Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Delhi

রাজধর্ম

ধর্মান্তরণের সভায় উপস্থিত থাকার জন্য রাজেন্দ্র ‘হিন্দু-বিরোধী’— সাংবাদিক সম্মেলন করে এই দাবি করেছে বিজেপি।

রাজেন্দ্র সিংহ গৌতম।

রাজেন্দ্র সিংহ গৌতম।

শেষ আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০২২ ০৬:২০
Share: Save:

কে মন্ত্রিত্ব পেল, কে হারাল, তা ঠিক করে রাজনীতির খেলা, নৈতিকতার সঙ্গে তার সংযোগ থাকে সামান্যই। ব্যতিক্রম অরবিন্দ কেজরীওয়ালের মন্ত্রিসভা থেকে দলিত নেতা রাজেন্দ্র সিংহ গৌতমের পদত্যাগ। এই প্রস্থান এক নৈতিক সঙ্কট হয়ে এসেছে ভারতের কাছে। যে কারণে তাঁকে পদত্যাগ করতে হল, তা সংবিধান-বিরোধী, হিন্দু ধর্মের বিরোধী, এবং সব অর্থেই সাধারণ বুদ্ধির বিরোধী। ঘটনাটি এই, অশোক বিজয়াদশমীতে এক জনসভায় প্রায় দশ হাজার নাগরিক বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন। সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রাজেন্দ্র সিংহ গৌতম। ধর্মান্তরণের সভায় উপস্থিত থাকার জন্য রাজেন্দ্র ‘হিন্দু-বিরোধী’— সাংবাদিক সম্মেলন করে এই দাবি করেছে বিজেপি। তাঁর পদত্যাগের দাবি করতে থাকেন বিজেপি নেতারা, কেজরীওয়াল উত্তর না দিয়ে নীরব হয়ে থাকেন। অবশেষে ‘আপ’ সরকার থেকে পদত্যাগ করে রাজেন্দ্র লিখলেন, এ হল তাঁর ‘মুক্তির দিন’। কিন্তু বিজেপি যে কঠিন বিদ্বেষ-বন্ধনে জড়াচ্ছে সমাজকে, তা থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় কী? নিজের ইচ্ছানুসারে ধর্ম গ্রহণ ও পালনের স্বাধীনতা সংবিধান সকলকে দিয়েছে। ভারতীয় সংবিধানের প্রধান রূপকার বাবাসাহেব ভীমরাও আম্বেডকর স্বয়ং ১৯৫৬ সালে বিজয়াদশমীর দিন বৌদ্ধ ধর্মে ধর্মান্তরিত হন। ভারতের পতাকায় আঁকা যার চক্রটি, সেই সম্রাট অশোক এই দিনটিতে হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন বলে মনে করা হয়। এই দিন স্বেচ্ছায়, নিজ আগ্রহে বৌদ্ধ ধর্ম যাঁরা গ্রহণ করছেন, বা যাঁরা উপস্থিত থেকে তাঁদের সম্মান দিচ্ছেন, তাঁরা ‘অ-হিন্দু’ হবেন কোন বিচারে? এই অসার আপত্তির প্রতিবাদ করা উচিত ছিল কেজরীওয়ালের, তাঁর নীরবতা নিন্দনীয়।

‘অ-হিন্দু’ কে, সে বিষয়ে বিজেপির যুক্তি হিন্দু ধর্ম, তথা ভারতীয় ঐতিহ্যের সম্পূর্ণ বিপরীত। ‘হিন্দু’ বা ‘ভারতীয়’ হওয়ার অর্থ কী, উনিশ ও বিশ শতকে তা নিয়ে বার বার আলোচনা হয়েছে। স্বাধীনতার যাঁরা রূপকার, তাঁরা বহুবিধ হিন্দু শাস্ত্র থেকে আহরিত এক মানবিক, উদার ধর্মবিশ্বাসকেই আধুনিক ভারতের উপযুক্ত বলে নির্ণয় করেছেন। ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন মতের শ্রদ্ধাপূর্ণ অনুশীলনকেই বরাবর উৎসাহ দেওয়া হয়েছে হিন্দু শাস্ত্রে। সেই সঙ্গে জোর দেওয়া হয়েছে যুক্তির চর্চায়। যোগবাশিষ্ঠ রামায়ণ-এর নির্দেশ, যুক্তিহীন কথা স্বয়ং ব্রহ্মা বললেও মানবে না। বিপরীত মতের সঙ্গে তর্কের মাধ্যমেই গড়ে উঠেছে হিন্দুদের প্রধান দর্শনগুলি। বেদান্ত ও ন্যায়ের সূত্র-ভাষ্য রচয়িতারা চিরকাল গভীর ভাবে বৌদ্ধ শাস্ত্রের চর্চা করেছেন। পরমত-অনুশীলন, নানা মতের সমন্বয় ভারতের সংস্কৃতির মূল কথা। বুদ্ধকে বিষ্ণুর অবতার বলে কল্পনা তারই পরিচয়।

ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন মতের প্রতি রাজধর্ম কী, তার নির্দেশ মেলে সম্রাট অশোকের শিলা-উৎকীর্ণ অনুশাসনে। সেখানে বলা হয়েছে, রাজা প্রিয়দর্শীর কাছে সকল ধর্মের বিকাশ সর্বাপেক্ষা মূল্যবান। তার উপায় বাকসংযম। নিজের ধর্মের অতিরিক্ত প্রশংসা না করা, অপরের ধর্মের নিন্দা না করা। অপরের ধর্মকে শ্রদ্ধা করলে নিজের ধর্মের উন্নতি হয়, সেই সঙ্গে অপর সকল ধর্মেরও। এ-ও মনে রাখা দরকার যে, ভারতের সংবিধানে যে উদার সাম্যবাদ বিধৃত রয়েছে, অন্তর থেকে তার গ্রহণ এবং সকল কাজে তার পালনও ধর্মাচরণ। অথচ, ভারতে হিন্দুত্বের প্রবক্তারা কেবলই অপর ধর্মাবলম্বীদের প্রতি বিদ্বেষের উদ্গীরণ করছেন। প্রকাশ্য জনসভায় কখনও অপর সম্প্রদায়ের প্রতি হিংসায় উস্কানি দিচ্ছেন, কখনও তাঁদের ব্যবসা, দোকান বয়কট করে তাঁদের ‘ভাতে মারতে’ ডাক দিচ্ছেন। কেন্দ্রের শাসক দল অশোকস্তম্ভের অতিকায়, কুদর্শন প্রতিকৃতি তৈরি না করে, অশোকের বাণীর প্রতি মনোযোগী হলে অশোক বিজয়াদশমীর দিনটি এমন কলঙ্কিত হত না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Delhi AAP resignation
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE