Advertisement
০৫ মে ২০২৪
deforestation

সবুজের সৎকার

  স্রেফ ভাবমূর্তি বজায় বা শপথ রক্ষায় নহে, ‘আত্ম’রক্ষার্থেই ভারতকে স্বদেশের সবুজ ধ্বংস বন্ধ করিতে হইবে, এই মুহূূর্ত হইতে।

শেষ আপডেট: ২০ অক্টোবর ২০২১ ০৪:৫২
Share: Save:

পূজার মাসে গুয়াহাটির ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা, জুন হইতে সেপ্টেম্বর বৃষ্টির পরিমাণে ব্যাপক ঘাটতি, কাজিরাঙায় বন্যার প্রাবল্য অন্যান্য বৎসরের তুলনায় কিছুই না হওয়া— এই সবই বিপদসঙ্কেত দিতেছিল। এক আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় এই বার উঠিয়া আসিল উদ্বেগের তথ্য, এক ২০২০ সালেই উত্তর-পূর্ব ভারতে বৃক্ষ-আচ্ছাদন কমিয়াছে ৭৯ শতাংশ, এবং ২০০১-২০২০ সময়কালে সারা দেশের মোট সবুজ ধ্বংসের ১৪ শতাংশই ঘটিয়াছে অসমে। ২০১০-এও অসমে রাজ্যের মোট ‘ল্যান্ড এরিয়া’র ৩৩ শতাংশেরও বেশি ঢাকা ছিল প্রাকৃতিক অরণ্যে, গত বৎসর তাহা হইতে যে পরিমাণ বন মুছিয়া গিয়াছে তাহা আট মেট্রিক টনেরও বেশি কার্বন নিঃসরণের সমান। চিরসবুজ উত্তর-পূর্ব ভারতের সাত রাজ্যেই মারাত্মক ধ্বংস হইতেছে অরণ্য ও বৃক্ষ; অসম যদি পরিমাণে সর্বাধিক করিয়া থাকে, তবে দ্রুততায় সবাইকে ছাড়াইতেছে ত্রিপুরা ও নাগাল্যান্ড।

কৃত্রিম উপগ্রহের তোলা দশ লক্ষেরও বেশি ছবি, বিপুল তথ্য, অরণ্য বা বৃক্ষ-আচ্ছাদনের সামান্যতম হ্রাসও ধরা পড়ে এমন গাণিতিক পদ্ধতি— এই সমস্তকে স্রেফ ‘বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্যবেক্ষণ’ বলিয়া উড়াইয়া দিবার প্রশ্ন নাই। দেশে সবুজের উপস্থিতি প্রসঙ্গে নির্দিষ্ট সময় অন্তর নিয়মিত রিপোর্ট বাহির হয়, ২০১৯-এর ডিসেম্বর-অন্তে প্রকাশিত সেই ইন্ডিয়া স্টেট অব ফরেস্ট রিপোর্ট (আইএসএফআর)-এ সারা দেশে সার্বিক ভাবে বনপ্রসারের হার বৃদ্ধির কথা সোৎসাহে উল্লিখিত হইয়াছে। তাহার পরে গত বৎসরেই দেশে কোভিড-অতিমারির প্রাদুর্ভাব, এবং এই বৎসরটিতেই অসম-সহ উত্তর-পূর্ব ভারতে সবুজ ধ্বংসের নিদারুণ চিত্র বুঝাইয়া দিল, অতিমারি দেশকে পাড়িয়া ফেলিলেও মানুষ সবুজকে ছাড়িয়া দেয় নাই, লকডাউন ও বিধিনিষেধের অন্তরালে নির্বিচারে অরণ্য ও বৃক্ষ ছেদন করিয়া গিয়াছে। এবং ইহা স্রেফ একটি বৎসরের কুকীর্তি নহে, দীর্ঘ কাল চলিয়া আসা দুষ্কৃতি। সবুজ নিধন প্রাকৃতিক কারণে, দাবানল বা অন্যান্য দুর্যোগেও যে হয় না তাহা নহে, কিন্তু ধ্বংসলীলার দ্রুতি ও ব্যাপ্তিতেই পরিষ্কার, মানুষের প্রসারিত হাত ছাড়া এই দুরাচার অসম্ভব।

মনে রাখা দরকার ছিল, উত্তর-পূর্ব ভারত সারা দেশের মাত্র ৮ শতাংশ ভৌগোলিক অঞ্চল অধিকার করিয়া আছে, কিন্তু দেশের অরণ্য-আচ্ছাদনের প্রায় ২৫ শতাংশ তাহারই উপহার। মনে রাখা দরকার ছিল ২০১৮-র জাতীয় অরণ্য নীতির খসড়া, যেখানে ‘ইকো-সিকিয়োরিটি’-কে জাতীয় লক্ষ্য হিসাবে তুলিয়া ধরিয়া দেশের মোট ল্যান্ড এরিয়া-র অন্তত এক-তৃতীয়াংশ প্রাকৃতিক সবুজের আচ্ছাদনে ঢাকিবার কথা বলিয়াছিল কেন্দ্রীয় সরকার। সর্বোপরি মনে রাখা দরকার ছিল প্যারিস জলবায়ু চুক্তির কথা, ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে আড়াই হইতে তিন বিলিয়ন টন কার্বন ডাইঅক্সাইডের সমতুল্য ‘কার্বন সিঙ্ক’ তৈরির ভারতীয় অঙ্গীকার। স্রেফ ভাবমূর্তি বজায় বা শপথ রক্ষায় নহে, ‘আত্ম’রক্ষার্থেই ভারতকে স্বদেশের সবুজ ধ্বংস বন্ধ করিতে হইবে, এই মুহূূর্ত হইতে। করিতে হইবে সুষ্ঠু বনায়ন, বন সংরক্ষণ, বৃক্ষরোপণ, এগ্রো-ফরেস্ট্রির ন্যায় পদক্ষেপ। এই বৎসরের শেষে প্রকাশিতব্য আইএসএফআর দেখিয়া তাহা হইলে মুখ পুড়িবে না, শিহরিয়া উঠিতে হইবে না। দেশনিয়ন্তারা কী করেন, তাহাই দেখিবার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

deforestation
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE