এ বছর স্বাধীনতা দিবসের কয়েক দিন আগে দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর সমাজমাধ্যম ‘হ্যান্ডল’-টিতে একটি বার্তা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, তিনি জানতে আগ্রহী তাঁর স্বাধীনতা দিবসের বক্তৃতাটিতে কোন কোন বিষয়ের উপর তিনি আলোকপাত করলে প্রীত হবেন নাগরিকরা। অনেকে নিশ্চয় ইতিমধ্যে তাঁদের মত জানিয়েছেন। অনেকেই হয়তো জানাননি, জানাতে পারেননি। কিন্তু বাস্তবিক, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে এ বার সবচেয়ে বেশি যে কথাটি জানার ছিল তা হল, ভারতের মতো দেশে সাধারণ মানুষকে আকস্মিক ভাবে নাগরিকত্বের পরীক্ষায় ফেলে অপদস্থ করা কি এতই প্রয়োজনীয় ছিল? কথাটি গুরুত্বপূর্ণ, কেননা বহু দেশেই দেশবাসীকে নাগরিক অধিকার দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রেরই, প্রমাণপত্র যা কিছু, তাও নাগরিকের হাতে পৌঁছে দেওয়ার দায় রাষ্ট্রেরই। ‘ভারতের মতো দেশে’ কথাটিও এখানে আলাদা ভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কেননা এত বড় দেশের বহু স্থানে এখনও রাষ্ট্র ও সমাজের আদানপ্রদান যথেষ্ট ক্ষীণ, সাধারণ মানুষ এখনও দারিদ্রক্লিষ্ট, এবং বহুলাংশে অক্ষরজ্ঞানহীন, অধিকারচেতনা-রহিত। ফলে প্রমাণ দর্শানো এবং প্রমাণ আইনত সিদ্ধ দেখানোর ভারটি এই মানুষগুলির উপর পড়লে তা অগণতান্ত্রিক তো বটেই, অমানবিকও বলা যেতে পারে। ভোটার কার্ড দিয়ে ভোটদান এবং আধার কার্ডের মাধ্যমে রাষ্ট্রের কাছে প্রাপ্য সুযোগসুবিধা আহরণ, এই তাঁরা জানেন। এ দিকে এই মুহূর্তে দেশে এসআইআর বা নিবিড় ভোটতালিকা সংশোধনের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তাতে এই দুই পরিচিতিসূচক কাগজই নাকি পর্যাপ্ত নয়। তা ছাড়া এসআইআর-এ যাঁদের নাম বাদ গেল, তাঁরা যদি সেই সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে আদালতে যান, তার সময়ও না রেখেই পুরো প্রক্রিয়াটি পরিচালন করছে জাতীয় নির্বাচন কমিশন। প্রশ্ন হল, কিসের এত তাড়া, কোন অভিপ্রায়ে।
প্রশ্ন তোলা দরকার প্রমাণপত্রের চরিত্র নিয়েও। আধার কার্ড কত জরুরি, এত দিন ধরে বারংবার এই দাবি রাষ্ট্রের তরফে শোনা গিয়েছে। শোনা গিয়েছে এই আবশ্যিক পরিচিতিপত্র সকল কাজের জন্য ব্যবহারযোগ্য ‘ইউনিক আইডি’। সেই আধার-কে নাগরিকের পরিচিতির ক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল— সুপ্রিম কোর্টের গতকালের নির্দেশে আধারের ভিত্তিতে আবেদন মঞ্জুর হল। আবার ভোটার কার্ডের ভিত্তিতে ভোটদানের মাধ্যমে সরকার গঠন হয়, অথচ এখন সেই কার্ডকে গুরুত্বহীন বলা হয়েছে। বস্তুত, এসআইআর ভোটার তালিকার বিষয় অতিক্রম করে নাগরিকত্বের পরীক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে— যে প্রয়াস আগে দেখা গিয়েছে অসম প্রদেশে এনআরসি বা জাতীয় নাগরিকপঞ্জি নির্মাণ ও সিএএ বা নাগরিকতা (সংশোধনী) আইন পাশের সময়ে। তাতে এত ভ্রান্তি-বিভ্রান্তি তৈরি হয় যে বহু মামলা এখনও ট্রাইব্যুনালে এবং আদালতে, মীমাংসার অপেক্ষায়। দুঃসহ পরিস্থিতির মধ্যে আছেন অগণিত দরিদ্র হিন্দুমুসলমান মানুষ। এখনও রাষ্ট্রের চোখে তাঁদের পরিচিতির সুরাহা হয়নি। প্রবাদকে সত্য প্রমাণিত করে তস্কর বাছার কাজে উজাড় হতে বসেছে গ্রাম-শহর। এমতাবস্থায় অন্যান্য রাজ্যে কেন আবার একই প্রক্রিয়া চালু হল, নাগরিকের প্রশ্ন।
স্বাধীন ভারত নিজেকে হিন্দু রাষ্ট্র ঘোষণা করেনি, একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র বলেছিল। আজও সেই পরিচয়েই এই দেশ বিশ্বমাঝে সম্মানিত। ফলে এ দেশের সংখ্যালঘু মানুষ প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সরকারের কাছে প্রশ্ন রাখতেই পারেন, কেন বর্তমান ভারতে প্রতি পদে তাঁদের এই হেনস্থা, তাঁদের ধর্মপরিচয়ের কারণেই কি নাগরিক অধিকার তাঁদের প্রাপ্য নয়। খাদ্যাভ্যাস থেকে শুরু করে উপার্জন ও জীবনধারণের সমস্ত ক্ষেত্রে কেন এত বাধা ও বৈষম্য। এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারও কেন বৈষম্যকারীদের প্রশ্রয়দাতা। সব মিলিয়ে, এ বার স্বাধীনতা দিবসটি নাগরিকত্ব ও নাগরিক অধিকার বিষয়ক জ্বলন্ত প্রশ্নসমূহ নিয়ে এসেছে। প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সরকার শুনতে পাচ্ছেন কি না, সেটাই দেশের জিজ্ঞাসা।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)