Advertisement
E-Paper

বড় তাড়াতাড়ি বিসর্জন

তার জন্য লেখা জোগাড় করার ভার আমার ওপর। এক অগ্রজ কবির কাছে লেখা নিতে গিয়েছি।

স্মরণজিৎ চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০১৮ ০০:০০
ছবি: সুব্রত চৌধুরী

ছবি: সুব্রত চৌধুরী

পৌলোমীদির সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ ২০০০ সালের বইমেলায়। তখন আমাদের একটা লিটল ম্যাগাজিন ছিল। তার জন্য লেখা জোগাড় করার ভার আমার ওপর। এক অগ্রজ কবির কাছে লেখা নিতে গিয়েছি। তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, পৌলোমী সেনগুপ্তর লেখা আমরা নিয়েছি কি না!
পৌলোমী সেনগুপ্তর কবিতা আগেই আমি পড়েছিলাম। ‘পেনসিল খুকি’, ‘আমরা আজ রুমাল চোর’-এর অমন সুন্দর, পরিমিত ভাষার কবিতা পড়ে চমকে গিয়েছিলাম আমি। তত দিনে জেনেছি তিনি কৃত্তিবাস পুরস্কার পেয়েছেন। কিন্তু কী ভাবে যে তাঁর কাছে আমাদের সেই ছোট পত্রিকার জন্য কবিতার দাবি জানাব সেটা বুঝে উঠতে পারছিলাম না। সেই দাদাটি পৌলোমীদির সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করিয়ে দেন। উনি কবিতা দিতে রাজি হলেন। সে দিন বইমেলায় অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ ছিল ওঁর। আমাকে বললেন, সেখানে গিয়ে লেখাটা নিতে। মনে আছে, জানুয়ারির শেষ রবিবার, বিকেলে হাল্কা হাওয়া দিচ্ছিল ময়দানে। অদ্ভুত সুন্দর রোদে ডুবেছিল গোটা বইমেলা! উনি কবিতা দিয়ে বললেন, ‘দেখো, ছাপায় বানান ভুল যেন না থাকে!’
কিন্তু তার পরেই এক সকালে আমি ফোন পাই ওঁর। আমি অবাক হয়েছিলাম। কারণ ওঁর কাছে তো আমার টেলিফোন নম্বরই ছিল না, পেলেন কোথা থেকে! দিদি ফোন করেছিলেন কারণ, আমায় লেখা দেবার পরে উনি খেয়াল করেন, আমাকে যে লেখাটা দিয়েছিলেন সেটা আগেই অন্য এক পত্রিকায় দিয়ে দিয়েছেন। তাই আগের লেখার বদলে নতুন একটা লেখা দিতে চান উনি! গোলপার্কে ওঁর সঙ্গে দেখা করে আমি লেখাটা নিয়েছিলাম। পত্রিকা ছাপা হওয়ার পর আমি নিজে গিয়ে পত্রিকার কপি দিয়ে এসেছিলাম ওঁর বাড়িতে। সেই আলাপের শুরু।
প্রথম থেকেই উনি বেশ গম্ভীর ছিলেন। সবার নানান কথা শুনতেন, কিন্তু খুব যে উত্তর দিতেন, তা নয়। আর যেটুকু বলতেন সেটা হত সংক্ষিপ্ত এবং পরিমিত। কোনও কিছু নিয়ে বিশাল উচ্ছ্বাস দেখাতে আমি ওঁকে কোনও দিন দেখিনি। একটা অদ্ভুত ভারসাম্য থাকত দিদির কথায়, ব্যবহারে। আমি বৃষ্টি-র (পৌলোমীদির মেয়ে) জন্য সামান্য কিছু কিনে নিয়ে গেলে খুব রাগ করতেন। বকতেন। আমি প্রথম থেকেই ওঁকে সমীহ করে চলতাম! আসলে সত্যি কথা বলতে কী, বেশ ভয়ই লাগত আমার!
কখনও আমি দেখিনি উনি উচিত কথা বলতে ইতস্তত করছেন। বরং যেটা ঠিক মনে হত উনি স্পষ্ট বলে দিতেন। নিজেই এক বার আমাকে বলেছিলেন, উচিত কথা স্পষ্ট ভাবে বলে দিতেন বলে, স্কুলে এক টিচার ওঁকে ‘খড়খড়ি’ বলে ডাকতেন।
প্রচুর পড়াশোনা ছিল দিদির। কিন্তু কোনও দিন শুনিনি কাউকে উনি জোর করে জ্ঞান দিচ্ছেন। ফরাসি, ইংরেজি, সংস্কৃত জানতেন খুব ভাল। সারা ক্ষণ দেখেছি তাঁর টেবিলে বইয়ের স্তূপ। কিন্তু কখনও বলেননি যে, এই পড়ো, ওই পড়ো! কেবল বলতেন, অমুক বইটা ওঁর ভাল লেগেছে! ব্যস্ ওইটুকুই!
নিজে নব্বইয়ের এক জন প্রধান কবি হয়েও কোনও দিন নিজের কবিতা নিয়ে কিছু বলতে শুনিনি। নিজের অনুবাদ করা বই নিয়ে কিছু বলতে শুনিনি। গদ্য নিয়ে কিছু বলতে শুনিনি। নিজেকে অদ্ভুত একটা আড়ালে লুকিয়ে রাখতেন উনি। ওঁর জীবনে একটা বারান্দা আর একটা ড্রইং রুম ছিল। সেখান অবধিই কেবল মানুষকে আসতে দিতেন! নিজের আনন্দ বা সাফল্যের কথা যেমন জাহির করে বলতেন না, তেমনই কষ্ট বা ব্যক্তিগত শূন্যতার কথাও কাউকে জানতে দিতেন না! এক অদ্ভুত নিস্পৃহ দূরত্বে জীবনকে দেখতেন! মনে হত যেন নিজের জীবন নয়, অন্য কারও জীবন এটা!
আমার গদ্য লেখার শুরু পৌলোমীদির সম্পাদিত পত্রিকা থেকেই। সেটা ২০০২ সাল। সে বছর ডিসেম্বরে আমি একটা ছোট গল্প লিখে ‘আনন্দমেলা’-য় জমা দিয়েছিলাম। তখন পৌলোমীদিই ‘আনন্দমেলা’-র সম্পাদক। আমি ওঁকে কিছু না বলেই লেখাটা পাঠিয়েছিলাম। জীবনের প্রথম লেখা, আর সেটা নির্ঘাত বাজে হয়েছে, এই ধরে নিয়ে আমি লেখাটা সম্পর্কে আর উচ্চবাচ্য করিনি। মাস খানেক পরে এক দিন উনি ফোন করে বলেছিলেন, লেখাটা ঠিক আছে। কিন্তু এক প্যারাগ্রাফ আগেই তো শেষ হতে গিয়েছিল সেটা। কেন অতিরিক্ত একটা প্যারাগ্রাফ যোগ করেছি আমি! ওটা যেন বাদ দিয়ে দিই! সেটা ছিল আমার গদ্য লেখার প্রথম শিক্ষা! তবে লেখাটা ‘আনন্দমেলা’-য় না ছাপা হয়ে, ছাপা হয়েছিল ওঁর সম্পাদিত ‘উনিশ কুড়ি’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যায়!
ছোট গল্পে কতটা বলতে হয় আর কতটা বলতে নেই, সেটা উনি নানান ভাবে তার পরেও বলেছেন আমায়! জীবনের প্রথম থ্রিলার লেখা থেকে শুরু করে প্রথম উপন্যাস লেখা সব কিছুই ওঁর হাতেই জমা দিয়েছি আমি। এমনকি জীবনের প্রথম ধারাবাহিক উপন্যাস লেখার কথাও উনি বলেছিলেন আমায়। বলেছিলেন, ‘একটা বড় উপন্যাস তুমি কি জমা দেবে? তবে মনোনীত না হলে কিন্তু মনখারাপ করবে না। খারাপগুলো মেনে নিতে শেখাটাও বড় হয়ে ওঠার একটা অঙ্গ জানবে।’
মনে আছে জীবনের প্রথম উপন্যাসের প্রথম দশ হাজার শব্দ লিখে ওঁকে দেখাতে বলেছিলেন। দেখাবার পরে বলেছিলেন, কী কী ভুল হচ্ছে। সব শুনে ভেবেছিলাম, এত ভুল লেখা লিখেছি! বোধ হয় বলবেন আর লিখতে হবে না! কিন্তু সব বলার পরে সামান্য হেসে বলেছিলেন, ‘আমার কৌতূহল হচ্ছে গল্পের শেষে ইয়াং ছেলেমেয়েগুলোর কী হবে জানতে! তুমি বাকিটা লিখে জমা দাও।’
কোনও দিন উচ্চ স্বরে প্রশংসা করেননি উনি। কিন্তু লেখা খারাপ লাগলে ফোন করে বলতেন যে লেখাটা খারাপ হয়েছে। কেন খারাপ হয়েছে সেটাও জানিয়ে দিতেন! শুধু আমার মতো অচেনা আনকোরা একটা ছেলেকেই নয়, এই প্রজন্মের অনেক নামকরা লেখককেই উনি প্রথম লেখার জায়গা করে দিয়েছিলেন।
নিজেও খুব ভাল গদ্য লিখতেন। কিন্তু অদ্ভুত এক সংযমে নিজেকে সরিয়ে রেখেছিলেন এর থেকে। জিজ্ঞেস করলে বলতেন, ‘সবাই যে লিখবে এমন তো নয়। বা সবাইকে লিখতে হবে, তাও নয়!’
তবে শেষের এক বছর আবার নতুন করে লেখা শুরু করার কথা ভাবছিলেন। বড় কবিতা লেখার কথা ভাবছিলেন। বলেছিলেন, উপন্যাস লেখার ইচ্ছের কথা! কিন্তু জীবন বড় নিষ্ঠুর। মানুষের ইচ্ছে, তার পরিকল্পনা জীবনের সামনে ধুলোকুচির মতো! উড়ে, হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে তার সময় লাগে না!
পৌলোমীদি অসুস্থ ছিলেন বেশ কিছু দিন। কিন্তু উনি নিজে যেহেতু সেই বিষয়ে বিশেষ কাউকে জানাননি, তাই তা নিয়ে কিছু বলাটা আমার পক্ষেও অনুচিত। শুধু বলি, শেষের দু’বছর দিদির সঙ্গে আমার অনেক বেশি কথা হয়েছে। এই সময়ে উনি আগের চেয়ে অনেক বেশি মন খুলে কথা বলতেন! আমার একটা ছোট কবিতা পড়ে বলেছিলেন, ‘আমার জন্য এমন একটা লেখা লিখো, কেমন?’
আমি সেই লিখছি, কিন্তু যেমন চেয়েছিলেন এটা তা নয়! এ বড় কষ্টের লেখা। যা নেই, যা মিলিয়ে গেল হাওয়ায়, তাকে ধরে রাখতে চাওয়ার লেখা!
এ বার পুজোয় এক আত্মীয়ের বাড়িতে এসেছি নদিয়ায়। সেখানে বড় করে পুজো হচ্ছে! খবরটা জানলাম যখন অষ্টমীপুজোর অঞ্জলির প্রস্তুতি হচ্ছিল! ঢাক বাজছিল। পুজোর গান হচ্ছিল নরম সুরে! খবরটা পেয়ে একলা ছাদে দাঁড়িয়ে আমি আকাশের দিকে তাকিয়েছিলাম। শরতের নীল আকাশে আলোর তলায় এত অন্ধকারও লুকিয়ে ছিল! মহাষ্টমীতে এ ভাবেও বিসর্জন হয়! বিজয়া যে অনেক দেরি!
বস্তুজগতে পৌলোমী সেনগুপ্ত আর নেই। কিন্তু আমার কাছে, আমার মতো অনেক নবীন লেখকের কাছে তিনি থেকে যাবেন চির কাল! আমাদের সামান্য লেখায়, আমাদের গল্প বলার চেষ্টায়, আমাদের গদ্য লেখার, পদ্য লেখার দুঃসাহসে, নীরব প্রশ্রয় নিয়ে আমাদের সঙ্গে সঙ্গে থাকবেন!
জানি না, প্রিয়জনের মৃত্যু কী ভাবে বহন করে মানুষ! চলে গিয়ে বোধ হয় এটাই অন্তিম পাঠ হিসেবে রেখে গেলেন দিদি! আর কত খারাপ মেনে নিলে বড় হওয়া যায় জানি না! শুধু এটুকু বুঝলাম, এ বারের মতো আমার পুজোর বিসর্জন হয়ে গিয়েছে! পাতা ঝরার মরশুম বড় তাড়াতাড়ি এল এ বার!

ছবি: সুব্রত চৌধুরী

স্মৃতিচারণা পৌলোমী সেনগুপ্ত Memorial Obituary Smaranjit Chakraborty
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy