E-Paper

সহজে কঠিনে

১৯২৫ সালের ৩ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী বেনিটো মুসোলিনি একটি যুগান্তকারী বক্তৃতা দিয়েছিলেন, যাকে সে দেশের ফ্যাসিবাদী শাসনের প্রথম মুহূর্ত বলে বর্ণনা করা হয়।

শেষ আপডেট: ২০ জুলাই ২০২৫ ০৫:৫৭

আপাত-সহজের আবরণে কেমন করে কঠিন শৃঙ্খল মানুষের উপর চেপে বসতে পারে, তার জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত, কিঞ্চিদধিক শতবর্ষ আগের ইটালি। কোনও রাজনৈতিক হিংসা নয়, উত্তেজনা বা দমনপীড়ন নয়, সোজাসুজি পার্লামেন্টীয় কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে তৈরি হয়েছিল ফ্যাসিস্ট শাসনের লৌহপ্রাকার। ১৯২৫ সালের ৩ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী বেনিটো মুসোলিনি একটি যুগান্তকারী বক্তৃতা দিয়েছিলেন, যাকে সে দেশের ফ্যাসিবাদী শাসনের প্রথম মুহূর্ত বলে বর্ণনা করা হয়। বক্তৃতাটি দেওয়া হল দেশের প্রধানমন্ত্রীর স্বাভাবিক ভঙ্গিমায়, ফলে তার সুরটি সজোর সপাট হলেও এত বড় একটা ইতিহাস যে তৈরি হয়ে উঠতে চলেছে, আগামী দুই দশকে যে বিশ্বপৃথিবীর উপর এমন অনপনেয় ছাপ ফেলে যাবে হিটলারের জার্মানির সঙ্গে তাল-মেলানো মুসোলিনির ইটালি— এ সব কোনও কিছুই সে দিন বোঝার অবকাশ ছিল না। অর্থাৎ, ফ্যাসিজ়ম-এর দুনিয়াদারি কোনও ‘বিগ ব্যাং’ বা বিস্ফোরণ দিয়ে নয়, বরং সামান্য ‘হুইম্পার’ বা মৃদুধ্বনি দিয়েই শুরু করেছিল। পার্লামেন্টে চেম্বার অব ডেপুটিজ়-এ ইল দুচে-র (এ নামেই ইটালিতে অভিহিত হতেন মুসোলিনি) ভাষণটির কয়েক মাস আগে ওই চেম্বারেই হত্যা করা হয়েছিল সমাজতান্ত্রিক নেতা মাতিওতিকে। দেশ জুড়ে এক ধরনের অস্বস্তি বিরাজ করছিল এই হত্যাকাণ্ডের পর। অস্বস্তি চিরতরে ঘোচানোর লক্ষ্য নিয়ে ইল দুচে সেই ভাষণে বললেন: “আমি আজ যে কথাগুলি বলব, সঠিক অর্থে তা কোনও পার্লামেন্টারি বক্তৃতা নয়। আমি আর ভোটের প্রত্যাশী নই, ইতিমধ্যেই অনেক ভোট আমার ঝুলিতে আছে।” তৎকালীন ইটালিতে সাংবিধানিক ৪৭ নম্বর ধারা-মতে যে কোনও মন্ত্রীকেই বিরুদ্ধ প্রশ্ন ও সমালোচনায় বিদ্ধ করা যেত, সুপ্রিম কোর্টে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা যেত। ইল দুচে সোজাসুজি লক্ষ্য করলেন সেই সাংবিধানিক অধিকারটিকে। সোজা জিজ্ঞাসা ছুড়ে দিলেন, পার্লামেন্টে কেউ কি আছেন যিনি তাঁর বিরুদ্ধে ৪৭ নম্বর ধারা ব্যবহার করতে চান? কোনও শব্দ হল না। নিশ্চুপ সকলে। নীরবতা নিশ্ছিদ্র। সমস্ত প্রশ্ন ও সমালোচনার সে দিনেই সমাধি ঘটল ইটালিতে। ফ্যাসি-শাসন সম্পূর্ণ মহিমায় প্রতিষ্ঠিত হল। ১৯২৫-পরবর্তী দু’টি দশকে ইল দুচের কোনও সিদ্ধান্ত, কোনও পদক্ষেপে আর কেউ টুঁ শব্দ তোলারও সাহস পেলেন না।

অথচ ওই বক্তৃতাতেই মুসোলিনি একাধিক বার উল্লেখ করেছিলেন— তিনি বিরোধী রাজনীতিকদের অধিকার বিষয়ে কতটা সচেতন। “আই সে টু দি অপোজ়িশন, আই রেকগনাইজ় ইয়োর আইডিয়াল রাইটস, অ্যান্ড অলসো ইয়োর কন্টিনজেন্ট রাইটস।” পুরো হাউস-এর নীরবতায় মুগ্ধ হয়ে গেলেন নেতৃবর, নিজের এই ‘সেনসেশনাল সাকসেস’ বিষয়ে বেশ কিছু মন্তব্য জুড়ে দিলেন বক্তৃতায়। তার সঙ্গে ইটালিতে যে মৃত্যুদণ্ড ১৮৮৯ সালে বেআইনি করে দেওয়া হয়েছিল, তা আবার নতুন করে চালু করে দিলেন। জাতির স্বার্থে, দেশের স্বার্থে সমস্ত ভুলভ্রান্তি এবং সাফল্য-গৌরবের দায় বহন করবেন, কথা দিলেন। এবং অবশ্যই, বক্তৃতার কয়েক দিনের মধ্যেই সংবাদপত্রের অধিকার সঙ্কুচিত করলেন, বিরোধী রাজনীতির প্রতিষ্ঠান বন্ধ ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেন। এত সহজে সারা হল তাঁর গোটা কার্যক্রম যে দেশবিদেশে তাঁর প্রশাসনিক দক্ষতা ও কুশলতার প্রশংসা ছড়িয়ে পড়ল। ভারতেও।

ভারতের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিজীবী মহলের বড় অংশই তখন মুসোলিনির গুণগ্রাহী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মুসোলিনি-প্রশংসার কথা বহুবিদিত, এও জানা যে পরে রোম্যাঁ রোল্যাঁ ও অন্যান্যের পরামর্শে তিনি এই ‘ভুল’ কিয়দংশে সংশোধন করেন। গান্ধী যদিও ততখানি মুগ্ধ হননি, তবে তিনিও মুসোলিনির শাসনদক্ষতার কথা বলেছেন। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় থেকে প্রমথনাথ রায়, অনেকেই নানা লেখালিখির মধ্যে প্রভূত প্রশংসা করেছেন মুসোলিনি-শাসিত ইটালির। মডার্ন রিভিউ পত্রিকায় সুনীতি চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন ফ্যাসিস্ট ইটালির ‘অর্ডারলি অ্যান্ড অল-এমব্রেসিং ন্যাশনাল প্রোগ্রেস’-এর কথা। মনে রাখা ভাল, ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উত্তাপে জারিত হতে হতে, ইউরোপে ইটালির মতো দেশের নিজস্ব সত্তা ও জাতীয়তার গৌরব প্রদর্শনের এক আলাদা অর্থ প্রতিভাত হচ্ছিল ভারতীয় মননে, এবং তাঁদের খুব কম জনই প্রকৃত তথ্য জানার সুযোগ পেয়েছিলেন। প্রকৃত তথ্য বা কঠিন সত্য অবশ্যই জানা সহজ ছিল না, কেননা তা ছিল আপাত-সহজ মোড়কে মোড়া। সহজ-কঠিনের রহস্য ভেদ করা একবিংশ শতকেই দুষ্কর। একশো বছর আগে যে তা কত গুণ বেশি কঠিন ছিল— বোঝা সহজ।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Fascism Fascist

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy