শীর্ষ আদালতের এজলাসেই প্রধান বিচারপতির উদ্দেশে জুতো ছোড়ার ঘটনাটি নিতান্ত বিচ্ছিন্ন, এমন দাবি করার কোনও উপায় আজকের ভারতে নেই। যে আইনজীবী এই অপকর্মটি করেছেন, তিনি স্পষ্টই জানিয়েছেন যে, সনাতন ধর্মের কোনও অপমান তিনি সহ্য করবেন না, এবং এই দুষ্কর্মের জন্য তিনি আদৌ অনুতপ্ত নন। অমৃতকালের ভারতে এমন কথায় আর কেউ বিস্মিত হন না। গত দশ বছরে সমগ্র রাষ্ট্রযন্ত্র প্রশ্নাতীত ভাবে প্রতিষ্ঠা করেছে যে, সংবিধান-বর্ণিত ‘ধর্মনিরপেক্ষ ভারত’-এ ‘সনাতন ধর্ম’ অর্থাৎ হিন্দু ধর্মই মুখ্য। সত্যের খাতিরে বলতে হয়, এই অমৃতকালেই দেশের শীর্ষ আদালত মানুষের— অর্থাৎ হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষের— ‘ভাবাবেগ’কে মান্য করে অযোধ্যায় মন্দির বানানোর অনুমতি দিয়েছে; সেই মন্দিরের উদ্বোধনী পূজা করেছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং; এবং সে রাজ্যেই ধর্মীয় পোশাক পরে মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে বিরাজমান আরও এক জন। ভিন দেশ থেকে আগত হিন্দুদের ‘শরণার্থী’, এবং মুসলমানদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ হিসাবে চিহ্নিত করার জন্য আইন রূপায়িত হয়েছে এ দেশে। বিভিন্ন রাজ্যে সরকারি বুলডোজ়ার গুঁড়িয়ে দেয় সংখ্যালঘুদের বাড়ি, ধর্মস্থান; বহু শতাব্দীপ্রাচীন মোগল সম্রাটের সমাধিও বিতর্কের কেন্দ্রে চলে আসে। ভারত যে প্রকৃত অর্থ হিন্দুরাষ্ট্র, সে কথাটি জনমানসে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যেই। ফলে, সেই ধর্মের ‘অবমাননা’ হিন্দুত্ববাদী জনগণের কাছে ‘ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ’— এবং, সে অপরাধ যিনিই করে থাকুন, তাঁকে শাস্তি দেওয়ার অধিকার সাচ্চা সনাতনী হিন্দুর আছে। মহম্মদ আখলাককে যেমন ফ্রিজে গোমাংস রাখার সন্দেহে হত্যা করা চলে, ঠিক তেমনই হিন্দুরাষ্ট্রের পদাতিকরা বিশ্বাস করে যে, প্রধান বিচারপতিও তাদের শাস্তিবিধানের ঊর্ধ্বে নন। একে কি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বা ব্যক্তির মতিভ্রম বলে চালানো যায়?
ঠিক তেমনই, ভারতের বর্তমান প্রধান বিচারপতির জাতিগত পরিচয়টিও ভুললে চলবে না। এই অমৃতকালে ভারতে দলিত জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত মানুষের নিগ্রহ কার্যত স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। ঘোড়ায় চড়ে বিয়ে করতে যাওয়ার ‘অপরাধ’-এ প্রহার থেকে স্কুলে উচ্চবর্ণের ছাত্রদের জন্য নির্দিষ্ট পাত্র থেকে জল পান করায় নিগ্রহ, ঘটনার তালিকা দীর্ঘ। গত দশ দিনের মধ্যেই উত্তরপ্রদেশে উচ্চবর্ণের প্রহারে প্রাণ হারিয়েছেন হরিওম বাল্মীকি নামে এক দলিত, ধর্ষিতা হয়েছে এক দলিত নাবালিকা; লাগাতার হেনস্থা সহ্য করতে না পেরে দিল্লিতে আত্মঘাতী হয়েছেন পূরণ কুমার নামে এক আইপিএস অফিসার। আশঙ্কা হয়, সনাতন ধর্মের স্বঘোষিত রক্ষকটি যখন প্রধান বিচারপতির উদ্দেশে জুতো ছোড়ে, তখন তাঁর জাতিগত পরিচয়টি সে ভোলেনি— তথাকথিত নিম্নবর্ণের এক জন সনাতন ধর্মের অপমান করেছেন, এই কথাটি সম্ভবত সেই রক্ষকের কাছে আরও বেশি অসহনীয় হয়েছিল। ঘটনাপ্রবাহ এমনই যে, এই দুর্ভাগ্যজনক আশঙ্কাটিকে অগ্রাহ্য করার কোনও উপায় ভারতের কাছে নেই। গোলওয়ালকর-দৃষ্ট হিন্দু ভারতে বর্ণাশ্রম অবশ্যমান্য— দেশের কর্তারা যখন সেই ভারত প্রতিষ্ঠা করেই ফেলেছেন, তখন আর পদাতিকরা হাত গুটিয়ে থাকবে কেন?
প্রধান বিচারপতি স্বয়ং দৃশ্যত এই ঘটনাকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে নারাজ। শীর্ষ আদালতের অন্য দুই বিচারপতিও বলেছেন, আর কথা না বাড়িয়ে এ বার ঘটনাটিকে পিছনে ফেলে যাওয়াই ভাল। তাঁদের এই অবস্থানের কারণ বুঝতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু, ভারতের পক্ষে এই ঘটনাটি না ভোলাই বিধেয়। এই আইনজীবী প্রকৃত প্রস্তাবে চুম্বকে ধরে দিয়েছেন আজকের ভারতের অবস্থাটি। এবং, সমগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক বাস্তুতন্ত্র এই ঘটনাটিকে যে ভাবে প্রচ্ছন্ন সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছে, তাতে স্পষ্ট যে, ঘটনাটি পূর্বাপরহীন নয়। দেশের নেতারা ভাবুন, তাঁরা মাত্র এগারো বছরে কী ভয়ঙ্কর এক সমাজ তৈরি করতে সক্ষম হলেন, যেখানে এক জন আইনজীবীর কাছেও শীর্ষ আদালতের আর কোনও সম্মান নেই।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)