E-Paper

আত্মানং বিদ্ধি

সঙ্ঘের কর্ণধার গোলওয়ালকর অকপটে বলেছিলেন, ভারতের হিন্দুরা কোনও দিন ত্রিবর্ণ পতাকা মানবেন না।

শেষ আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০২৫ ০৭:৩২

শারদোৎসবের মধ্যেই আর এক উৎসব সমাগত, ২৭ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে। এ বছর আরএসএস শতবর্ষের অনতিকাল পরই এল বিজয়াদশমী— আরএসএস-এর প্রতিষ্ঠাতিথি। উল্লেখ্য, এগারো বছর আগে প্রথম বার প্রধানমন্ত্রী হয়েই বিজয়াদশমীর দিনটিতে নরেন্দ্র মোদী জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন, এবং মঞ্চালোক ভাগ করে নেন বর্তমান সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবতের সঙ্গে। বিষয়টি সে দিনও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল, কেননা তদবধি বিজেপি-আরএসএস পরস্পর দূরত্ব রেখে চলাতেই ছিল বিশ্বাসী। তখন পর্যন্ত আরএসএস প্রকাশ্য রাজনৈতিক মঞ্চের পরিবর্তে প্রচ্ছন্ন সমাজভূমিকাতেই নিরত ছিল। এগারো বছর পর, শতবর্ষ পূর্তির ক্ষণে প্রধানমন্ত্রী ও সঙ্ঘের একযোগে পঞ্চ প্রতিজ্ঞা ঘোষণা, এবং প্রথম বার ভারতের অবয়ব-খোদিত নতুন মুদ্রা প্রকাশ দেখে এই অভিযাত্রাটির অর্থ সম্যক ভাবে পরিস্ফুট হতে পারে। একশো বছর পর অবশেষে সঙ্ঘ তার অভীষ্টে উত্তীর্ণ— অখণ্ড হিন্দু ভারতের রাষ্ট্রীয় আলোকবর্তিকা হয়ে ওঠার জন্যই ছিল তার এত দিনের সমাজ-সংস্কৃতির তন্নিষ্ঠ কর্মকাণ্ড। সে দিক দিয়ে, এ এক ঐতিহাসিক সাফল্যের মুহূর্ত।

যাত্রাপথটি ছিল অমসৃণ, সংঘর্ষতপ্ত। পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ-ভজনার দায় থেকে হিন্দু-মুসলমান দ্বিজাতিতত্ত্বে বিশ্বাস, কিংবা গান্ধী-বিদ্বেষ ও গান্ধী নিধন— সবই এই প্রতিষ্ঠানের জাতীয় মর্যাদা পাওয়ার রাস্তা রোধ করে দাঁড়ায়। স্বাধীন দেশে অন্তত তিন বার নিষেধাজ্ঞা জারি হয় এই প্রতিষ্ঠানের উপর— গান্ধীহত্যার পর, জরুরি অবস্থার সময়, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর। তবুও হিন্দু ভারতের অস্মিতার রাজনীতিতে ভর দিয়ে একশো বছরে এসে আরএসএস এখন আকারে প্রকারে বিশাল, প্রচারে বিপুল, সামাজিক-রাজনৈতিক গুরুত্বে দুর্দমনীয়। তবু, আরএসএস শতবর্ষ একটি গুরুতর প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। যে সংগঠন নিজের ইতিহাসকে নিজেই মুছে ফেলতে তৎপর ও বদ্ধপরিকর, তার পক্ষে কি সত্যিই আত্মশক্তি ও আত্মমর্যাদা অটল ভাবে ধরে রাখা সম্ভব?

প্রশ্নটি আসে ইতিহাসবিকৃতির অভ্যাস থেকে। বর্তমান উত্তর-সত্য যুগেও তথ্য ও ঐতিহাসিক সত্য অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়নি। তাই শতবর্ষ উপলক্ষে ভারতীয় সমাজের সকল স্তরে আত্মমর্যাদা প্রসারের বার্তা শুনে মনে পড়ে আরএসএস-এর মূলগত চতুর্বর্ণাশ্রম মান্যতা, ব্রাহ্মণ্যবাদের শ্রেষ্ঠতায় বিশ্বাসের কথা, এবং বোঝা যায় না এই দুই মতবাদের সঙ্গতি। সাভারকর-কথিত হিন্দু-মুসলমান দ্বিজাতিতত্ত্বের সঙ্গে তাল রেখে ‘এক ও অখণ্ড ভারত’-এ যে অহিন্দুদের স্থান নেই, তাঁরা তা স্পষ্ট করে বলেন না। নেতাদের দাবির সঙ্গে কিছুমাত্র মেলানো যায় না আরএসএস বিষয়ে গান্ধীজি, নেতাজি, আম্বেডকর, এমনকি বল্লভভাই পটেলের লিখিত ও উচ্চারিত নিন্দাসূচক বক্তব্যসমূহ। ভারতের স্বাধীনতায় আরএসএস অবদান বিষয়ে আজকের বিজেপি-আরএসএস যা বলে, তা মেলে না ঐতিহাসিক তথ্যের সঙ্গে। সাভারকরের ব্রিটিশসমর্থনের মুচলেকা দিয়ে জেলমুক্ত হওয়ার ঘটনাটি ঐতিহাসিক, একই রকম ঐতিহাসিক হিন্দু মহাসভার শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ১৯৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনে আদ্যন্ত বিরোধিতা। এও প্রমাণিত, সঙ্ঘের কর্ণধার গোলওয়ালকর অকপটে বলেছিলেন, ভারতের হিন্দুরা কোনও দিন ত্রিবর্ণ পতাকা মানবেন না। আজ বিপুল ব্যয়ে পটেলের মূর্তি নির্মিত হয়, অথচ পটেল সঙ্ঘকে বিষাক্ত বলেছিলেন, স্বাধীন ভারতে সঙ্ঘের উপর প্রথম নিষেধাজ্ঞাও তিনিই জারি করেন। ইতিহাসের যাত্রায় স্বর্ণালী স্বাক্ষর রাখতে হলে কিন্তু ইতিহাসকে অবজ্ঞা করে, বিকৃত করে সে কাজ করা যায় না, বরং সম্পূর্ণ আত্মস্বীকৃতির পথে হাঁটতে হয়। দেশবাসীকে আত্মসচেতনতার পাঠ দেওয়ার আগে শতবর্ষী সংগঠন নিজেই সেই পথে অগ্রসর হোক।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

RSS Rashtriya Swayamsevak Sangh

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy