E-Paper

হিমশৈলের তল

বয়সকালের নানা রোগ-অসুখ, একাকিত্ব, সময় ও প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পারার অপারগতা ইত্যাদি তো আছেই, সেই সঙ্গে ক্রমাগত বেড়ে চলেছে বৃদ্ধবয়সে প্রতারণা ও নির্যাতনের অভিজ্ঞতা।

শেষ আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০২৫ ০৫:২৮

দীর্ঘ বার্ধক্যকাল মানে কি নিশ্চিন্ত যাপন? কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের প্রবীণ ও বয়স্কদের মুখ থেকে এর ইতিবাচক উত্তরটি শোনা যাবে বলে মনে হয় না। বয়সকালের নানা রোগ-অসুখ, একাকিত্ব, সময় ও প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পারার অপারগতা ইত্যাদি তো আছেই, সেই সঙ্গে ক্রমাগত বেড়ে চলেছে বৃদ্ধবয়সে প্রতারণা ও নির্যাতনের অভিজ্ঞতা। কলকাতা পুলিশের ‘কমিউনিটি পুলিসিং’-এর এক সাম্প্রতিক সমীক্ষায় উঠে এসেছে অতি দুঃখের ছবি— প্রতি সাত জন বয়স্কের মধ্যে তিন জন কোনও না কোনও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। একুশ শতকে প্রযুক্তির ব্যবহার জীবনে যত বাড়ছে, ততই বাড়ছে সাইবার-প্রতারণা: স্মার্টফোনে অডিয়ো-ভিডিয়ো কলে বা কিউআর কোড, লিঙ্ক, পাসওয়ার্ড-ওটিপি’সহ নানা ছলে ও কৌশলে বয়স্ক মানুষদের সারা জীবনের সম্বল হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারকরা। গত বছর জুড়ে এমন ঘটনা এত সংখ্যায় ঘটেছে যে, পুলিশকেও বেগ পেতে হয়েছে বিস্তর, যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খোয়া যাওয়া টাকার সুরাহা হয়নি বলেই অভিযোগ।

এ তো তবু বাইরের লোক, অচেনা প্রতারক। কিন্তু প্রতারক ও নিপীড়ক যখন ঘরেরই কেউ— আত্মীয়-পরিজন এমনকি সন্তানও? সমীক্ষায় যে তথ্য উঠে এসেছে তা থেকে স্পষ্ট, বাইরের প্রতারণা যদি হয় হিমশৈলের চূড়া, তবে তার বৃহদংশ লুকিয়ে গৃহকোণে। কারণ সমীক্ষাভুক্ত নির্যাতিত বয়স্ক মানুষদের ২৫ শতাংশ আত্মীয়দের নির্যাতনের শিকার, ১৫ শতাংশ দেখাশোনার দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকেদের হাতে; ২০ শতাংশকে নিগ্রহ করছে প্রতিবেশীরা, আর সবচেয়ে বেশি, ৪০ শতাংশই নিজের সন্তান বা তাদের সঙ্গীদের হাতে নির্যাতিত। একা থাকা বয়স্কেরা সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত, তার পরেই সেই মানুষেরা যাঁরা সন্তানের সঙ্গে থাকেন বটে, কিন্তু স্বামী বা স্ত্রী এক জনকে হারিয়েছেন। ভেঙে পড়া স্বাস্থ্য বা রোগ-অসুখের পরিচর্যায় অবহেলা যেমন হচ্ছে, তেমনই চিকিৎসা বা পরিচর্যার নাম করে সন্তান, আত্মীয়, প্রতিবেশী থেকে পরিচর্যাকারী হাতিয়ে নিচ্ছে বৃদ্ধ মানুষদের টাকাপয়সা। ভুলিয়েভালিয়ে বা চাপ দিয়ে লিখিয়ে নেওয়া হচ্ছে সম্পত্তির দলিল, হস্তান্তর করানো হচ্ছে ‘পাওয়ার অব অ্যাটর্নি’— ঘরে থাকা টাকা চুরি, ব্যাঙ্কের পাসবই বা ডেবিট-ক্রেডিট কার্ডের অপব্যবহার হচ্ছে আকছার। স্বাস্থ্য ও অর্থ, এই দুইয়ের উপস্থিতি এবং অনুপস্থিতিও হয়ে দাঁড়াচ্ছে কাল।

বাইরের বিপদে সতর্ক হলে তবু রক্ষা মেলে, চার দেওয়ালের মধ্যে এই সঙ্কটের পরিত্রাণ কোথায়? উপরের সব তথ্য পাওয়া গিয়েছে পুলিশের কাছে দায়ের হওয়া বয়স্কদের অভিযোগের ভিত্তিতে। ভারতীয় তথা বঙ্গসমাজে এই একুশ শতকেও মা-বাবারা ভাবতে পারেন না, সন্তান বা পরিজন অবহেলা করলে, এমনকি প্রতারণা বা নির্যাতন করলেও পুলিশ বা আদালতের দ্বারস্থ হওয়া যায়, হওয়া দরকার। এঁদের অধিকাংশই বয়স্কদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার আইনি দিকগুলি সম্পর্কে জানেনই না, যে ক’জন জানেন তাঁরাও চক্ষুলজ্জা ও লোকলজ্জা ঝেড়ে অভিযোগ করেন না, কাছের মানুষের প্রতারণা ও নির্যাতনও সহ্য করে যান আমৃত্যু। এই দিকটিতে প্রশাসনের অবিলম্বে নজর দেওয়া দরকার: কোন পথে, কী ভাবে তা নিশ্চিত হবে, ঠিক করা দরকার। ঘরের ঘেরাটোপে বার্ধক্যের গোপন অশ্রুপাত ও মৃত্যুকামনায় সরকারেরও কিছু দায় থাকে, নাগরিকের জীবনের অধিকার তাকে নিশ্চিত করতেই হবে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Old persons Aged torture Fraud

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy