Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
earth

গ্রহ দর্শন

পৃথিবী, বিশ্ব, দুনিয়া, সব ক’টি শব্দই বড় বেশি মানুষকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে মানুষেরই হাতে।

শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০২২ ০৫:০৮
Share: Save:

এ বছরের বিশ্ব পরিবেশ দিবসটি আসার ঠিক কয়েক দিন আগেই রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব অান্তোনিয়ো গুতেরেস একটি সোজা-সরল কথা সপাটে বলে দিলেন। বললেন, ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ রিপোর্ট দেখিয়ে দিচ্ছে যে, বিশ্ব উষ্ণায়নের ধারা অব্যাহত— এই দশক-শেষের মধ্যে বিশ্বের তাপমাত্রার গড় ২.৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট বেড়ে যাওয়ার দিকে অপ্রতিহত গতিতে ধাবিত। এখানেও থামেননি মহাসচিব আন্তোনিয়ো গুতেরেস। কিছু দেশের প্রতিশ্রুতি না দেওয়া এবং কিছু দেশের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের অবাধ স্বাধীনতাই যে বাকি সব দেশের সব মানুষকে এই ভয়ানক ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে চলেছে— এটাও জানিয়ে দিয়েছেন। শুনতে শুনতে কারও মনে পড়তে পারে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক শীর্ষনেতার কথা— যাঁরা পরিবেশ নিয়ে দুশ্চিন্তা প্রকাশ করা, এবং নীতি প্রণয়ন করাকে এখনও বাড়াবাড়ি কিংবা বোকামি ভাবেন, এবং তার থেকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেন শর্টকাটে সস্তা ও বিপজ্জনক উন্নয়নের রাস্তায় হেঁটে জনমনোরঞ্জনী রাজনীতি করাকে। কোনও প্রেসিডেন্টকে এর মধ্যেও দেখা যায়, ইউক্রেনে যুদ্ধ বেধেছে দেখে নিজের দেশের রিজ়ার্ভ থেকে খনিজ তেলের সম্ভার খুলে দিচ্ছেন ইউরোপের জন্য। কোনও দেশের প্রধানমন্ত্রীকে দেখা যায় বলে দিতে যে, কয়লা বা জৈব-জ্বালানি ব্যবহার বন্ধের রাস্তায় এখন মোটেই হাঁটা যাবে না, যে যা-ই বলুক, কেননা তাতে ‘দেশের ক্ষতি’। কোনটা ক্ষমতাধিপতির স্বার্থ, আর কোনটা সত্যি করেই দেশের স্বার্থ, এবং কোনটা পৃথিবী নামক এই গ্রহের স্বার্থ— বেমালুম ভুলতে বসেছে সকলে।সত্যিই যদি কোনও কালে গ্রহান্তরের কোনও জীব পেনসিল হাতে গবেষণা করতে বসে, কেন পৃথিবীর এমন অকালমৃত্যু ঘটল— সম্ভবত তার উত্তরটি হবে: মানুষ নামক প্রাণীর রাজনীতি-নেশা। এমনই বিষম বস্তু এই ক্ষমতার রাজনীতি, অর্থগৃধ্নুতার রাজনীতি যে, অন্য কোনও দিকে তার মন দেওয়ার সময় কোথায়।ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দ্রুতবেগে সামনের দিকে ছুটেছিল পৃথিবীর দু’পেয়ে-রা: ভবিষ্যৎ গবেষণার সিদ্ধান্তে লেখা হতে চলেছে এটাই।

আমাদের মধ্যেও কেউ কেউ যে আপ্রাণ জোর দিয়ে এ কথা বলছেন না, তা তো নয়। কিন্তু ইতিহাসবিদ, দার্শনিক, বিজ্ঞানীদের সেই সব বক্তব্যের দিকে যথেষ্ট দৃষ্টিপাত করার সময় নেই আমাদের! কত জন জানি বা জানতে চাই যে, আজ চিন্তকসমাজের মধ্যে থেকে উঠে আসছে জগৎ-চরাচর বিষয়ে সম্পূর্ণ মৌলিক একটি পুনর্বিবেচনা, প্রায় এক নব্য সংশোধনবাদী বিশ্বদর্শন। সেই নব্য সংশোধনবাদের মূল কথা— এই পৃথিবীতে মানুষকে পাশে সরিয়ে রেখে মানুষ ভিন্ন অন্যান্য প্রাণ এবং জড় পদার্থ সম্বলিত পরিবেশকে ভাবনার কেন্দ্রে নিয়ে আসতে হবে, এখনই। অনেক বিলম্ব হয়েছে এ কাজে, আর নয়। এখনও যদি মানবকেন্দ্রিক বা অ্যানথ্রোপসেন্ট্রিক চিন্তার শৃঙ্খল ভেঙে বেরিয়ে বিকল্প চিন্তাদুনিয়া তৈরি না করি, প্রাণের বিলয় ও গ্রহের বিনাশ ঘটতে দেরি নেই।

ভাবতে গেলে, ‘পৃথিবী’ শব্দটিই হয়তো কিছু ভুল অর্থে গৃহীত ও চর্চিত হয়ে এসেছে এত কাল। পৃথিবী, বিশ্ব, দুনিয়া, সব ক’টি শব্দই বড় বেশি মানুষকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে মানুষেরই হাতে। শব্দগুলির প্রত্যক্ষ, প্রধান, এবং একমাত্র ব্যঞ্জনা থেকেছে মানব-অধিষ্ঠান, আর কিছু নয়। অথচ পৃথিবীর ‘বড়’ জীবনটিতে মানুষ তো কেবলই একটি ছোট, খুব ছোট, অংশমাত্র। মানুষের কাজকর্ম, ভুলভ্রান্তি, যুদ্ধ-ধ্বংস সব কিছুর বাইরে পৃথিবীর একটা অন্য হেতু ও অন্য অর্থ আছে, অন্য অভিপ্রায় আছে। এ কথার মধ্যে কোনও অধ্যাত্মবাদ নেই, বরং চাইলে একে ‘গ্রহবাদ’ বলা যেতে পারে। আর তাই, সৌরমণ্ডলের এই মানুষ-অধ্যুষিত অংশটিকে মানুষ যদি আজ থেকে তার একান্ত নিজের লীলাবিশ্ব না ভেবে ‘গ্রহ’ হিসাবে ভাবতে শুরু করে, আখেরে মঙ্গল হতে পারে। ইতিহাসবিদ দীপেশ চক্রবর্তী মনে করিয়েছেন যে, ‘গ্লোবালাইজ়েশন’ শব্দটির মধ্যে ‘গ্লোব’ বলতে যা বোঝায়, ‘গ্লোবাল ওয়ার্মিং’ শব্দটির মধ্যে ‘গ্লোব’ বলতে কিন্তু তার চেয়ে অনেক ভিন্ন কিছু, ব্যাপকতর কিছু, মৌলিকতর কিছু বোঝা জরুরি। ‘বিশ্বায়ন’-এর ‘বিশ্ব’ আর ‘বিশ্ব উষ্ণায়ন’-এর ‘বিশ্ব’ কি এক হতে পারে? আজ তাই ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি-র সীমানা পেরিয়ে প্ল্যানেটারি হিস্ট্রি-কে গুরুত্ব দিতে হবে। তবেই হয়তো উপলব্ধি করা যাবে, ব্যাকুল দ্রুতবেগে কোন অতলের দিকে ছুটছে এই গ্রহটি।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তেফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ

অন্য বিষয়গুলি:

earth Environment Climate Change
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE