E-Paper

‘মেয়ে পুলিশ’ সঙ্কট

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক আইনরক্ষক বাহিনীতে ৩৩% মহিলা-পুলিশের অন্তর্ভুক্তিতে জোর দিলেও, ২০২৩-এর সমীক্ষা অনুযায়ী তা মাত্র ১২.৫%। আরও উদ্বেগজনক, শীর্ষ পদে আসীন মহিলা একেবারেই আণুবীক্ষণিক।

শেষ আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৭:২৩

মেয়ে-পুলিশ ধারণাটি সম্পর্কে সমাজ এখনও কী পরিমাণ শুচিবায়ুগ্রস্ত এবং তার জন্য দায়ী পুরুষতন্ত্রের কুবুদ্ধিটি যে কীভাবে আইনরক্ষকদের কাজেও প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে, তার জ্বলন্ত সাক্ষ্য বইছে কলকাতার থানাগুলি। মহিলা-থানা বাদে শহরের যে ৭৯টি থানা আছে, তার একটিতেও কোনও মহিলা ইনস্পেকটরকে ওসি-র দায়িত্বে দেওয়া হয়নি, এর মধ্যে মাত্র একটি থানাতে অ্যাডিশনাল ওসি পদে মহিলা রয়েছেন। ন’টি মহিলা থানায় ওসি থাকলেও সেগুলিতে কোনও অ্যাডিশনাল ওসি নেই। যোগ্যতা দেখিয়ে সম-র‌্যাঙ্কে পদোন্নতির পরেও, গুরুত্ব ও কাজের বণ্টনের ক্ষেত্রে এই লিঙ্গ ভেদাভেদ অন্যায্য, অসম্মানজনক, অনভিপ্রেত। এই আচরণ স্পষ্টতই পুরুষতান্ত্রিক— যেখানে পুলিশের কাজ পেশিশক্তি ও ক্ষমতার প্রতীক হিসাবে চিহ্নিত, ফলে মেয়েদের ‘ওরা তো দুর্বল, আবেগ দেখিয়ে ফেলবে’ বলার ছলে শুধু ‘মহিলাসংক্রান্ত’ কাজকর্মের মধ্যেই আটকে দেওয়ার চেষ্টা চলে। সর্বজনীন পরিষেবায় তাঁদের কর্তৃত্ব ও সেখানে তাঁদের হাতে ক্ষমতার দণ্ডটি দেখতে এবং সেই ক্ষমতাতলে অধস্তন রূপে কাজ করতে এই সমাজ চূড়ান্ত অনিচ্ছুক। সেই মনোভাব পুলিশবাহিনীতে আরও কট্টর, সেখানে চিরকালই জারি পক্ষপাতিত্ব, মেয়েদের নিম্নপদে রাখাই দস্তুর।

বঞ্চনার এই চিত্র ছেয়ে আছে গোটা দেশে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক আইনরক্ষক বাহিনীতে ৩৩% মহিলা-পুলিশের অন্তর্ভুক্তিতে জোর দিলেও, ২০২৩-এর সমীক্ষা অনুযায়ী তা মাত্র ১২.৫%। আরও উদ্বেগজনক, শীর্ষ পদে আসীন মহিলা একেবারেই আণুবীক্ষণিক। চোট-আঘাত লাগবে, দীর্ঘ সময়ের কাজ কী করে করবে, রাতে বিপদ হবে, শৌচালয় ও বিশ্রামকক্ষের অভাব— এই সব নিরাপত্তা সংক্রান্ত অজুহাত খাড়া করে নারীশক্তির পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা হয় না। সদ্ব্যবহারের ইচ্ছাটুকুও থাকলে মেয়েদের কাজ করার উপযুক্ত পরিবেশ ও পরিকাঠামো গড়তে এমন ঔদাসীন্য থাকত না। আর আছে পুরুষ সহকর্মীদের অসহযোগিতা, কখনও কখনও যা গড়ায় হেনস্থা পর্যন্ত। এ সকলই মেয়ে-পুলিশের সংখ্যায়, উদ্যমে ভাটা এনেছে। এই সব কারণেই সন্ধ্যার পর, যখন সংবেদনশীল অপরাধ বা নারীর বিরুদ্ধে আক্রমণ বেশি, তখনই মহিলা থানায় কর্মী ও সাধারণ থানায় মহিলা কর্মী দুয়েরই ব্যবস্থা রাখা যায় না। পুলিশের আচরণ যাঁরা অসংবেদনশীল বলে অভিযোগ করেন, তাঁরা হয়তো মহিলা দেখলে ভরসা পেতেন। তার অভাবে বহু অপরাধ নথিভুক্ত হয় না বা তদন্ত মাঝপথে থেমে যায়।

মেয়েদের উপর এই অনাস্থা, অবিচার প্রশাসনের অতি-গভীরে চারিয়ে যাওয়া মহিলা বিদ্বেষকে বেআব্রু করে। দেশে মেয়েদের উপর বেড়ে চলা হিংসাকে রোধ করতে পর্যাপ্ত মহিলা পুলিশের উপস্থিতি ও সক্রিয়তার বার্তা দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। তবে, শুধুই একঘেয়ে কোনও কাজে মেয়েদের ঠেলে দিলে চলবে না। অন্যান্য দেশেও দেখা গিয়েছে যে, শুধু নারীসংক্রান্ত ক্ষেত্র নয়, পুলিশের সব রকম কর্তব্যই মেয়েরা শক্তি, বুদ্ধি, সাহস ও কৌশলের পরিচয় দিয়ে পালনে সক্ষম। তাই, সামগ্রিক পুলিশব্যবস্থার স্বাস্থ্য মজবুত রাখতেও তাঁরা অপরিহার্য। এই সাম্য ও শক্তি আনতে মন্ত্রকের তরফে বিশেষ নির্দেশ, অনুমোদন এবং প্রয়োজনে প্রচলিত পুলিশব্যবস্থার সংস্কারের কথাও ভাবতে হবে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

police Women Empowerment

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy