ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক-যুদ্ধ বিষয়ে কয়েকটি কথা স্পষ্ট। প্রথমত, আমেরিকার সঙ্গে অন্তত স্বল্পমেয়াদে বাণিজ্য সম্পর্ক ছিন্ন করা ভারতের পক্ষে ক্ষতিকারক। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও কথাটি বিলক্ষণ জানেন। ২৫% আমদানি শুল্ক, এবং তার উপরে জরিমানা চাপানোর সিদ্ধান্তটিকে তাঁর চাপ দেওয়ার কৌশল হিসাবেই দেখা যেতে পারে। যতখানি হুমকি দেওয়া হচ্ছে, বাস্তবে শুল্ক ও জরিমানার পরিমাণ সেই স্তরে পৌঁছবে না, এমন একটি সম্ভাবনা রয়েছে। এ কথাও অনস্বীকার্য যে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কথায় ভারতের বিরক্ত হওয়ারও যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কিন্তু, ভারতকে এখন এই চাপের সামনে খানিক দূর অবধি নতিস্বীকার করতে হবে। কতখানি, সেটা ভারতের আর্থ-কূটনৈতিক দক্ষতার উপরে নির্ভর করছে। ভারত ইতিমধ্যেই বেশ কিছু ক্ষেত্রে শুল্ক কমিয়েছে। সামরিক সরঞ্জাম এবং পারমাণবিক প্রযুক্তি সংক্রান্ত যন্ত্রপাতির মতো ক্ষেত্রে বড় অঙ্কের আমেরিকান পণ্য কিনতেও যে ভারত রাজি, সে ইঙ্গিতও মিলেছে। দ্বিতীয় কথা, এখন আমেরিকান চাপের একটি বড় কারণ ভারতের কৃষিপণ্যের বাজার খোলা। এ ক্ষেত্রে ভারতের অনীহা স্পষ্ট। ভারতের আশঙ্কা, আমেরিকার ভর্তুকিপ্রাপ্ত কৃষিপণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ভারতীয় কৃষি টিকতে পারবে না। এ ক্ষেত্রে ভারতকে কয়েকটি কথা মনে রাখতে হবে। প্রথমত, ভারতীয় কৃষি রফতানির উপরে— বিশেষত মাছের উপরে— যদি চড়া শুল্ক অব্যাহত থাকে, তবে সে বাজারটি বেদখল হওয়ার আশঙ্কা। তা ছাড়া, আমেরিকা যে কৃষিপণ্যগুলি ভারতের বাজারে বেচার দিকে জোর দিচ্ছে, যেমন ভুট্টা বা দুগ্ধজাত পণ্য, সেগুলি ভারত এখনও আমদানি করে— ফলে, শুল্ক পণ্যের দাম কমলে ভারতীয় ক্রেতাদের লাভ।
ট্রাম্প যে জরিমানার হুমকি দিয়েছেন, তা মূলত রুশ আমদানি আটকানোর জন্য: তৃতীয় বিষয় এটিই। সাম্প্রতিক কালে রাশিয়া থেকে ভারতে আমদানির পরিমাণ তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বেড়েছে— পেট্রলিয়াম আমদানির কারণে। রুশ পেট্রলিয়ামের সবচেয়ে বড় ক্রেতা চিন; তার পরেই ভারত। আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে বেশ খানিক কম দামে তেল কিনতে পারায় ভারতের লাভ হয়েছে যথেষ্ট। এই মুহূর্তে দেশে তেল আমদানির এক-তৃতীয়াংশই আসে রাশিয়া থেকে। এ কথা প্রশ্নাতীত যে, ভারত কোন দেশের সঙ্গে কী বাণিজ্য করবে, সে বিষয়ে তৃতীয় পক্ষের কিছু বলার অধিকার থাকতে পারে না। এই অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা ভারতের কর্তব্য। কিন্তু, পাশাপাশি এ কথাও সত্যি যে, পেট্রলিয়ামের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি পণ্যের ক্ষেত্রে কোনও একটি নির্দিষ্ট দেশের উপরে ভারতের এই অতিনির্ভরতাও সুসংবাদ নয়। কাজেই, নিজের স্বার্থেই ভারত এই আমদানি নীতি পুনর্বিবেচনা করতে পারে।
আমেরিকার এই চাপকে বিপদ হিসাবে না দেখে একটি সুযোগ হিসাবে দেখা ভারতের কর্তব্য, এটি চতুর্থ কথা। স্বল্প অথবা মাঝারি মেয়াদে আমেরিকার উপরে নির্ভরশীলতা ত্যাগ করা ভারতের পক্ষে কঠিন। কিন্তু, ট্রাম্পের তৈরি করা এই পরিস্থিতি থেকে ভারতের বোঝা উচিত যে, বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে চাবিকাঠি হল বৈচিত্র এবং বিস্তার। নতুন নতুন বাণিজ্যসঙ্গী খোঁজা, এবং তাদের সঙ্গে নির্ভরযোগ্য বাণিজ্যসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা। জোর দিতে হবে বহুপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তির উপরেও, যাতে কোনও দেশ এ ভাবে ভারতে মাথার উপরে খাঁড়া ঝোলাতে না পারে। সম্প্রতি ব্রিটেনের সঙ্গে ভারত যে উদার বাণিজ্য চুক্তি করেছে, সেটি এই অভিমুখে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। একই সঙ্গে ভারতকে মনে রাখতে হবে যে, রক্ষণশীল বাণিজ্য নীতি দেশের পক্ষে লাভজনক নয়। ইউপিএ আমলে কৃষিপণ্যের বাণিজ্যের বাজার যে ভাবে খোলা হয়েছিল, তাতে ভারতের কৃষি রফতানি বেড়েছিল বিপুল পরিমাণে। বর্তমান সরকারের আমলে সে বৃদ্ধি স্তব্ধ হয়েছে। উদার বাণিজ্যই যে আর্থিক সমৃদ্ধির চাবিকাঠি, সে কথা ভোলা চলবে না।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)