E-Paper

ফাঁকা মাঠে

উড়ান-নিয়ামক সংস্থা ডিজিসিএ, কেন্দ্রীয় সরকার, আদালত— সবার হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি এখন কিছুটা স্বাভাবিক, কিন্তু যাত্রীদের যে ভোগান্তি ও ক্ষতি হল, টিকিটের মূল্য ফেরত ও ক্ষতিপূরণেই কি তার ইতি?

শেষ আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৬:০২

এক দিনেই যদি সারা দেশে একটি বিমান সংস্থার প্রায় ১৬০০ উড়ান বাতিল হয়, তা থেকেই বোঝা যেতে পারে পরিস্থিতি কত গুরুতর, সমস্যা কত গভীর। বিমানযাত্রীদের ভোগান্তি কোন পর্যায়ে পৌঁছতে পারে সেও খালি চোখেই দেখা গেছে— দেশ জুড়ে নানা বিমানবন্দরে হাজার হাজার যাত্রীর চিন্তিত, ক্লান্ত, ক্ষুব্ধ মুখ। বেসরকারি ভারতীয় বিমান সংস্থা ইন্ডিগো-র একের পর এক উড়ান বাতিল হয়েছে এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে; অগণিত বিমানযাত্রী জরুরি কাজ, চিকিৎসার অ্যাপয়েন্টমেন্ট, চাকরির ইন্টারভিউ, পারিবারিক অনুষ্ঠান ধরতে পারেননি— এমনকি লোকসভার কাজ শেষে সাংসদও ফিরতে পারেননি নিজের রাজ্যে। সুযোগ বুঝে অন্য বিমান সংস্থার টিকিটের দাম হয়েছে আকাশছোঁয়া। উড়ান-নিয়ামক সংস্থা ডিজিসিএ, কেন্দ্রীয় সরকার, আদালত— সবার হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি এখন কিছুটা স্বাভাবিক, কিন্তু যাত্রীদের যে ভোগান্তি ও ক্ষতি হল, টিকিটের মূল্য ফেরত ও ক্ষতিপূরণেই কি তার ইতি?

এত দিনে স্পষ্ট, নিয়ম না মানার ফলেই এই পরিস্থিতি। ডিজিসিএ পাইলট ও বিমানকর্মীদের সর্বাধিক কাজ ও পর্যাপ্ত বিশ্রামের সময় বেঁধে দিয়ে নির্দেশিকা জারি করেছিল, এই বিধি মানতে গিয়ে ইন্ডিগো যথেষ্ট সংখ্যায় পাইলট ও বিমানকর্মীর ব্যবস্থা করে উঠতে পারেনি। তারই জেরে দেশ জুড়ে তাদের উড়ান বাতিল হওয়া শুরু হয়। ভারতের অভ্যন্তরীণ বিমান চলাচলের ৬০ শতাংশই যে বেসরকারি বিমান সংস্থার হাতে, তারা উড়ান বাতিল করলে পরিস্থিতি কী হতে পারে সহজেই অনুমেয়— এ আসলে ‘মার্কেট’ ও ‘মোনোপলি’, বাজার এবং একচেটিয়া কারবার/কারবারির সোজা হিসাব। তলিয়ে দেখলে মালুম হবে, সাম্প্রতিক অতীতে ভারতে উড়ান-পরিষেবা বাজারে ইন্ডিগোর উত্তরোত্তর উত্থান যেখানে অপ্রতিদ্বন্দ্বী, সেখানে তার নিকটতম ‘প্রতিযোগী’ এয়ার ইন্ডিয়া-কে বাঁচাতে প্রয়োজন পড়েছে অন্য বেসরকারি সংস্থার, বাকি বেশ কয়েকটি বিমান সংস্থা হয় বন্ধ নয়তো ক্ষীণবল। এ-হেন বাজার-পরিস্থিতিতে ইন্ডিগোর অবস্থা প্রায় ফাঁকা মাঠে গোল করার মতো, এবং ডিজিসিএ-র জারি করা নির্দেশিকা মেনে চলার ক্ষেত্রে তাদের যে গা-ছাড়া ভাবের জেরে সাম্প্রতিক পরিস্থিতি উদ্ভূত, সে-ও ওই একচেটিয়া বাণিজ্য-প্রভাবেরই কুফল, বললে ভুল হবে কি? সংসদেও বিরোধী দলগুলি এই প্রশ্নই তুলেছে: নরেন্দ্র মোদী সরকারের জমানায় সর্বক্ষেত্রে যে ‘মোনোপলি মডেল’, বিমান পরিষেবাও তার ব্যতিক্রম নয়; তার পরিণতিও দৃশ্যমান।

শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীর উপস্থিতি, স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা বাজার ও বৃহত্তর অর্থে দেশের অর্থব্যবস্থার পক্ষে যে কত প্রয়োজনীয়, অর্থনীতির বিশেষজ্ঞরা তা বারে বারে বলে থাকেন। অন্য দিকে, বাজারে একচ্ছত্র প্রভাবশালীকে রাষ্ট্রও অধিকাংশ সময়ই চটায় না। ইন্ডিগো-বিভ্রাটের গোড়ার দিকে সংস্থাটি বিমান মন্ত্রক তথা সরকারের কাছে আবেদন করেছিল, যাতে ডিজিসিএ-র নির্দেশিকায় ছাড় দেওয়া হয়। বিমানমন্ত্রী তাতে রাজি হননি, হাতে যথেষ্ট সময় পেয়েও সংস্থাটি কেন বাড়তি বিমানচালক ও কর্মী নিয়োগ করেনি, এ নিয়ে তাঁর ক্ষোভ ছিল। কিন্তু অচিরেই মাঠে দেখা গেল খোদ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে, বিমানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর আলোচনার পরেই ডিজিসিএ-র নির্দেশিকায় অনেকটা ছাড়ও দেওয়া হল। যতই বলা হোক এই পদক্ষেপ পরিস্থিতির স্বার্থে, আসলে কি তা এক প্রভাবশালী সংস্থার সামনে সরকারের ঢোক গেলার নামান্তর নয়? দেশ জুড়ে যাত্রী-দুর্ভোগের জেরে যেখানে ইন্ডিগোর বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক পদক্ষেপ করা জরুরি ছিল, তার বদলে ডিজিসিএ-র নির্দেশিকার ন্যূনতম প্রত্যাহারে কি সরকারেরই অসহায়, লজ্জাজনক মুখটি বেরিয়ে পড়ল না? ইন্ডিগোর শীতকালীন উড়ান-পরিকল্পনায় সরকার ১০% ‘ফ্লাইট কাট’-এর যে শাস্তি দিয়েছে, অঙ্কের হিসাবে তা সংস্থার কেশাগ্র স্পর্শও নয়। ফাঁকা মাঠে স্রেফ গোল করা-ই নয়, যা-খুশি করার পরিস্থিতিটি পাল্টাল না।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

IndiGo dgca

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy