একটি রাজ্যে যেখানে একটি নির্বাচিত সরকার রয়েছে, যেখানে নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণাধীন, যেখানে স্বাভাবিক প্রাদেশিক সরকার গঠনের অন্য কোনও বাধা নেই, সেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের তত্ত্বাবধায়কের অধীনে রাজ্যচালনা চলছে— ভারতীয় গণতন্ত্রের বর্তমান চরিত্র বিষয়ে কী বলে এই ঘটনা? জম্মু ও কাশ্মীর নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে অনেক কথাবার্তা হয়েছে, কিন্তু কিসে কী, অমিত শাহের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক এখনও একটি বাক্যও ব্যয় করেনি কাশ্মীরের প্রাদেশিক শাসন ফিরিয়ে আনার বিষয়ে। ২০১৯ সালের ৫ অগস্টের ৩৭০ ধারা বিলোপের সময় কিন্তু ইউনিয়ন টেরিটরি বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল এখানে কোনও স্থায়ী ব্যবস্থা হিসাবে জারি হয়নি, অন্তর্বর্তিকালীন হিসাবেই সেই পর্ব শুরু হয়েছিল। তার পর থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী ও উচ্চপদস্থ কর্তারা যেটুকু যা বলেছেন এ বিষয়ে, তার মর্মার্থ— এই অঞ্চল নিয়ে ভাবার কিছু নেই, সব স্বাভাবিক, উন্নয়নের সব রাস্তায় কাজ চলছে। প্রথমত, তা-ই যদি হয়, তা হলে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করে রাখার প্রয়োজন কী, তা বোঝা দুষ্কর। দ্বিতীয়ত, এই দাবি যে অতিরেক দোষে দুষ্ট, পহেলগাম ঘটনাই তার প্রমাণ। প্রশ্ন হল, কেন্দ্রীয় শাসনে থেকেও যদি এই শতকের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাস হানা দেখে কাশ্মীর, তা হলে তো নির্বাচিত প্রাদেশিক সরকার ফিরিয়ে আনার বিপক্ষে কোনওই যুক্তি থাকতে পারে না। বাস্তবিক, প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দুই জনেই বিস্ময়কর ভাবে দেশের এই মুহূর্তের দু’টি প্রধানতম সমস্যা নিয়ে মুখই খোলেন না— এক, কাশ্মীর, দুই, মণিপুর। যে বিষয়ে তাঁদের অবস্থান ও দ্রুত পদক্ষেপ সবচেয়ে জরুরি, তার থেকে মুখ ফিরিয়ে তাঁরা আপাতত অনুু্প্রবেশকারী বিতাড়ন ও ভোটার তালিকা সংশোধন নামক দ্বিমুখী ভোটপ্রচারযজ্ঞে ব্যস্ত। তাঁদের কেবল মনে করিয়ে দিতে হয়, কাশ্মীর বা মণিপুরের সমস্যা কেবল কোনও সাংবিধানিক বা প্রশাসনিক সমস্যা নয়, আগণিত মানুষের জীবনযাপন, সুরক্ষিত ও সুস্থ সমাজজীবনের বিষয়। তাঁরা কোনও যুক্তিতেই এই দু’টি বিষয় থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারেন না, থাকলে তা হয়ে দাঁড়ায় বড় মাপের রাজনৈতিক দায়িত্বস্খলন।
আরও এক জনের বিষয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ রয়েছে এ প্রসঙ্গে— তিনি ওমর আবদুল্লা। কাশ্মীরের মানুষ নির্বাচনের মাধ্যমে তাঁকে প্রধান নেতা পদে বসিয়েছেন, ফলে স্বাধিকার-বলে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তাঁরই দায়িত্ব ছিল, এ নিয়ে কেন্দ্রের সঙ্গে বোঝাপড়া করা। অথচ তিনি মাঝেমধ্যে কথাটি তোলেন— ক্ষীণ, দ্বিধাজড়িত ভঙ্গিতে, তার পর আবার নীরবতায় নিমজ্জিত হন। সবচেয়ে কড়া কথা তিনি যা উচ্চারণ করেছেন, তার বয়ানটি এই রকম: ‘নির্বাচিত বিধানসভা নিয়ে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল— গণতান্ত্রিক দেশচালনার অন্যতম অদক্ষ দৃষ্টান্ত।’ ‘অদক্ষ’ শব্দটির বদলে আর একটু কড়া ভাবে তিনি বলতেই পারতেন, আরও চাপ দিতেই পারতেন, দাবি করতেই পারতেন যে একাধারে সংসদ ও সুপ্রিম কোর্ট উভয়ের সামনেই নরেন্দ্র মোদী সরকার কাশ্মীরে রাজ্য-মর্যাদা বা ‘স্টেটহুড’ ফেরানোর যে প্রতিশ্রুতি করেছিল তা মেটানো এখনই আবশ্যিক। কিন্তু তা ঘটেনি। এই অকারণ— এবং খানিক দায়িত্বজ্ঞানরহিত— নমনীয়তা ও মধুরভাষণের প্রয়োজন হল কেন, তাতে একটি বড় জিজ্ঞাসাচিহ্ন দেওয়া ছাড়া উপায় নেই।
বাস্তবিক, কেন্দ্রীয় সরকার এই যে কাজটি করছে, তা কেবল অন্যায় নয়, বিপজ্জনক। গণতন্ত্রের দাবিদাওয়া আটকে রাখার ফল যে কত ভয়ানক হতে পারে, দেশ-বিদেশের তথাকথিত জেন-জ়ি বিদ্রোহ তা দেখিয়ে দিচ্ছে। লাদাখের ঘটনা বুঝিয়ে দিয়েছে, ভারতেও কোন স্তরে চলে যেতে পারে সাধারণ নাগরিক প্রতিবাদ। দমননীতি দিয়ে বারংবার নাগরিক প্রতিবাদ নিষ্পেষণের যে পদ্ধতি অবলম্বন করা, আর যা-ই হোক, গণতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র বা যুক্তরাষ্ট্রের নীতিসম্মত নয়। কাশ্মীরের রাজ্য-মর্যাদা আটকে রেখে কেন্দ্রীয় সরকার প্রকৃতপক্ষে গোটা দেশকেই বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)