পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকারি কর্মীদের বকেয়া মহার্ঘ ভাতার ২৫ শতাংশ মিটিয়ে দিতে হবে তিন মাসের মধ্যেই, এক অন্তর্বর্তী রায়ে নির্দেশ দিল সুপ্রিম কোর্ট। ২০০৯ থেকে ২০১৯, এই দশ বছরে কেন্দ্রীয় সরকারের মহার্ঘ ভাতার সঙ্গে রাজ্য সরকারের মহার্ঘ ভাতার যে ফারাক, বর্তমান মামলার পরিপ্রেক্ষিতে সেটিই বকেয়া ভাতা। এই সময়কালে বকেয়া ভাতার গড় পরিমাণ ছিল মূল বেতনের ৩৪ শতাংশ। হিসাব বলছে, বকেয়া মহার্ঘ ভাতার ২৫ শতাংশ মেটাতে হলে রাজ্য সরকারের ব্যয় হবে অন্তত ১০,০০০ কোটি টাকা। অঙ্কটি বিপুল, সন্দেহ নেই। পরবর্তী রায়ে শীর্ষ আদালত যদি সম্পূর্ণ মহার্ঘ ভাতা মেটানোর কথা বলে, তবে অঙ্কটি গিয়ে দাঁড়াবে ৪০,০০০ কোটি টাকায়। তলানিতে ঠেকা রাজকোষ থেকে সে টাকার ব্যবস্থা হবে কী ভাবে, সে প্রশ্নও থাকছে। রাজ্য সরকারের অর্থাভাবের যুক্তিটি অবশ্য আদালতের ধোপে টেকেনি।
কেউ আশঙ্কা প্রকাশ করতেই পারেন যে, সরকারি কর্মীদের মহার্ঘ ভাতা মেটানোর জন্য এই টাকার ব্যবস্থা করতে হলে টান পড়বে রাজ্য সরকারের বিভিন্ন কল্যাণ প্রকল্পে। সেগুলির উন্নয়ন-ক্ষমতা ইতিমধ্যেই বিভিন্ন সূচকের মাপকাঠিতে প্রমাণিত। ফলে, সেই সব প্রকল্পে বড় মাপের কাটছাঁট করে বকেয়া মহার্ঘ ভাতা মেটাতে হলে মানবোন্নয়নের ক্ষেত্রে তার কী প্রভাব পড়বে, সে প্রশ্নটি থাকছে। যে দেশের প্রতি দশ জন কর্মরত ব্যক্তির মধ্যে প্রায় সাড়ে ন’জনই কাজ করেন অসংগঠিত ক্ষেত্রে, যেখানে কম বেতন থেকে চাকরির অনিশ্চয়তার মতো প্রতিটি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, সেখানে সুনিশ্চিত মোটা বেতনের পাকা চাকরির অধিকারী সরকারি কর্মীদের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে তাল রেখে চলার জন্য মহার্ঘ ভাতা দেওয়া বণ্টনের ন্যায্যতার মানদণ্ডে কতখানি উত্তীর্ণ হয়, সে প্রশ্নটিও কখনও উড়িয়ে দেওয়ার নয়। কিন্তু, এর কোনওটিই একটি প্রাথমিক যুক্তিকে অতিক্রম করতে পারে না— রাজ্য সরকার যদি নিযুক্ত কর্মীদের মহার্ঘ ভাতা দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়, তবে কোনও কারণেই সরকার সেই শর্ত ভঙ্গ করে বকেয়া মহার্ঘ ভাতা দিতে অস্বীকার করতে পারে না। সে বকেয়া যদি পূর্বতন, বিরোধী পক্ষ পরিচালিত সরকারের আমলের হয়, তা হলেও নয়— কারণ, অঙ্গীকারটি কোনও রাজনৈতিক দলের নয়, প্রশাসনের। নতুন নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকার মহার্ঘ ভাতা না দেওয়ার শর্ত আরোপ করতে পারে। সে শর্ত আইনের ধোপে টিকবে কি না, মামলা হলে সে বিচার করবে আদালত। কিন্তু, কর্মীদের বকেয়া ভাতা না দেওয়ার পক্ষে প্রতিটি যুক্তিই অপযুক্তি।
কথাটি রাজ্য সরকার জানে না, এমন নয়। সাধারণ নীতিবোধ এবং কাণ্ডজ্ঞান থেকেই কথাটি উপলব্ধি করা স্বাভাবিক। কিন্তু, কোনও অজ্ঞাত কারণে সেই বোধগুলি যদি যথেষ্ট প্রখর না-ও হয়, তবু সুপ্রিম কোর্টে মামলা দাখিল করার আগেই বিভিন্ন আদালতে পাঁচ বার মামলায় পরাজিত হয়ে সরকারের এই কথাটি বুঝে নেওয়া উচিত ছিল যে, বকেয়া ডিএ না চুকিয়ে পার পাওয়া যাবে না। কিন্তু, মহার্ঘ ভাতা থেকে এসএসসি, বিভিন্ন প্রশ্নে রাজ্য সরকারের অবস্থান দেখে মনে হয়, কোনও যুক্তিতেই প্রশাসনিকতার যে অভাবকে ঢাকা চলে না, সমর্থনের অযোগ্য সে সব সিদ্ধান্ত নিয়ে বারে বারে আদালতের দ্বারস্থ হওয়া, এবং বারে বারে ধাক্কা খাওয়াই বুঝি এই সরকারের নীতি। নিতান্ত যুক্তিহীন অবস্থান, বলার উপায় নেই— ডিএ মামলাই প্রমাণ, বারে বারে আদালতে গিয়ে, বিষয়টিকে বিচারাধীন অবস্থায় রেখে দিয়ে সরকার প্রায় এক দশক সময় কাটিয়ে দিতে পেরেছে বকেয়া না চুকিয়েই। নুন আনা দূরে থাকুক, যে সরকারের পান্তারও সংস্থানটুকু নেই, তার পক্ষে এ এক বিচিত্র কিন্তু কার্যকর রণকৌশল বটে— জয়ের আশা নয়, বরং বাড়তি সময় জোগানোর কৌশল। তবে আশঙ্কা হয়, বারংবার প্রয়োগ করতে করতে এই বার কৌশলটির শেষ প্রান্তে পৌঁছে গিয়েছে রাজ্য সরকার। আর পিছনোর জায়গা আছে কি?
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)