Advertisement
E-Paper

বাকি দিনগুলো তবে কী শুনব

আমরা ২০ জুলাই দিনভর যে নির্যাস পেলাম তা হল সব চেয়ে বড় বিরোধী দলের নেতার সঙ্গে দেশের প্রধানমন্ত্রীর বাগ্মিতার দ্বৈরথ, যেখানে আগে বলতে উঠে ‘রাগা’ (রাহুল গাঁধী) টি-টোয়েন্টির মেজাজে সেই খোপে টেস্ট ক্রিকেটের লম্বা দু’টি ইনিংসকে পুরে ফেললেন, আর দিনের শেষে ‘নমো’ (নরেন্দ্র মোদী) তাঁর নিজস্ব স্টাইলে এবং তার আগে তাঁর ক্যাবিনেটের অন্য মন্ত্রীরা, ‘রাগা’ উত্থাপিত নানা অভিযোগের উত্তর দিলেন।

শিবাজীপ্রতিম বসু

শেষ আপডেট: ২৪ জুলাই ২০১৮ ০০:০০
নরেন্দ্র মোদী এবং রাহুল গাঁধী বাদল অধিবেশনে।ফাইল চিত্র।

নরেন্দ্র মোদী এবং রাহুল গাঁধী বাদল অধিবেশনে।ফাইল চিত্র।

বাদল অধিবেশনের প্রথম দিনেই তো পক্ষ-বিপক্ষের সব বাদ্যি বেজে গেল! এর পর অধিবেশনের বাকি দিনগুলোয় কী শুনব? বাদলের ধারাপাত? অথচ, বিরোধীদের তূণে শাসকের দিকে ছোড়ার মতো এত প্রশ্নবাণ জমে ছিল, যা তীক্ষ্ণ বৃষ্টির বল্লমের মতো নিশানায় লাগলে এই শুরু থেকে শেষ অবধি জমিয়ে রাখতে পারত।

ছিল ধুমধাড়াক্কা রান্নার গ্যাসের দাম বৃদ্ধি ও প্রতি দিন পরিবর্তনশীল পেট্রল-ডিজ়েলের অতি ঊর্ধ্বমুখী মূল্যে নাজেহাল মধ্যবিত্ত ও সাধারণ মানুষের কথা। সেই সূত্রে কেন পেট্রল-ডিজ়েলকে জিএসটি-র আওতায় আনা হল না— যাতে তাদের মূল্য অনেকটা কমে যেতে পারে— সেই প্রতিপ্রশ্নও ছিল। যুবকদের কর্মসংস্থানে কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যর্থতার প্রসঙ্গে বলা যেতে পারত ভারতে বিদেশি সংস্থার হয়ে পণ্য নির্মাণ বা ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ (যার মারফত প্রচুর কর্মসংস্থান হওয়ার সম্ভাবনা) নামক শূন্য কলসির ঢকঢকানির কথা। সেচের জল ও ফসলের সহায়ক মূল্য না-পাওয়া, ঋণভারে ন্যুব্জ ভারতের কৃষক সমাজের চোখের জলের কথা ছিল, যাঁরা এই জম্বুদ্বীপের নানা রাজ্যে দীর্ঘ দিন কৃষিঋণ মকুবের দাবি জানিয়ে আসছেন। এর মধ্যে বিজেপি-শাসিত দুই বড় রাজ্য, মধ্যপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্রে কৃষকরা যে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন তা দৃশ্যত ব্যাপ্তি ও গভীরতায় সবার নজর কেড়েছে।

পাশাপাশি ছিল নানা গুজবে ভর করে উন্মত্ত ভিড়তন্ত্রের হাতে ভারতে ক্রমবর্ধমান গণপিটুনিতে থেঁতলে মারার গা-শিউরানো আখ্যান। এ দিক ও দিক এমন ভয়ঙ্কর ঘটনা বিচ্ছিন্ন ভাবে আগেও ঘটেছে নিশ্চয়, কিন্তু এমন সংগঠিত ও মুহুর্মুহু গণপিটুনির কথা তিন-চার বছর আগে শোনা যায়নি। কখনও গোমাংস রাখা বা পাচারের অভিযোগে, কখনও বা ‘ছেলেধরা’ অভিযোগে (প্রসঙ্গত, একই ধরনের অভিযোগে ১৯৯০ সালে এ রাজ্যের বানতলা দেখেছিল ধর্ষণ ও পিটিয়ে খুনের পৈশাচিকতা) মুখ্যত সংখ্যালঘু ও দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ এই বর্বরতার শিকার। এই সব বীভৎস ঘটনার ‘জীবন্ত’ ছবি (মানে যেখানে আক্রান্ত মানুষটি মৃত্যুর আগে হাত জোড় করে বাঁচার কাতর আবেদন জানাচ্ছেন) সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করে ‘উচিত শিক্ষা’ দেওয়ার বড়াই করে যারা, তাদের অনেকেই যে বিজেপির নেতা-মন্ত্রীদের টুইটের নিয়মিত ‘ফলোয়ার’, সেটা কি নেহাতই কাকতালীয়! এর সঙ্গে নারীদের ওপর বেড়ে চলা গণধর্ষণ ও হত্যা-সহ নানা অপরাধের বিষকুম্ভ ছিল। বিদেশ নীতি ছিল, রাফাল যুদ্ধবিমানের ‘অস্বচ্ছ’ বেচাকেনার কথা ছিল। এত সব বিষয় বাদল অধিবেশনের প্রায় তিন মাসের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) অবকাশে একে একে উত্থাপিত হলে বিরোধী প্রশ্ন ও সরকারি উত্তরে কেবল শৌখিন বিতর্ক জমত না, দেশের আগ্রহী মানুষও এই সব জীবনজোড়া বিষয়ের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে কিছুটা অন্তত আন্দাজ করতে পারতেন।

কিন্তু তার বদলে আমরা ২০ জুলাই দিনভর যে নির্যাস পেলাম তা হল সব চেয়ে বড় বিরোধী দলের নেতার সঙ্গে দেশের প্রধানমন্ত্রীর বাগ্মিতার দ্বৈরথ, যেখানে আগে বলতে উঠে ‘রাগা’ (রাহুল গাঁধী) টি-টোয়েন্টির মেজাজে সেই খোপে টেস্ট ক্রিকেটের লম্বা দু’টি ইনিংসকে পুরে ফেললেন, আর দিনের শেষে ‘নমো’ (নরেন্দ্র মোদী) তাঁর নিজস্ব স্টাইলে এবং তার আগে তাঁর ক্যাবিনেটের অন্য মন্ত্রীরা, ‘রাগা’ উত্থাপিত নানা অভিযোগের উত্তর দিলেন। এই অধিবেশনের বাকি দিনগুলোয় সরকার পক্ষের এই সব বিষয়ে নতুন করে উত্তর দেওয়ার দায় সে ভাবে রইল না। এমনকি, যে সব প্রশ্ন ‘রাগা’ এবং অনাস্থা প্রস্তাবকারী তেলুগু দেশম পার্টি (টিডিপি) সদনে তুলে ফেলেছেন, স্পিকার মহোদয়া তা দ্বিতীয় বার তুলতে না-ও দিতে পারেন। তবে ইতিহাস অচিরেই ‘রাগা’র ঝোড়ো ইনিংসে কথিত বক্তব্য ও ‘নমো’র প্রতি-উত্তরের কথা ভুলে যাবে, মনে রাখবে বক্তৃতা শেষে ‘নমো’র আসনের কাছে গিয়ে ‘রাগা’র তাঁকে আলিঙ্গনের ‘আইকনিক’ দৃশ্যটিকে, যা ইতিমধ্যেই ‘জাদু কি ঝাপ্পি’ নামে সমস্ত মিডিয়ায় ঝড় তুলেছে। যেমন, ২০০২ সালে লর্ডস-এর মাঠে, ন্যাটওয়েস্ট ট্রফিতে, ভারতের ইংল্যান্ডকে হারানোর সংখ্যাতত্ত্ব অনেকেই ভুলে গিয়েছেন, মনে রেখেছেন ম্যাচ শেষে ভারত-অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের জার্সি খুলে খালি গায়ে তা বাঁইবাঁই করে মাথার ওপরে ঘোরানোর দৃশ্য!

আলিঙ্গন পর্বের অব্যবহিত আগে, অনাস্থা প্রস্তাবের সমর্থনে বক্তৃতা শেষে রাহুল অবশ্য প্রণিধানযোগ্য ভাবে বলেন, প্রধানমন্ত্রী তাঁকে ‘পাপ্পু’ বলতে পারেন, তাঁকে হাজারো গালি দিতে পারেন, ঘৃণা করতে পারেন, কিন্তু তাঁর অন্তরে প্রধানমন্ত্রীর জন্য ‘ভালবাসা’ ছাড়া কিছু নেই। শত্রুভাবাপন্ন লোকেদের জন্য এই প্রীতিভাবই ভারতবর্ষের সংস্কৃতি। এটাই কংগ্রেসের সংস্কৃতি। তিনি ‘কংগ্রেস’ এবং তিনি এই প্রীতির (অর্থাৎ সম্প্রীতি) সংস্কৃতি সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে সকলের মন থেকে ঘৃণা ও অসহিষ্ণুতা দূর করতে চান। সবাইকে ‘কংগ্রেস’-এ (অর্থাৎ প্রীতির আদর্শে) পরিবর্তিত করতে চান। বক্তৃতার এই রেশ ধরেই তিনি নিজের আসন ছেড়ে ট্রেজ়ারি বেঞ্চে প্রধানমন্ত্রীর আসনের কাছে গিয়ে তাঁকে দৃশ্যত অপ্রস্তুত করে জড়িয়ে ধরেন। সংসদে অধিবেশন চলাকালীন এই ঘটনা অবশ্যই ‘অভূতপূর্ব’ এবং সংসদীয় প্রথার অনুরূপ নয়, কিন্তু এই প্রথাবিরুদ্ধ আচরণের মধ্য দিয়ে ‘রাগা’ ঝানু রাজনীতিকের মতোই বার্তা দিলেন যে কংগ্রেস = প্রীতি, সহিষ্ণুতা; আর বিজেপি = ঘৃণা, অসহিষ্ণুতা। তবে এই পরিপক্ব বার্তা জ্ঞাপনের পরই, নিজের আসনে ফিরে গিয়ে যখন কোনও সতীর্থের দিকে চেয়ে ‘কী, কেমন দিলাম!’ ভঙ্গিতে চোখ মটকালেন তিনি (এটাও মিডিয়ায় ভাইরাল) তখন কি কংগ্রেস সভাপতি খানিকটা ‘পাপ্পু’-জাতীয় ছেলেমানুষিতে ফিরে গেলেন না!

কিছুটা ছেলেমানুষি অন্য জায়গাতেও হয়েছে, যা বিজেপির পক্ষে কিছুটা ‘শাপে বর’ হতে পারে। প্রথম অপরিপক্বতা, বিরোধী সমন্বয়ের পূর্ণ প্রস্তুতি না নিয়ে অনাস্থা প্রস্তাব সমর্থনে নেমে পড়া। সরকারি ভাবে অনাস্থা প্রস্তাব পেশ অবশ্যই টিডিপি করেছে, নবগঠিত অন্ধ্রপ্রদেশের প্রতি কেন্দ্রের নানা ‘বঞ্চনা’র বিরুদ্ধে, কিন্তু যদি সে প্রস্তাবের সমর্থনে ‘রাগা’র নেতৃত্বে কংগ্রেস ঝাঁপিয়ে না পড়ত, তবে কি তা পেশ করা সম্ভব হত? দ্বিতীয়ত, সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবে হেরে গেলেও কিছু যায় আসে না যদি তা শাসক দলের কার্যকালের মাঝ বরাবর হয়। কিন্তু, আগামী বছর সাধারণ নির্বাচনের ঘণ্টা যখন প্রায় বেজে গিয়েছে তখন শাসকের হাতে শোচনীয় পরাজয় (৩২৫-১২৬) শাসকদের এককাট্টা ও বিরোধীদের হতাশ করবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো অনেক পোড়-খাওয়া নেতাই প্রথমে এই সময়ে অনাস্থা পেশে কিছুটা দোলাচলে থাকলেও বিরোধী ঐক্যের প্রশ্নে প্রস্তাবকে সমর্থন করেন। এবং, পর দিন ২১ জুলাইয়ে কলকাতায় মহাসমাবেশ থাকা সত্ত্বেও দলের সব সাংসদদের মমতা ভোটাভুটি শেষ না হওয়া অবধি সংসদে থাকার নির্দেশ জারি করেন। কিন্তু সব বিরোধীরা কি ঐক্যবদ্ধ ছিলেন? তবে ‘তেলঙ্গানা রাজ্য সমিতি’র (টিআরএস) সদস্যরা অনুপস্থিত রইলেন কেন? শিবসেনার অনুপস্থিতি যদি বিজেপি তথা শাসক-জোট এনডিএ-র পক্ষে চিন্তার হয়, তবে পনিরসেলভাম-এর দুর্বল নেতৃত্বে গড়া তামিলনাড়ুর এআইএডিএমকে-র উল্টো দিকে (শাসকের পক্ষে) ভোট দেওয়ার পিছনে (নেতাদের বাড়িতে সিবিআই হানা-সহ) যে কৌশলের অভিযোগই থাক, তা কি আগে হিসেবে রাখার প্রয়োজন ছিল না! মনে রাখতে হবে, কিছু শরিকের ভোট হাতছাড়া হলেও সরকার আবার জোট–বহির্ভূত দলের সমর্থনও পেয়েছে।

এই সব কিছুর জেরেই, ‘নমো’ অ্যান্ড কোং তুলে দিয়েছেন সেই বিলিয়ন ডলার প্রশ্ন: বিজেপির বিরুদ্ধে বিরোধীরা কি ঐক্যবদ্ধ? যদি হয়, তবে তার মুখ্য নেতা কে? যদি বলা হয়, এই প্রশ্ন ভোটের পরেই (যদি বিজেপি পরাজিত হয়) স্থির হবে, তবে বিজেপি তুলে ধরছে বা ধরবে ১৯৯৬ সালে নরসিংহ রাও সরকারের অবসানের পর কংগ্রেস সমর্থনে গড়া দেবগৌড়া ও গুজরালের সরকারের প্রায় দু’বছরের ‘অস্থিরতা’র প্রসঙ্গ। এমন কথা এক কালে (১৯৪৭-৮৯) কংগ্রেস বলে থাকত, যখন কংগ্রেস আর ভারত প্রায় সমার্থক ছিল। মনে আছে, কেন্দ্রে প্রথম অকংগ্রেসি সরকার জনতা পার্টির শাসন অবসান হলে ১৯৮০-র নির্বাচনের একটি পোস্টারে ইন্দিরা গাঁধীর ছবির নীচে লেখা থাকত, ‘চুজ় বিটুইন অ্যানার্কি অ্যান্ড অর্ডার’। নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি কি সেই পুরনো সর্বময় কংগ্রেসের ভাষ্যে ফিরে গেল?

মনোজ মিত্রের ‘রাজদর্শন’ নাটকে শনি দেবতার চক্রান্তে অত্যাচারী (কিন্তু মৃত) নন্দ রাজার দেহে এক বুভুক্ষু ব্রাহ্মণ লম্বোদরের আত্মা ঢুকে পড়েছিল। অনেক দিন রাজার দেহে থাকতে থাকতে এক সময় এই প্রবঞ্চনা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লে রাজার শরীরবাসী লম্বোদর বলে উঠেছিল, ‘‘এখন আমিই নন্দ!’’

বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক

Monsoon Session Rahul Gandhi Narendra Modi বাদল অধিবেশন
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy