহিষ চড়াতেন, সেখানে গিয়েও যুবতী-প্রেমে হাবুডুবু খাওয়ার কথাও বাঙ্‌ময় হয়ে উঠেছে ভাওয়াইয়া গানের সুরে।’

আধুনিকতার বাড়াবাড়িতে দোতারা কোণঠাসা। মোষের গা ছুঁয়ে উড়ছে সাদা বক, আকাশে কত রংবদল, প্রকৃতিতেও পাল্টে পাল্টে যাওয়া কত রূপবদল। মোষের পিঠে চেপে প্রান্তর-নদী পেরিয়ে অরণ্যগামী যে মানুষটা দোতারা বাজিয়ে মনের কথা বলত নিসর্গের কাছে, সেই মানুষটাও ক্রমবিলুপ্ত। কিন্তু ভাওয়াইয়া গানে তার কথা, তার ভালবাসার মানবীটির কথা ধরা থেকে গিয়েছে চিরন্তনী কথা আর সুরে। কোনও গানে বলা হচ্ছে— ‘বাথান বাথান করেন মইষাল ও / মইষাল বাথানে করলেন বাড়ি / যুব্বা নারী ঘরোত থুইয়া, কায় করে চাকরি মইষাল ও’। আবার কষ্ট বোনা হয় এ ভাবেও— ‘মইষ চড়ান মোর মইষাল বন্ধু মইষের গলায় দড়ি / কি ও হোরে— বিধাতা বঞ্চিত হইল / মোরে একলায় যাইবেন ছাড়ি রে’। সে চলে গেলে মেয়েটির কান্নাও নির্মিত হয় এমন করে— ‘মইষ চড়ান মোর মইষাল বন্ধু রে / বন্ধু কোন বা চরের মাঝে / য়্যালা ক্যানে ঘন্টির বাইজন / না শোনোং মুই ক্যানে মইষাল রে’।

আমার নেপালি ছাত্রীটির বাবা আমায় গ্লাস ভরা মোষের দুধ দিয়ে বলেছিলেন— ‘কোনও ভেজাল নেই। খেয়ে নিন।’ আমি তাঁর কাছ থেকে শুনছিলাম বাথানের গল্প। আবহে বাজছিল মোষেদের ভোঁস-ভোঁস আওয়াজ। সন্ধারাতেই মইষালদের রান্না বসেছিল। নদীর ওপার থেকে হঠাৎ-হঠাৎ ময়ূরের ডাক ভেসে আসছিল। তার মধ্যেই কাছের আর একটি বাথানে দোতারা বেজে উঠতেই আমার সব মনোযোগ সে দিকে উধাও হল!

অমন কান্নাপাওয়া টানা সুরের গান এ জীবনে আর শুনিনি!

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Travel Gorumara Travel and Tourism
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE