আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম মেধা নিয়ে দুনিয়া জুড়ে বিস্তর শোরগোল। যন্ত্রমেধা আশীর্বাদ না অভিশাপ, সে-প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন তথ্যপ্রযুক্তির বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে নাগরিক চণ্ডীমণ্ডপের সর্ববিদ্যাবিশারদ কথককুল অবধি সকলেই, প্রতি দিন ‘এআই’ সম্পর্কে নিত্যনতুন চিন্তার খোরাক নিয়ে আসছে নানা বক্তৃতা, রকমারি প্রতিবেদন, বিস্তর প্রবন্ধ এবং বইপত্র। এই অন্তহীন কথাসরিৎসাগরে একটি নতুন কথা যোগ করেছে ভারতের একটি সংস্থা। কথাটি কেবল নতুন নয়, অভিনব। দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ এআই-বিশেষজ্ঞরাও এ পর্যন্ত তেমন কথা ভেবে উঠতে পারেননি। সংস্থাটির নাম: অল ইন্ডিয়া কাউন্সিল ফর টেকনিক্যাল এডুকেশন বা এআইসিটিই। এঞ্জিনিয়ারিং কলেজ-সহ দেশের প্রযুক্তি শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলিতে যথাযথ ভাবে পঠনপাঠন চালানোর ব্যাপারে নির্দেশ দেওয়া, সাহায্য করা এবং তদারকি করাই এই সংস্থার প্রধান কর্তব্য। এআইসিটিই নতুন বছর উপলক্ষে প্রযুক্তি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে বার্তা পাঠিয়েছে। শুভেচ্ছার বার্তা, অনুপ্রেরণারও। এমন বার্তা পাঠানো নিতান্তই বার্ষিক রীতি। কিন্তু এ বছরের বার্তাটিতে প্রচলিত রীতির গণ্ডি অতিক্রম করে এক অ-সামান্য প্রজ্ঞার বাণী সংযুক্ত করেছেন তদারকি সংস্থার পরিচালকেরা। সেই বাণী কেবল চমৎকৃত করে না, স্তম্ভিত করে দেয়। কী সেই বাণী?
নববর্ষের ওই নববার্তায় লেখা হয়েছে যে, এই বছরটি যন্ত্রমেধার কুম্ভমেলায় পরিণত হতে চলেছে। গঙ্গা যমুনা এবং (লুপ্ত বা কল্পিত) সরস্বতীর ত্রিবেণীসঙ্গমে যেমন কুম্ভমেলার সমারোহ বসে, এআই নামক প্রযুক্তিও তেমনই এক মহাসঙ্গমের পরিসর হয়ে উঠবে। তাঁদের বক্তব্য, কৃত্রিম মেধা তিনটি বস্তুর সম্মিলনে সঞ্জাত: ডেটা বা তথ্য, অ্যালগরিদম বা সূত্রমালা এবং কম্পিউটেশনাল পাওয়ার বা গণনাশক্তি। এমন তিনটি রূপকের ত্র্যহস্পর্শ বাস্তবিকই সাহারায় শিহরন জাগাতে পারে। কিন্তু এইটুকু সৃষ্টি করেই এআইসিটিই-র স্রষ্টারা সন্তুষ্ট বা নিরস্ত হননি, ত্রিবেণীর তিনটি ‘বেণী’কেও নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন তাঁরা— তথ্য হল গঙ্গা, সূত্রমালা যমুনা এবং গণনাশক্তি সরস্বতী। কেন, কোন হিসাবে এই পরিচিতিগুলিই নির্ধারিত হল, অন্য রকম হল না, তার কোনও ব্যাখ্যা অবশ্য এখনও পাওয়া যায়নি। হয়তো ক্রমে ক্রমে সেই রহস্যও জানা যাবে। কে বলতে পারে, অচিরেই হয়তো প্রযুক্তিবিদ্যার শিক্ষক বা ছাত্রছাত্রীদের এই বিষয়ে গবেষণা করতে হবে— তথ্য-গঙ্গা, যমুনা-সূত্র এবং সরস্বতী-গণনা নিয়ে ‘ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম’ সংক্রান্ত বড় বড় সম্মেলনে লম্বা লম্বা অধিবেশন হবে, সেখানে রাশি রাশি গবেষণাপত্র পঠিত হবে। কষ্টকল্পিত কৌতুক? উদ্ভটরসের রসিকতা? যে দেশে প্রযুক্তিশিক্ষার অধিকর্তারা যন্ত্রমেধাকে অবলীলাক্রমে কুম্ভমেলা বানিয়ে দেন, সেখানে বাস্তবের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার সাধ্য কোনও কল্পনাশক্তি বা উদ্ভটরসের থাকতে পারে না।
তবে কিনা, এই উদ্ভট এবং উৎকট বার্তাটির প্রকৃত কার্যকারণসূত্র বুঝে নিতে বিশেষ কোনও সমস্যা নেই। মনে রাখতে হবে, এই বছর অনুষ্ঠিত হতে চলেছে মহাকুম্ভ। কুম্ভমেলার এই রাজকীয় তথা মেগা তথা ম্যাগনাম সংস্করণটি বারো বছর অন্তর ইলাহাবাদে গঙ্গা-যমুনার মিলনভূমিতে ফিরে আসে। এ বার তার বিশেষ মহিমা। কারণ, ভারত শাসন করছেন নরেন্দ্র মোদী, উত্তরপ্রদেশের গদিতে অধিষ্ঠিত যোগী আদিত্যনাথ এবং ইলাহাবাদের নাম হয়েছে প্রয়াগরাজ। এ-ও এক ত্র্যহস্পর্শ বইকি। এই ত্রিধারার প্রকৃত উৎস অবশ্যই সঙ্ঘ পরিবারের হিন্দুত্ববাদ। এই বস্তুটি কেবল রাজনীতির পরিসরে তার আধিপত্য বিস্তার করে ক্ষান্ত হয়নি, আপন ধ্যানধারণা চারিয়ে দিয়ে চলেছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। বিশেষ করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পরিচালকদের চিন্তায় ও মানসিকতায় এক ধরনের যুক্তিহীন অতীতচারী কুসংস্কারের দাপট বেড়ে চলেছে ভয়াবহ ভাবে। এই ভূতগ্রস্ত মানসিক অন্ধকারই গণেশের প্রতিমায় প্রাচীন ভারতে প্লাস্টিক সার্জারির প্রমাণ খুঁজে পায়, এর প্রভাবেই প্রযুক্তিবিদরা যন্ত্রমেধাকে অমৃতকুম্ভে পরিবেশন করতে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। তাঁরা সত্যই এই সব উদ্ভট কথা ভাবেন, না কি মহাকুম্ভের বছরটির সূচনায় ক্ষমতার অধীশ্বরদের খুশি করার জন্য এমন বার্তা উদ্ভাবন করেছেন, সে প্রশ্ন থেকেই যাবে। কিন্তু এই বিষয়ে কোনও প্রশ্ন থাকতে পারে না যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মুক্তচিন্তার শ্বাস রোধ করে তার বদলে এই ধরনের অবান্তর ও অর্থহীন ধারণার প্রচার যত বাড়বে, প্রকৃত শিক্ষার দুর্দিন তত ঘনিয়ে উঠবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy