মোহন ভাগবত মহাশয় ব্যস্ত মানুষ, বিশেষত এই মুহূর্তে তাঁর ব্যস্ততা তুঙ্গে। সঙ্ঘের শতবর্ষ পূর্তির ক্ষণ সমীপবর্তী। অনুষ্ঠান-উদ্যাপন উদ্যোগে, পরিকল্পনার নির্মাণে, বাস্তবিকই তাঁর অনেক কাজ। তার উপর বিষফোড়ার মতো রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের আসন্ন নির্বাচন। ফলত রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের উদ্যাপনের সঙ্গে সন্তর্পণে ও সুকৌশলে জড়িয়ে নিতে হচ্ছে বঙ্গবিজয়-অভিমুখী কর্মসূচিকেও। সেই কর্মসূচির মধ্যে লাঠ্যৌষধি, হুজ্জতি-হুমকি ঔষধির অধিকার প্রধানত অধিকারী মহাশয়দের। আর, প্রধান সরসঙ্ঘচালক হিসাবে মোহন ভাগবতের কাজ ভিন্ন মার্গের— দিগ্দর্শন ও দর্শন উচ্চারণের। আপাতত বঙ্গসমাজকে সঙ্গে পাওয়ার আত্যন্তিক বাসনায় তাঁর সিদ্ধান্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অঙ্গনটিকেই ভর করা। তাঁর বাণী: রবীন্দ্রনাথের ‘স্বদেশী সমাজ’ লেখা পড়ে বাঙালির তদনুসারে চলা দরকার। সেইমতো স্থানীয় ভিত্তিতে সমাজ গড়া দরকার। স্থানীয় নেতৃত্বের উপর ভর করা দরকার। এ দেশের ‘গ্রামে অলিতে গলিতে’ এমন নায়কের প্রয়োজন রয়েছে— আগে নাকি রবীন্দ্রনাথ বলে গিয়েছেন, এখন মোহন ভাগবত বলছেন। প্রশ্ন হল, দুই জনেই কি এক প্রকার নায়কের কথা বলছেন? ব্যস্ত মানুষ ভাগবত বিলক্ষণ জানেন, এখনই দরকার, জরুরি দরকার, স্থানীয় হিন্দুত্ববাদী নায়কদের, না হলে তাঁদের নির্বাচনী নৌকাটি তীরে ভিড়ানো অসম্ভব। তাই নায়কের সন্ধানে নেমে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে টানাটানি। তাঁর এই বাণীর সামনে বাঙালি রাজনৈতিক ভাবে কী করবে, জানা নেই। তবে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ঈপ্সিত নায়কের প্রতি ভাগবতীয় আহ্বান শুনে কী করতেন, সেটা ভেবে নিয়ে বাঙালির প্রাথমিক কিছু কর্তব্য পালন না করলেই নয়। সেই কর্তব্যের প্রথমেই আসে— মোহন ভাগবতের উদ্দেশে কিছু পাল্টা বাণী উচ্চারণ।
রবীন্দ্রনাথের আত্মশক্তি নামে বইয়ের অন্তর্ভুক্ত ‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধটির ইংরেজি অনুবাদ সহজলভ্য। ভাগবত মহাশয় নিজে পড়ার সময় পেয়েছেন কি না জানা নেই, পড়লে জানতে পারতেন ওই প্রবন্ধেরই আরও কিছু অতি জরুরি অংশ। জানতে পারতেন, কেবল স্থানীয় নেতৃত্বের উপর ভর করার কথাই সেখানে বলেননি রবীন্দ্রনাথ, ভারতবর্ষীয় সমাজের গতিমুখটি যেন সেই নেতা বা নায়করা রাখতে পারেন, সেটাও বলেছিলেন। কী সেই গতিমুখ? “হিন্দু বৌদ্ধ মুসলমান খ্রীস্টান— সকলেই ভারতবর্ষে আসিয়া মিলিয়াছে। বিধাতা যেন একটা বৃহৎ সামাজিক সম্মিলনের জন্য ভারতবর্ষেই একটা বড়ো রাসায়নিক কারখানা খুলিয়াছেন।” ভাগবত-চালিত সঙ্ঘের মতো সম্প্রদায়কে মাথায় রেখেই বলেছিলেন যে “আমাদের দেশে সাধারণের মধ্যে নানা স্থানে ধর্ম ও আচার লইয়া যে-সকল ভাঙাগড়া চলিতেছে শিক্ষিত সম্প্রদায় তাহার কোনো খবর রাখেন না। যদি রাখিতেন তো দেখিতেন, ভিতরে ভিতরে এই সামঞ্জস্য-সাধনের সজীব প্রক্রিয়া বন্ধ হয় নাই।” প্রসঙ্গত, ‘স্বদেশী সমাজ প্রবন্ধের পরিশিষ্ট’ বলে আর একটি প্রবন্ধ, ওই একই আত্মশক্তি শীর্ষক গ্রন্থে যা সঙ্কলিত— ইংরেজি অনুবাদেও লভ্য হওয়ার কথা— সেখানে রবীন্দ্রনাথ আরও স্পষ্ট করলেন: “মুসলমান সমাজ আমাদের এক পাড়াতেই আছে, খ্রীস্টান সমাজ আমাদের সমাজের উপর বন্যার মতো ধাক্কা দিতেছে। প্রাচীন শাস্ত্রকারদের সময়ে এ সমস্যাটা ছিল না। যদি থাকিত, তবে তাঁহারা হিন্দুসমাজের সহিত এই সমস্ত পরসমাজের অধিকার নির্ণয় করিতেন, এমন ভাবে করিতেন যাহাতে পরস্পরের মধ্যে নিয়ত বিরোধ ঘটিত না।” ভাগবতকে প্রশ্ন: ‘পরসমাজের’ সঙ্গে সম্পর্কটি তাঁরা কেমন ভাবে নির্ণয় করছেন যাতে গোটা দেশে এখন ‘বিরোধ’ নিয়ত পরিব্যাপ্ত হয়ে উঠেছে?
মুশকিল হল, একশো একুশ বছর আগে, ১৯০৪ সালে ‘স্বদেশী সমাজ’ লেখার সময়ে লেখক ততখানি বোঝেননি যে ‘স্বদেশী সমাজ’-এর ভবিষ্যৎটি কেমন হতে পারে। এই রাসায়নিক কারখানার দখল ‘অন্য’ হাতে চলে গেলে রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়া ঘটিয়ে, ‘সামঞ্জস্য’-র ভিতরে আণবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তাকে বিচূর্ণ করে, তার জায়গায় বিদ্বেষ বিভাজনের তিক্ত-যৌগ উৎপাদন করে, তাকে ঔষধ হিসাবে কেমনধারা বণ্টন-সেবন চলবে দেশ জুড়ে। লেখক এও ভাবতে পারেননি যে তাঁর সম্পূর্ণ বিপরীত মতাদর্শমথিত কথাগুলিকে এই ভাবে গ্রাস করতে আসবেন সেই ‘বিরোধ’-বণ্টনকারীরা। সুতরাং, আজ লেখকের অবর্তমানে, যে বাঙালি সমাজ এই লেখকের লেখায়-ভাবনায় কিছুমাত্র উপকৃত— তার দায়িত্ব হওয়া উচিত, তিনি যা বলেছিলেন সে কথাগুলিকে বিকৃত বা বিধ্বস্ত না হতে দেওয়া।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)