Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Social Media

টুনির ধন

সংবাদমাধ্যমের সহিত কোনও সরকারেরই সুসম্পর্ক নাই, কিন্তু নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসিবার পর হইতে সংঘাত ক্রমশই প্রবল প্রকট হইয়াছে।

শেষ আপডেট: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৫:২৩
Share: Save:

আয়কর দফতর ফের হানা দিল সংবাদসংস্থার দফতরে। জুলাই মাসে একটি সংবাদপত্র ও একটি টিভি চ্যানেলকে একই ভাবে ‘পুরস্কৃত’ করিয়াছিল সরকার, সেপ্টেম্বরে অনুসন্ধানের মুখে পড়িল ডিজিটাল মাধ্যমের দুইটি সংবাদপত্র। ইহাতে কেহ আশ্চর্য হয় নাই— সংবাদমাধ্যমের সহিত সরকারের যে অদ্ভুত খেলা চলিতেছে, তাহা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর টুনটুনির গল্পকে মনে করাইয়া দেয়। রাজা সত্যকে নিজের সম্পত্তি ভাবিয়া কোষাগারে রাখিয়াছিলেন, কোন ফাঁকে সাংবাদিক তাহার সন্ধান পাইয়া চতুর্দিকে প্রচার করিয়া বেড়াইতেছেন। কোভিডে মৃতের সংখ্যা, সাম্প্রদায়িক হিংসায় নিহতের সংখ্যা, মৃত পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা, এই সব তথ্য কি রাষ্ট্র করিতে আছে? অতএব টুনির বাসায় রাজপেয়াদা পাঠাইতে হইল। পেয়াদা তহবিল খুঁজিবার নাম করিয়া সাংবাদিকদের মোবাইল ফোন এবং ল্যাপটপের সকল তথ্য তুলিয়া আনিয়াছে। রাষ্ট্রের আইনে তাহার অনুমতি নাই। সংবাদপত্র সম্পাদকদের সংগঠন ‘এডিটর্স গিল্ড’ মনে করাইয়াছে, আয়কর আইন এবং তথ্যপ্রযুক্তি আইন সাংবাদিকের পেশাগত অথবা ব্যক্তিগত তথ্য জানিবার অধিকার দেয় নাই সরকারকে। সাংবাদিকের তথ্যসূত্রের গোপনীয়তা আইন দ্বারা সুরক্ষিত। তাহা হইলে কী হয়, পেয়াদার দুঃসাহস দেখিয়া আন্দাজ হয়, রাজার অনুমোদন না লইয়া সে আসে নাই।

সংবাদমাধ্যমের সহিত কোনও সরকারেরই সুসম্পর্ক নাই, কিন্তু নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসিবার পর হইতে সংঘাত ক্রমশই প্রবল প্রকট হইয়াছে। সরকারের সমালোচনা করিলে ইডি এবং আয়কর দফতর অনুসন্ধান করিবে, রাষ্ট্রদ্রোহিতা অথবা বিদ্বেষ উস্কাইবার ধারায় কারাদণ্ড হইবে, নেতার সমালোচনা করিলে মানহানির মকদ্দমা হইবে, এই নয়া রীতিতে সাংবাদিকরা এত দিনে অভ্যস্ত হইয়াছেন। এবং এই সকল আইনি পথের বাহিরে রহিয়াছে ডিজিটাল দুনিয়ায় ‘ট্রোলিং’। টুনটুনির প্রাণ লইয়া টানাটানি দেখিলে প্রশ্ন উঠিবে— রাজার নাকটি সুরক্ষিত আছে তো? ক্ষুদ্রের সহিত বৃহতের অসম যুদ্ধ দেখিলে সর্বসাধারণের মনে এই প্রশ্ন উঠিতে বাধ্য। দুষ্কৃতীদের সংযত করিতে প্রশাসনিক কর্তাদের উপর যে অপরিমিত ক্ষমতা রাষ্ট্র ন্যস্ত করিয়াছে, সমালোচকদের চুপ করাইতে কি তাহার প্রয়োগ হইবার কথা? আইনভঙ্গে অভিযুক্তদের কার্যকলাপে নিরপেক্ষ তদন্ত করা, এবং সাক্ষ্যপ্রমাণের দ্বারা আদালতে তাহাদের দোষ প্রমাণ করা, ইহাই প্রশাসনের কর্তব্য। সংবাদসংস্থা-সহ কোনও প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিই প্রশাসনের অনুসন্ধানী দৃষ্টির ঊর্ধ্বে নহে। কিন্তু গত কয় বৎসরে দেখা গিয়াছে, কেবল সমালোচক সাংবাদিকই আয়করের অনুসন্ধানের মুখে পড়িয়াছেন। সেই সংস্থাগুলিরই অনুদান এবং বিজ্ঞাপন নানা কারণে রুদ্ধ হইয়াছে, নানা কঠিন ধারায় সম্পাদক ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হইয়াছে। আগাম জামিন লইয়া যাঁহারা কারাবাস এড়াইতেছেন, সেই সাংবাদিকদের প্রায় সকলেই কেন্দ্র তথা শাসক দলের সমালোচক।

রাজনৈতিক বিরোধীদের ক্ষেত্রেও একই নকশা গত সাত বছরে স্পষ্ট। নির্বাচনের পূর্বে বিপক্ষ নেতাদের দুর্নীতির মামলা লইয়া শোরগোল, সিবিআই, ইডি, আয়করের তদন্ত ও ধরপাকড়, নির্বাচন মিটিলেই বিস্মৃতি। মনে হয় যেন ইডি, আয়কর দফতর হইল জমিদারের লেঠেলবাহিনী। ভীতিপ্রদর্শনই যদি আইনপ্রয়োগের উদ্দেশ্য হয়, ‘আইনের শাসন’ ধারণাটিই তাহাতে লঘু হইয়া যায়। আইন মানিবার বদলে প্রভাবশালীর আনুগত্যই অধিক গুরুত্বপূর্ণ হইয়া ওঠে। রাষ্ট্রের সম্মান তাহাতে কমিতে থাকে, নেতাও পরিহাসের লক্ষ্য হইয়া ওঠেন। পাজামার দড়ির গিঁট কাটিতে সোনার তরবারি বাহির করিলে ভয়ের চাহিতে হাসির উদ্রেক হয় অধিক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Social Media Narendra Modi BJP
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE